জ্ঞান অন্বেষণ বা তলবুল ইলম নিঃসন্দেহে অতি মূল্যবান বিষয়। ইসলাম এই জ্ঞান অন্বেষণের মর্যাদা আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বপ্রথম যে ওহি নাজিল হলো, তা হচ্ছে- ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে’। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- ‘জ্ঞান অন্বেষণ করা (ইলম তলব করা) সকল মুসলিমের ওপর ফরজ।’ (ইবনে মাজাহ : ২২৪)
ইলম অর্জন করা সকল স্থান ও সময়ের জন্যই ফজিলতের এবং সমান বৈশিষ্ট্যের। তবে এর মর্যাদা একটু বেড়ে যায়, যখন তা হয় মসজিদে নববির মতো পবিত্র ও মহিমান্বিত জায়গায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ ব্যাপারে বলেন- যে ব্যক্তি আমার এই মসজিদে আসবে কোনো ভালো বিষয় শিখতে বা শেখাতে, সে আল্লাহর রাস্তার একজন মুজাহিদের সমতুল্য। আর যে এ ছাড়া অন্য কোনো কাজে আসবে, সে ওই ব্যক্তির মতো, যে অন্যের সম্পদের দিকে তাকিয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ : ২২৭; মুসনাদে আহমাদ : ৯৪১৯)
মসজিদে নববির মাকতাবা বা গ্রন্থাগার সে ধরনেরই একটি জ্ঞানকেন্দ্র। মদিনা মুনাওয়ারার এই মাকতাবা অসংখ্য গ্রন্থাগার ও মাকতাবার মাঝে উল্লেখযোগ্য।
প্রতিষ্ঠা : ‘খাজাইনুল কুতুবিল আরাবিয়্যাহ’ গ্রন্থের লেখক উল্লেখ করেন যে, মসজিদে নববির গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৮৮৬ হিজরির ১৩ রমজানের অগ্নিকাণ্ডের আগে। তাই সেই অগ্নিকাণ্ডে এর অনেক মূল্যবান কিতাব ভষ্মিভূত হয়। যে গ্রন্থাগারে এ সমস্ত নুসখা ছিল, সেখানে এ ছাড়াও অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ এবং বিশেষ করে অসংখ্য মাখতুতাত বা পাণ্ডুলিপি ছিল। তবে সেই সংগ্রহশালার জন্য গ্রন্থাগার বা মাকতাবার পরিবর্তে তখন অন্য আরেকটি পরিভাষা ব্যবহার করা হতো, আর তা হচ্ছে ‘খিজানাতুল কুতুব’। এরপর থেকে উলামায়ে কেরামের হাত ধরে খিজানাতুল কুতুব স্বাভাবিকভাবে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে সউদি শাসনামলে ১৩৫২ হিজরিতে তৎকালীন মদিনার ধর্ম ও ওয়াক্ফ বিষয়ক দায়িত্বশীল উবায়েদ মাদানির পরামর্শে ‘মাকতাবাতুল মাসজিদিন নাবাবি’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় এই গ্রন্থাগারের মুদির বা পরিচালক ছিলেন সাইয়্যেদ আহমাদ খায়্যারী।
তবে আগেই বলেছি, এ গ্রন্থাগার অনেক প্রাচীন। এ কারণে গ্রন্থাগারে এমন অনেক কিতাব রয়েছে, যার ওয়াকফের তারিখ বর্তমান নামে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠারও অনেক পূর্বের। যেমন শাইখ মুহাম্মদ আল আজিজ আল ওয়াজির-এর ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার, যা মসজিদে নববির জন্য ওয়াক্ফ করা হয়েছে ১৩২০ হিজরিতে । এ ছাড়া পবিত্র রওজা শরিফেও অসংখ্য ওয়াক্ফকৃত কিতাব ও পাণ্ডুলিপি এ গ্রন্থাগারে সংযোজন করা হয়েছে, যার ওয়াকফের তারিখও মাকতাবা প্রতিষ্ঠার অনেক আগের।
গ্রন্থাগারের স্থান : গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন স্থানে ছিল এর অবস্থান। গ্রন্থাগারটি মসজিদে নববির অভ্যন্তরে বাবে ওমর ও বাবে উসমান সংলগ্ন স্থানে দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। আর সে কারণে সাধারণের মুখে মুখে প্রচলনের কারণে মাকতাবাতু উমর ও মাকতাবাতু উসমান নামে প্রচলিত ছিল। তবে এর একটি সমস্যা ছিল, কিতাবগুলো দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। অর্থাৎ হাদিস, লুগা, তারিখসহ কিছু বিষয় ছিল মাকতাবাতু উমারে আর ফিকহ, আদাবসহ অন্য বিষয়গুলো ছিল মাকতাবাতু উসমানে। এতে করে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষকসহ সকলের একটু সমস্যা অনুভব হতো। তাই সকলের সুবিধার দিকে লক্ষ করে গ্রন্থাগারকে স্থানান্তর করে পশ্চিম দিকে ১২ নং গেট সংলগ্ন ছাদের ওপর নিয়ে আসা হয় এবং অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনায় সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্তভাবে সাজানো হয়।
গ্রন্থাগারের বিভিন্ন বিভাগ
অধ্যয়নকক্ষ : মসজিদে নববির গ্রন্থাগারের একটি বিভাগ হচ্ছে, পুরুষদের জন্য অধ্যয়নকক্ষ। এই কক্ষটি ছাদের ওপর অবস্থিত। এতে রয়েছে ৩৫৮টি অত্যাধুনিক সেলফ, ১০০,০০০ পরিমাণ গ্রন্থ এবং গবেষকদের জন্য ৩০০ চেয়ার।
ডিজিটাল গ্রন্থাগার : এতে রয়েছে বিশেষ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কম্পিউটারে অধ্যয়নের সুব্যবস্থা, রয়েছে পাণ্ডুলিপিসহ অসংখ্য গ্রন্থের বিপুল সমাহার। রয়েছে শ্রুতি লাইব্রেরি, যাতে আছে- তিলাওয়াত, দুই হারামের জুমার খুতবার বিশাল সংগ্রহের সাথে সাথে অসংখ্য আলোচনা, দারস ও নসিহা। এই ডিজিটাল লাইব্রেরিটি সকলের ব্যবহার উপযোগী করে অনেক পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে।
নির্দিষ্ট অধ্যয়ন কক্ষ : এতে বিশেষ কিছু কিতাব রয়েছে, যা একান্ত প্রয়োজনীয়। আর বিশেষ বিশেষ গবেষক ব্যতীত সেখানে সর্বসাধারণের যাওয়ার অনুমতি নেই।
সাময়িকী সংগ্রহশালা : এ বিভাগে রয়েছে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি সাময়িকী।
দুর্লভ গ্রন্থ বিভাগ : এতে দুর্লভ কিছু কিতাব ও পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
মহিলাদের অধ্যয়নকক্ষ : মহিলাদের জন্য মোট ৫টি অধ্যয়নকক্ষ রয়েছে। তিনটি পূর্ব দিকের মহিলাদের নামাজের স্থান উসমান বিন আফফান নামক ২৪ নং গেট সংলগ্ন এবং দুইটি পশ্চিম দিকের নামাজের স্থান ওমর বিন খাত্তাব নামক ১৬ নং গেট সংলগ্ন। এই বিভাগটির উদ্বোধন হয় ১৪১৬ হিজরির জুমাদাল উলার ১ তারিখে।
বিশেষ সংগ্রহশালা : মসজিদে নববির অভ্যন্তরে বাবে উসমান সংলগ্ন প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় রয়েছে বিশেষ সংগ্রহশালা। এতে রয়েছে কুরআনুল কারিম ও অসংখ্য কিতাবের মূল পাণ্ডুলিপি। এ সমস্ত পাণ্ডুলিপি মূল নুসখার পাশাপাশি মাইক্রোফিল্ম ও ডিজিটাল পদ্ধতিতেও সংরক্ষিত রয়েছে। সবকিছুর ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার জন্য রয়েছে কম্পিউটার ও ফটোকপির আধুনিক যন্ত্রপাতি। রয়েছে পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। দর্শনার্থীদের দেখানোর উদ্দেশ্যে সাজানো আছে ডিসপ্লে টেবিল। যাতে রয়েছে কিছু চমৎকার পাণ্ডুলিপি এবং কুরআনুল কারিমের হস্তলিখিত অতি চমৎকার ছবি। হজের সময় ছাড়াও বিভিন্ন সময় দর্শনার্থীদের জন্য এই সংগ্রহশালা দেখার সুব্যবস্থা আছে।
অডিও লাইব্রেরি বা শ্রুত গ্রন্থাগার : এটি মূলত মসজিদে নববির ১৭ নং দরজার সাথে অবস্থিত। এতে দুই হারামের ইমাম ও খতিব সাহেবদের তিলাওয়াত এবং খুতবার বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। রয়েছে মসজিদে নববির সমস্ত মাশায়েখগণের দারস-তাদরিসের অডিও ভার্সন। এ সবগুলোই সংরক্ষিত আছে ক্যাসেট, সিডিসহ আধুনিক সকল মাধ্যমেই। দর্শনার্থী ও জায়েরিনে মসজিদে নববি কেউ যদি এসব সংগ্রহ করতে চায়, তাহলে তা কোনো বিনিময় ছাড়াই হাদিয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে কেউ সিডি বা ভিডিওতে পেতে চাইলে অথবা হার্ডডিস্কে নিতে চাইলে তা নিজের পক্ষ থেকে সরবরাহ করতে হবে।
শিল্প ও কারিগরি বিভাগ : গ্রন্থাগারের এ বিভাগটি মূলত বিভিন্ন প্রকারের গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি ও পত্রপত্রিকার বাঁধাই, পুনঃবাঁধাই ও মেরামতের কাজ করে থাকে। বাঁধাইয়ের ওপর লেখার জন্য রয়েছে হস্তশিল্পীদের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা। ছাত্র-শিক্ষক এবং গবেষকদের সুবিধার জন্য যেকোনো কিতাব বা পাণ্ডুলিপির ফটোকপি বা পিডিএফও এই বিভাগ আঞ্জাম দিয়ে থাকে। এ বিভাগের অধীনে যে সমস্ত প্রকল্প রয়েছে, তা হচ্ছে- বিভিন্ন প্রকারের বাঁধাই প্রকল্প, কিতাব ও পাণ্ডুলিপির মেরামত ও সংরক্ষণ প্রকল্প, হস্ত ও মেশিনের মাধ্যমে কিতাবে লিখন প্রকল্প, ফটোকপি প্রকল্প। এ বিভাগটি অবস্থিত মসজিদে নববির ৯ নং গেট (মালিক সাউদ বিন আবদুল আজিজ গেট সংলগ্ন)।
ক্যাটালগ ও সরবরাহ বিভাগ : এ বিভাগটিও মসজিদে নববির ৯ নং গেট সংলগ্ন। এখানে ক্যাটালগ বিভাগ মূলত সরবরাহকৃত সমস্ত কিতাবের ক্যাটালগ তৈরির কাজ করে থাকে। আর সমস্ত কিতাবকে কম্পিউটারাইজড করাসহ আধুনিক বিভিন্ন ব্যবস্থাপনায় পাঠকদের জন্য উপস্থাপনের চেষ্টা করে থাকে। আর সরবরাহ বিভাগটি গ্রন্থাগারের কিতাব সংগ্রহের কাজ করে থাকে। গ্রন্থাগারের জন্য কিতাব সংগ্রহের পদ্ধতিগুলোর একটি হচ্ছে, তার নিজস্ব কিতাব কেনার বাজেটের মাধ্যমে কিতাব ক্রয় করা। তা ছাড়া এমন অনেকেই আছেন, যারা তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার অথবা নিজস্ব সংগৃহীত বই কিংবা পত্র-পত্রিকা মসজিদে নববির জন্য জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ওয়াক্ফ করে যান। এই বিভাগটি সেই সমস্ত কিতাব সংগ্রহ করে, যেগুলো গ্রন্থাগারের অধীনে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
সংরক্ষণ ও বিতরণ বিভাগ : প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিতাব ছাড়াও একই কিতাবের অতিরিক্ত কপিগুলো সংরক্ষণের জন্য রয়েছে বিশেষ সংরক্ষণ বিভাগ। আবার এই বিভাগের অধীনেই বিশ্বব্যাপী মসজিদ-মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কিতাব ও কুরআনুল কারিম বিতরণের সুব্যবস্থা রয়েছে।
কম্পিউটার বিভাগ : ক্যাটালগ তৈরির পর কিতাব ও পাণ্ডুলিপির পরিচিতি কার্ড তৈরি করে থাকে এই বিভাগ। স্ক্যানার-এর মাধ্যমে কিতাব, পাণ্ডুলিপি ও পত্র-পত্রিকাকে কম্পিউটারে স্থানান্তর করা হয়। যাতে করে পাঠক খুব সহজেই এ থেকে উপকৃত হতে পারে। এ ছাড়াও রেকর্ডকৃত সমস্ত তিলাওয়াত, খুতবা, দারস ও আজান এ বিভাগের মাধ্যমে কম্পিউটারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
অনুবাদ ও গবেষণা বিভাগ : এর মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ও আধুনিক প্রসঙ্গের বিভিন্ন মাসআলার গবেষণা-কার্য পরিচালনা করা হয়। অন্যান্য ভাষা থেকে প্রয়োজন অনুসারে আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়। এ বিভাগ ওয়াক্ফ ও হাদিয়াকৃত কিতাবের যাচাই-বাছাইয়ের পর গ্রন্থাগারে রাখার অনুমতি প্রদান করে থাকে। এ ছাড়াও মসজিদে নববির গ্রন্থাগারের আরও অনেক বিভাগ ও কার্যক্রম রয়েছে। প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।
মসজিদে নববির গ্রন্থাগার বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারের রয়েছে অন্যান্য সকল গ্রন্থাগারের চেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্য। স্থান ও কালের দৃষ্টিকোণ থেকে এর বৈশিষ্ট্য সকলের চেয়ে একধাপ এগিয়ে। প্রায় প্রতিদিনই যখন এই মাকতাবায় আসি, আশায় বুক বাঁধি যে, হয়তো কখনো আমাদের দেশের তালিবুল ইলমদের জন্য এ ধরনের একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে পারব। যেখানে বসে তালিবুল ইলমরা ইলমের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিচরণ করতে থাকবে। আর এতে সৃষ্টি হবে একটি ইলমী জাগরণ।
এক সমৃদ্ধ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহশালা : জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ধারা অব্যাহত থাকবে চিরকাল। ইসলাম সে চর্চার ধারাবাহিকতাকে করেছে আরও শক্তিশালী। উদ্বুদ্ধ করেছে নর-নারী সকলকে জ্ঞান অজর্নের প্রতি। আর সেই চর্চাকে জোরালো করতেই রচিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থ। গ্রন্থ সংগ্রহ আর জ্ঞানচর্চার সুবিধার জন্য যুগে যুগে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য গ্রন্থাগার।
মদিনা মুনাওয়ারার মালিক আবদুল আজিজ গ্রন্থাগার এর অন্যতম। এ গ্রন্থাগারের রয়েছে বিরাট ঐতিহ্য আর অনন্য বৈশিষ্ট্য। গ্রন্থাগারটি মূলত সাউদি আরবের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-এটি একটি ইসলামী পাঠাগার, যা সকলের জন্য উন্মুক্ত। তাই এটাকে গণ-গ্রন্থাগার বা পাবলিক লাইব্রেরি বলা যায়। আর এতে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের আধিক্যের কারণে বলা যায় পাণ্ডুলিপিকেন্দ্র।
গ্রন্থাগারটির মূল লক্ষ্য কিতাব ওয়াক্ফের সুন্নতকে পুনরুজ্জীবিত করার সাথে সাথে অধিক পরিমাণে তথ্যসূত্র জমা করা। পাঠকসহ গবেষক, ছাত্র-শিক্ষকদের গবেষণাকার্যে সহযোগিতা করা এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করা। মালিক আবদুল্লাহর নেতৃত্বে এবং মদিনার আমির আবদুল আজিজ বিন মাজেদ বিন আবদুল আজিজ-এর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই গ্রন্থাগারটি তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে সফল। বর্তমানে গ্রন্থাগারটি উত্তরোত্তর উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকাশনার মাধ্যমে এর কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হচ্ছে। মদিনা মুনাওয়ারায় অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী এই গ্রন্থাগারটির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি ও ইতিহাস নি¤েœ তুলে ধরা হলো-
১৩৯৩ হিজরি মুহাররমের ৩ তারিখ মোতাবেক ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এই গ্রন্থাগারটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মালিক ফয়সাল বিন আবদুল আজিজ (রহ.) এবং ১৪০৩ হিজরি ১৬ মুহাররম মোতাবেক ১৯৮২ সালের ২রা নভেম্বর এর উদ্বোধন করেন মালিক ফাহাদ বিন আবদুল আজিজ (রহ.)।
গ্রন্থাগারটি মসজিদে নববির সাহান (বারান্দা) সংলগ্ন পশ্চিমে অবস্থিত। আরও সহজ করে বলতে গেলে মসজিদে নববির ৭ নং কার পার্কিংয়ের সোজা বের হয়ে একটু হাঁটলেই চোখে পড়বে সবুজ নেমপ্লেটে লেখা ‘মাকতাবাতুল মালিক আকদুল আজিজ’। চার তলা বিশিষ্ট এই ভবনটিতে রয়েছে বিশেষ অধ্যয়ন কক্ষ, পণ্ডুলিপির জন্য বিশেষ হল, নতুন প্রকাশনা প্রর্দশনী কক্ষ, গবেষণাগার, মহিলা পাঠকক্ষ, শিশু পাঠাগার, সাধারণ আলোচনা হলসহ অনেক কিছু।
গ্রন্থাগারের বিভিন্ন বিভাগ
মুসহাফগার : এই বিভাগটিতে রয়েছে কুরআনুল কারিমের পণ্ডুলিপির এক বিশাল সংগ্রহ, যার সংখ্যা প্রায় ১৮৭৮টি। এর সাথে রয়েছে ৮৪টি হস্তলিখিত কুরআনুল কারিমের বিশেষ অংশ। এসব কিছুই মুসলিম ওলামায়ে কেরামের কুরআনুল কারিম পঠন-পাঠন, অনুবাদ, মুখস্থ করাসহ সার্বিক অবদানের সাক্ষ্য বহন করে। বর্তমানে এ সংগ্রহটি ইসলামী জ্ঞানভান্ডারের এক বিশাল সম্পদ। এর মাধ্যমে যুগে যুগে আরবি হস্তলিপির বিকাশ ও উন্নতি সম্পর্কে অবগত হওয়া যাবে।
অত্র মাকতাবায় সবচেয়ে প্রাচীন হস্তলিখিত কুরআনটির তারিখ লেখা আছে ৪৮৮ হিজরি। হরিণের চামড়ার মধ্যে এটি লিখেছেন আলি বিন মোহাম্মাদ আল বাতলিওসি। এর নিকটবর্তী কালের কুরআনটি ৫৪৯ হিজরির, যা লিখেছেন আবু সা’দ মোহাম্মাদ ইসমাইল বিন মোহাম্মাদ। এই কুরআনটি গ্রন্থাগারে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে ১২৫৩ হিজরি সালে। গোলাম মহিউদ্দীন-এর হাতে লিখিত কুরআনটি অত্র গ্রন্থাগারের সবচেয়ে বৃহদাকারের, যার লেখার তারিখ ১২৪০ হিজরি। এই হস্তলিখিত কুরআনটির ওজন ১৫৮ কি.গ্রা.।
পাণ্ডুলিপি বিভাগ : যেহেতু এই গ্রন্থাগারটি পাণ্ডুলিপি বা মাখতুতাতের ব্যাপারে অধিক যত্নশীল, তাই এর সংখ্যাও অনেক; প্রায় ১৭,৭২২। এর সবকটিই মূল পাণ্ডুলিপি, ফটোকপি নয়। সমস্ত পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ, বাধাই ও পরিচর্যার জন্য বিশেষ বিভাগ রয়েছে। মূল পাণ্ডুলিপি যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়, সেজন্য এই সমস্ত পাণ্ডুলিপিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হয়েছে। তাই গবেষকদেরকে এ সমস্ত পাণ্ডুলিপি সরাসরি না দিয়ে কম্পিউটারে অধ্যয়ন ও দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়। এর জন্য গবেষককে ক্যাটালগ দেখে কাক্সিক্ষত মাখতুতের নাম্বার, এর নাম ও লেখকের নাম গ্রন্থাগার থেকে সংগৃহীত বিশেষ কার্ডে লিখে ‘আমিনুল মাকতাবা’ বা লাইব্রেরিয়ান-এর নিকট দিলেই সঙ্গে সঙ্গে আভ্যন্তরীণ বিশেষ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে তা কম্পিউটারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গবেষক সেই কম্পিউটারে বসে নিজ ইচ্ছেমতো তা দেখতে পারবে। এই প্রক্রিয়ার একটি বিশেষ সুবিধা হলো, পাণ্ডুলিপিকে ছোটো ও বড়ো করে দেখা যায়। আর মূল কপিটি হাতের স্পর্শে নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যায়।
দুর্লভ গ্রন্থ বিভাগ : অত্র গ্রন্থাগারটিতে দুর্লভ কিতাব সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য একটি বিশেষ বিভাগ রয়েছে। এ সমস্ত কিতাবের সংখ্যা প্রায় ২৫,০০০ (পঁচিশ হাজার)।
উন্মুক্ত পাঠাগার : দ্বিতীয় তলায় পুরো স্থানজুড়েই রয়েছে বিশালাকারের পাঠাগার। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে এতে প্রায় এক লাখ গ্রন্থ রয়েছে। সাধারণ পাঠকের সুবিধার জন্য গ্রন্থগুলোকে আধুনিক নিয়মানুযায়ী সাজানো রয়েছে। সমস্ত গ্রন্থ সহজে খুঁজে পাওয়ার জন্য ডিজিটাল ক্যাটালগও তৈরি করা হয়েছে।
গবেষণা সংগ্রহশালা : বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এমফিল ও পিএইচডি গবেষণা গ্রন্থগুলোর বিশেষ গুরুত্ব এ বিভাগে রয়েছে। অত্র গ্রন্থাগার এ ধরনের প্রচুর গবেষণাগ্রন্থ সংগ্রহ করে এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি বিশেষ সংগ্রহশালা তৈরি করেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত এ ধরনের গবেষণাগ্রন্থ সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে।
সাময়িকী সংগ্রহশালা : বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, বিভিন্ন উপলক্ষ্যে আবার কখনো মাসিক, ত্রৈমাসিক, বার্ষিক সাময়িকী প্রকাশ করে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে এতে আলোকপাত করা হয়ে থাকে। তাই গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ সব সময় এ ধরনের সাময়িকী সংগ্রহের চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এগুলো সাজানো রয়েছে পরিকল্পিতভাবে।
ওয়াক্ফকৃত মাকতাবাসমূহ : রাসূল (সা.)-এর হিজরতের পর থেকে মদিনা মুনাওয়ারা ছিল ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়। তাই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্যোগে আবার কখনো সামষ্টিক উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল অসংখ্য মাকতাবা বা গ্রন্থাগার। কাল পরিক্রমায় যখন সরকারি উদ্যোগে মালিক আবদুল আজিজ গ্রন্থাগার নির্মিত হয়, তখন সংরক্ষণ ও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের প্রত্যাশায় ব্যক্তিগত, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বহু গ্রন্থাগার এই গ্রন্থাগারে ওয়াক্ফ করে দেওয়া হয়- যার সংখ্যা প্রায় ৩৪ (চৌত্রিশ)।
ক. সামাজিক গ্রন্থাগারসমূহ : ১. মাকতাবাতুল মুসহাফ আশ-শরিফ। ২. মাকতাবা আলমাহমুদিয়া। ৩. মাকতাবাতুল মদিনা আল-মুনাওয়ারা।
খ. প্রাতিষ্ঠানিক বা মাদ্রাসাকেন্দ্রিক মাকতাবাসমূহ : আল ইহছানিয়া আস সাকজিলি, আশ-শিফা, আল-ইরফানিয়া, আল-কাজনিয়া কিলি নাজিরি।
গ. ব্যক্তিকেন্দ্রিক মাকতাবাসমুহ : শায়েখ আরেফ হিকমত, রিবাত আল-জিবরত, রিবাত সায়্যিদিনা উসমান, রিবাত কুববাত বাশ, রিবাত বশির আগা, এ ছাড়াও আছে মদিনার বিশিষ্ট আলিমদের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারসমূহ। যেমন : শাইখ মোহাম্মাদ ইবরাহিম আল-খাতবি, শাইখ ওমর হামদান, শাইখ আবদুল কাদের জাজায়েরি। প্রফেসর ড. আবদুল্লাহ বিন মো. হাম্মাদ ছা’দ আল হুজাইলি।
মহিলা পাঠকক্ষ : নিচতলায় দক্ষিণ দিকে রয়েছে মহিলাদের জন্য বিশেষ পাঠকক্ষ। এতে মূল মাকতাবার সমস্ত কিছুই রয়েছে। রয়েছে কম্পিউটারসহ আধুনিক সকল সুবিধা। রয়েছে মূল গ্রন্থাগারের বিশাল পাণ্ডুলিপিগুলোর ক্যাটালগ। আর এই সবকিছু পরিচালনা-পর্যবেক্ষণ ও মহিলা গবেষকদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য রয়েছে দক্ষ-পারর্দশী ও গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ একদল মহিলা কর্মী। মহিলাদের এই বিভাগটি অথবা এই পাঠকক্ষটি বিকাল চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকে।
শিশু গ্রন্থাগার : শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আজকের শিশু আগামী দিনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেই দিকে লক্ষ্য রেখে অত্র গ্রন্থাগারে রাখা হয়েছে শিশুদের জন্য একটি বিশেষ বিভাগ। এতে রয়েছে শিশুদের উপযোগী গ্রন্থসমূহ, গল্প, কবিতা, ছন্দ, ছোটোদের জন্য ইসলামী ইতিহাস, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আরও অন্যান্য গ্রন্থ। সাথে রয়েছে তাদের উপযোগী করে সাজানো কম্পিউটারসহ আধুনিক অন্য যন্ত্রপাতি।
ব্যবহারকারীদের জন্য বিভিন্ন সেবাসমূহ : মালিক আবদুল আজিজ গ্রন্থাগারটি বর্তমানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় ভরপুর। গবেষক ও পাঠকদের চাহিদার দিকে লক্ষ্য করে গ্রন্থাগার কতৃপক্ষ দু’বেলা (সকাল-বিকাল) বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদানের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে।
ক. গ্রন্থাগারের আভ্যন্তরীণ খেদমতসমুহ : গ্রন্থাগারের ভেতরেই কতৃপক্ষ গবেষকদের সুবিধার জন্য ফটোকপি, দিকনির্দেশনা ও প্রয়োজনীয় কিতাব সরবরাহ করাসহ আরও অনেক সেবা দিয়ে থাকেন।
খ. বহির্মুখী সেবাসমুহ : গবেষক ও পাঠকদের প্রয়োজনানুসারে তাদের নিজস্ব ঠিকানায় কিতাব বা পণ্ডুলিপির ফটোকপিসহ বিভিন্ন তথ্য ও কাগজপত্র ডাকযোগে প্রেরণ করা হয়।
গ. টেলিফোনে তথ্য সরবরাহসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানার সুব্যবস্থা
ঘ. সকলের সুবিধার কথা লক্ষ করে তৈরি করা হয়ছে গ্রন্থাগারের নিজস্ব ওয়েবসাইট। এতে রয়েছে বিভিন্ন তথ্য, গ্রন্থ, প্রয়োজনীয় সংবাদ সরবরাহ, পাণ্ডুলিপি ও তথ্য গ্রন্থসমূহের ক্যাটালগসহ আরও অনেক কিছু।
বাঁধাই প্রকল্প : পুরাতন ছুটে যাওয়া কিতাব, পাণ্ডুলিপিসহ নতুন সরবরাহকৃত কিতাব, পাণ্ডুলিপিগুলো সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রয়েছে নিজস্ব বাঁধাই প্রকল্প। এতে রয়েছে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত বাঁধাই শিল্পী, যারা নিখুঁতভাবে বাঁধাইকার্য সম্পাদন করে। সেইসাথে এ সমস্ত মূল্যবান কিতাব ও পাণ্ডুলিপিসমূহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে।
শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড : মদিনা মুনাওয়ারায় অবস্থিত মালিক আবদুুল আজিজ গ্রন্থাগারটি তথ্যগ্রন্থ, পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক অভিসন্দর্ভ ও বিভিন্ন ক্যাটালগের মাধ্যমেই শুধু গবেষণা ও পাঠকের সেবা দেওয়ায় ক্ষান্ত থাকে না; বরং সমাজের সাধারণ মানুষের প্রতি খেয়াল করে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রোগামও হাতে নেয়। ব্যবস্থা করে বিষয় ও দিবসকেন্দ্রিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানের। অংশগ্রহণ করে দেশ-বিদেশের বইমেলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে।
নিজস্ব প্রকাশনা বিভাগ : অত্র গ্রন্থাগারে রয়েছে নিজস্ব প্রকাশনা বিভাগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গের লিখিত বই, গবেষণাপ্রবন্ধ এ বিভাগটি প্রকাশ করে থাকে। সাথে সাথে প্রকাশ করে গ্রন্থাগারের নিজস্ব গবেষকদের গ্রন্থসমূহও। সেসব গ্রন্থের কয়েকটি হলো- ফাহরাসু মাখতুতাতিল হাদিছিশ শরিফ ওয়া উলূমিহি, মাকতাবাতুল মালিক আবদুল আজিজ বাইনাল মাদি ওয়াল হাদির, আল-মাকতাবাত আল-ওয়াকফিয়্যাহ ফিল মামলাকাতিল আরাবিয়্যাহ আস সাউদিয়্যাহ।
মূলত মালিক আবদুল আজিজ গ্রন্থাগারটির অবস্থান মদিনার মুবারক স্থানে হওয়ার পাশাপাশি রয়েছে পণ্ডুলিপির সংগ্রহ ও সংরক্ষণের অনন্য বৈশিষ্ট্য। গবেষকদের নিকট রয়েছে এর সম্মানজনক অবস্থান। এ সমস্ত পাণ্ডুলিপি পাঠোদ্ধারের মাধ্যমে সঠিকভাবে মুদ্রিত হয়ে সাধারণ পাঠকমহলে প্রকাশিত হলে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে এক বিরাট সংযোজন হবে।
জাতিকে অধ্যয়ন-অনুরাগী করে তুলতে সাধারণ গ্রন্থাগারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যুগযুগ ধরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন দেশে সাধারণ গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং জনগণকে অধ্যয়নমুখী করতে সহযোগিতা করেছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সাধনে সহায়তা করেছে। সামসময়িক ও প্রয়োজনীয় বিষয়ে যথাযথ তথ্য সরবরাহ করেছে। সর্বোপরি জনসাধারণের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
মদিনা মুনাওয়ারা ইসলামের প্রথম রাজধানী। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময় থেকেই মদিনার সাধারণ জনগণসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তালিবুল ইলমরা আসতেন ইলম অন্বেষণের জন্য। সেই থেকেই মদিনায় আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে অসংখ্য গ্রন্থাগার, প্রতিষ্ঠিত হয় আল-মাকতাবাতুল ‘আম্মাহ মদিনা মুনাওয়ারা (অর্থাৎ সাধারণ গ্রন্থাগার, মদিনা মুনাওয়ারা)। সাধারণ গ্রন্থাগার যেহেতু জনগণের বিদ্যালয়, আল-মাকতাবাতুল ‘আম্মাহ মদিনা মুনাওয়ারা সফলতার সাথে জনগণের মাঝে জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ যাবতীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রেখে চলেছে।
প্রতিষ্ঠা : আল-মাকতাবাতুল ‘আম্মাহ মদিনা মুনাওয়ারা ১৩৮৯ হিজরিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে গ্রন্থাগারটি সউদি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ছিল। তবে ১৪২৭ হিজরিতে এই গ্রন্থাগারটিকে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে গ্রন্থাগারটি এই মন্ত্রণালয়ের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে।
অবস্থান : প্রতিষ্ঠা থেকে গ্রন্থাগারটি মসজিদে নববির দক্ষিণ পশ্চিমে ‘হাইউল বাহার’ নামক এলাকায় অবস্থিত ছিল। বর্তমানে তা মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাওয়াবা রায়িসিয়্যাহ’ বা প্রধান ফটক এর সামনে অবস্থিত। মসজিদে কিবলাতাইন থেকে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসতে ডান দিকে চোখে পড়ে মনোরম স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত গ্রন্থাগার ভবনটি। দেখামাত্রই যে কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে। ভবনের সামনে সোনালি প্লেটে লেখা ‘আল-মাকতাবা-আল ‘আম্মাহ বি মিনতাকিল মাদিনা আল-মুনাওয়ারাহ’ অর্থাৎ মদিনা মুনাওয়ারা সাধারণ গ্রন্থাগার।
গ্রন্থাগারের কার্যসময় : ছুটির দিন ছাড়া গ্রন্থাগারটি সপ্তাহের পাঁচদিন খোলা থাকে এবং প্রতিদিন দু’বেলা (সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা, বিকাল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত) পাঠক সেখানে বই পড়াসহ যাবতীয় সেবা গ্রহণ করতে পারে।
গ্রন্থাগারের বিভাগসমূহ : এ গ্রন্থাগারের অনেকগুলো বিভাগ রয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ আরও কিছু নতুন বিভাগ খোলার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। বর্তমানে যে বিভাগগুলো আছে, সেগুলো হলো :
১. প্রধান অধ্যয়ন হল : এই হলটি গ্রন্থাগারের প্রধান অংশ। অধিকাংশ তথ্যগ্রন্থ ও যাবতীয় বই-পুস্তক এখানেই সাজানো রয়েছে। ইলমি মাছাদির-মারাজি বা তথ্যগ্রন্থের সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ যাবতীয় গ্রন্থের সমাহার এখানে।
২. দুর্লভ কিতাব সংগ্রহশালা : একটি গ্রন্থাগারের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কিছু দুর্লভ গ্রন্থের সমাহার গড়ে তোলা। যার কারণে সাধারণ পাঠক ওই গ্রন্থাগারের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। এর প্রতি লক্ষ রেখে আল-মাকতাবাতুল ‘আম্মাহ মদিনা মুনাওয়ারা একটি দুর্লভ গ্রন্থ বা নাদির কিতাব-এর সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছে। এ বিভাগের কিতাব সাধারণত অন্যান্য নিয়মের বাহিরে থাকে। অর্থাৎ চাইলেই তা মুতালাআ করা যায় না; বরং ক্যাটালগ দেখে নির্দিষ্ট কিতাবটির জন্য ‘আমিনুল মাকতাবা’ বা গ্রন্থাগারিক-এর অনুমতি প্রয়োজন হয়। তবে অন্যান্য সাধারণ গ্রন্থ ধার নেওয়া গেলেও এই নাদির কিতাবগুলো ধার দেওয়া হয় না।
৩. পত্রিকা ও সাময়িকী বিভাগ : এই বিভাগে প্রতিদিন দুটি ইংরেজি পত্রিকা ও লন্ডন থেকে প্রকাশিত আশ-শারকুল আওসাত, সউদি থেকে প্রকাশিত ৯টি দৈনিক পত্রিকাসহ মোট ১২টি দৈনিক পত্রিকা রাখা হয়। প্রত্যেকে নিজ নিজ অভিরুচি অনুযায়ী পত্রিকা পাঠ করতে পারে। পরবর্তী সময়ে দৈনিকগুলোকে দিন, তারিখ ও বছর হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। দৈনিক পত্রিকা ছাড়াও সউদিসহ আশেপাশের আরব দেশগুলোর বিভিন্ন সংস্থা, প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত শিক্ষা, সংস্কৃতি ও খেলাধুলা-বিষয়ক অসংখ্য পত্রিকা ও সাময়িকীর সমাহার থাকে এই বিভাগে। বিভিন্ন শ্রেণির পাঠক বিভিন্নভাবে এ সমস্ত সাময়িকী থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পায়।
৪. শিশু পাঠক : প্রতিটি দেশের জাতীয় ও সাধারণ গ্রন্থাগারগুলো শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা রাখে। আবার কখনো গড়ে তোলে শিশু-গ্রন্থাগার। কারণ সাধারণ পাঠকের মতো শিশুদের ব্যবস্থা হলে চলে না। তাদের বয়স ও মননের সাথে মিল রেখেই তাদের সামনে তুলে ধরতে হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা। অন্যদের তুলনায় তাদের পরিচর্যা নিতে হয় একটু বেশি। এই শিশুরাই তো আগামীর ধারক- বাহক এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে তারাই ভূমিকা রাখবে। এই সমস্ত দিক খেয়াল করে গ্রন্থাগারে রাখা হয়েছে শিশুদের জন্য আলাদা পাঠকক্ষ। তৈরি করা হয়েছে তাদের উপযোগী সব বই। রয়েছে অডিও-ভিডিও শিক্ষা মাধ্যম। আরও রয়েছে খেলাধুলা ও আনন্দ-বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা। তাই অনেক অভিভাবককেই দেখা যায়, প্রতিদিন তাদের সন্তানদের গ্রন্থাগারে নিয়ে আসেন এবং অধ্যয়ন ও জ্ঞান অর্জনে তাদের আগ্রহী করে তুলেন।
৫. সংস্কৃতি ও বিনোদন কক্ষ : মূলত এটি একটি অডিটোরিয়াম বা মিলনায়তন। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে সভা, সেমিনার ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয় এখানে। অনেক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী এখানে তাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বিভিন্ন ধরনের নাটক ও কৌতুকও মঞ্চস্থ হয় এখানে। তবে সবকিছুই শরিয়তের নীতি ও বিধানের মধ্যে থেকে। আর এই গ্রন্থাগার এ জাতীয় সবকিছুর ব্যবস্থাপনা করে জনগণকে জাগিয়ে তোলার জন্য, অধ্যয়নসহ শিল্প-সাংস্কৃতিক কাজে অগ্রগামী করে তোলার জন্য।
৬. মহিলা পাঠকক্ষ : এই গ্রন্থাগারটি পূর্বের স্থান ‘হাইউল বাহারে’ যখন ছিল, তখন মহিলা পাঠকক্ষ ছিল। কিন্তু স্থান পরিবর্তনের পর মহিলা পাঠকক্ষের কাজ আরম্ভ করতে একটু দেরি হয়। তাই মহিলা পাঠকক্ষ বর্তমানে নির্মাণাধীন।
৭. বাঁধাই ও ক্যাটালগ বিভাগ : এই বিভাগ সাধারণ গ্রন্থাগারে আসা নতুন বইগুলোকে তাদের মতো করে বাঁধাই করে এবং ক্যাটালগ তৈরি করে। সাথে সাথে পুরাতন কিতাবগুলোও প্রয়োজনানুসারে বাঁধাই করে থাকে। এই বিভাগ ক্যাটালগের জন্য লাইব্রেরি ম্যানেজম্যান্টের ওপর নির্মিত ‘আল-ইয়াসির’ সফটওয়্যার ব্যবহার করে থাকে। সেবাসমূহ-
দিকনির্দেশনা : গ্রন্থাগারে আগত পাঠক-গবেষকদের কম্পিউটার, টেকনোলজিসহ গ্রন্থাগারের সার্বিক ব্যবস্থাপনা থেকে সহজে উপকৃত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু লোক সেবা দিয়ে থাকে। কোন কিতাব কোথায় আছে, তা জানিয়ে থাকে এবং পাঠকদের প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকে। যে সমস্ত কিতাব ধার দেওয়া হয় না, সেগুলো দেখা ও পাঠের ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য গ্রন্থ সরবরাহের সেবা দেয় কিছু কর্মী।
ধার প্রদান : পাঠক যেন গ্রন্থাগার থেকে খুব ভালোভাবে উপকৃত হতে পারেন, সেজন্য রয়েছে গ্রন্থ ধার দেওয়ার ব্যবস্থা। এর জন্য পাঠককে একটি ফরম পূরণ করতে হয়, যার মধ্যে পাঠকের ব্যক্তিগত তথ্যসহ ধার নেওয়ার শর্তাবলী ও নিয়মনীতি উল্লেখ করা আছে। এই ফরম পূরণ করার পর ২০ রিয়াল মূল্যে তাকে একটি কার্ড প্রদান করা হবে, যার মেয়াদ ১ বছর। আর এই মূল্য ছাত্রের জন্য অর্ধেক। প্রতিটি কিতাব ধার নেওয়ার সময় জমানতস্বরূপ ১০০ রিয়াল জমা রাখতে হয়, যা কিতাব ফেরত দেওয়ার সময় পাঠককে ফেরত দেওয়া হয়। ধার নিয়ে বই ফেরত দেওয়ার সময় ১৪ দিন। প্রয়োজনে সময় শেষ হলে নবায়ন করারও সুবিধা আছে। মূলত এসব নীতি ও শর্ত গ্রন্থাগারের সুবিধার জন্য করা হয়ে থাকে। কারণ অনেক পাঠক মূল্যবান কিতাব ধার নিয়ে তা ফেরত দেওয়ার কথা ভুলে যায়। যার কারণে গ্রন্থাগারের অনেক ক্ষতি হয়, সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অসংখ্য পাঠকও।
ফটোকপি : পাঠক বা গবেষকগণ কখনো কখনো অধ্যয়নের মাঝে প্রয়োজনীয় কোনো অংশ ফটোকপি করতে চান। কখনো সাধারণ বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে গ্রন্থটি না পাওয়া গেলে পুরো গ্রন্থটি ফটোকপি করতে চান। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ ভিতরেই ফটোকপির ব্যবস্থা রেখেছেন, যা কখনো বিনামূল্যে আবার কখনো ন্যায্য মূল্যে সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়াও নিয়মিত পাঠকদেরকে গ্রন্থাগারের গ্রন্থ তালিকাসহ নতুন আসা গ্রন্থ সম্পর্কে অবহিত করা হয় এবং সাধারণ জনগণের মাঝে অধ্যয়নমুখিতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। সেই প্রেক্ষাপটে মাঝে মাঝে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ তাদের সেবাসমূহ আরও ব্যাপক করার জন্য সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষত গ্রন্থ সংগ্রহের ব্যাপারে বর্তমানে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
শেষ কথা :
আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রত্যেক থানা শহরেই গড়ে উঠেছে সাধারণ পাঠাগার। এতে করে মানুষ বিভিন্ন বিষয় চর্চার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু ইসলামী সভ্যতা সংস্কৃতি চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে ইলম ও আমল শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা কি এ ধরনের গ্রন্থাগার তৈরি করতে পেরেছি? যেখানে সর্বসাধারণ এবং মুসলিম-অমুসলিম সকলের রুচির প্রতি লক্ষ রেখে বই সংগ্রহ করা হবে?
সাধারণ মানুষের মাঝে ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হবে, যার মাধ্যমে সকলের কাছে ইসলামের সুমহান বার্তা পৌঁছে যাবে। সকলেই বিভিন্ন ফিতনামুক্ত জীবনযাপন করবে। তালিবুল ইলমসহ ইসলামী সুধীসমাজ এ বিষয়টি নিয়ে একটু ভাববেন- এটাই আমার প্রত্যাশা। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সকল ধরনের ভালো ও মহৎ কাজে অংশগ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আপনার মন্তব্য লিখুন