মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের ব্রেইনকে এমন ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে তৈরি করেছেন, যার ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্র ও বিভাগে বিশেষ অবস্থান নিশ্চিত করতে এবং অন্তত সকল বিষয়ে ওয়াকিবহাল হতে আমরা তৎপর হই। যে ব্যক্তি যতো বেশি ব্যাপৃত জ্ঞানের অধিকারী হতে চান, তার চিন্তার জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সংযোগ ততো বেশি রাখতে হয়। অর্থাৎ, নির্ধারিত বিষয়ের বাইরে উক্ত ব্যক্তির চিন্তার বিচরণ রাখলে মূল্য উদ্দেশ্য হাসিলে বাধা আসে। যার ফলাফল হিসেবে উদ্দেশ্য হাসিলে বাধার পাশাপাশি শর্টটাইম মেমোরিলস পরিলক্ষিত হয়।
ইদানীং শর্টটাইম মেমোরিলস নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ ও যুবসমাজকে নিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা বেশি। আলোচনাটা এরকম যে, বর্তমান সময়ের তরুণ-যুবকরা বিস্তৃত জ্ঞানের নানা দিক-বিভাগে বিচরণ করতে পারছে না। একজন ছাত্র একই সাথে সংশ্লিষ্ট নির্ধারিত একাডেমিক বিষয়াদির বাইরে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতে চাইছে না বা পারছে না। এককেন্দ্রিকতা যেন পেয়ে বসেছে তাকে।
এ তো গেলো জ্ঞানার্জনের বিষয়। এবার আমরা জ্ঞানের প্রয়োগের দিকে যদি তাকাই, তাহলেও বর্তমান তরুণ-যুবকদের অংশগ্রহণ কম দেখতে পাবো। বিশেষ করে আচরণগত এবং সহনশীলতার ব্যাপারে বেশ মানগত বৈপরীত্য দেখা যাচ্ছে। যে ছাত্র যতো শিক্ষিত হবে, তার ততো বেশি এসব দিকে অ্যাডভান্স হতে দেখা যাওয়ার কথা। অর্থাৎ, শিক্ষার্থীর জীবনে শিক্ষার স্তর বৃদ্ধির সাথে সাথে তার চিন্তার জগৎ এবং মানবিক দিক এতোটাই বিকশিত হওয়ার কথা যে, সবসময় সবকিছুর সাথে নিজেকে অকৃত্রিমভাবে মানিয়ে নিয়ে চলা এবং জীবনের এই অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজ-রাষ্ট্রকে সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে নেওয়ার প্রবণতা নিয়মিত হতে থাকবে। কিন্তু তা হচ্ছে না।
এই অবস্থায় যদি বছর গড়াতে থাকে এবং যুগের পরিবর্তন হয়, তাহলে বিশ্বব্যবস্থায় আমরা একটি পিছিয়ে পড়া জাতি-গোষ্ঠীতে পরিণত হবো, এটা বলতে বা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে কারো দ্বিধা থাকার কথা নয়। কারণ, আমাদের স্বকীয়তার পরিবর্তে সকল ক্ষেত্রে ধার করার মানসিকতা বৃদ্ধি পাবে। নতুন কিছুর উদ্ভাবন বা আবিষ্কারের পরিবর্তে বর্তমান নিয়ে মেতে থাকা অনিবার্য হয়ে পড়বে। আজকের আলোচনা এই বিষয়কে সামনে রেখেই। আমাদের এমন পরিণতি কেন দেখতে হচ্ছে এবং কিভাবে এখান থেকে বেরোনো যায়, তা নিয়ে কিছু কথা তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ।
বর্তমান সমাজ ও
রাষ্ট্র পরিস্থিতির হালচাল
বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমগুলো একটু ধারাবাহিকভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করলে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার যে, সমাজে কে কী করছে বা করবে, তা নিয়ে খুব মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। কারণ কেউ কাউকে মানতে চায় না বা কারো গাইডলাইন কেউ ফলো করতে চায় না। বিশেষ করে এসব ক্ষেত্রে বর্তমান প্রজন্ম নিজেকে বেশ বিজ্ঞ/অভিজ্ঞ মনে করে থাকে অথবা বর্তমান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনভিজ্ঞ-ব্যাকডেটেড মনে করে। মোটকথা খুব ভেবেচিন্তে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে প্রবণতা আমাদের সমাজে ছিলো, তার বিরাট ঘাটতি চলছে। যার কারণে খুব বেশি ভুল করতে দেখা যায় ইদানীং। সাধারণতই যেসকল ভুল পথগুলো এবং বিশেষ করে অন্যায় কাজগুলোর ব্যাপারে তার সতর্কতা থাকার কথা, তা থাকছে না। শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত বিষয়ে ৩/৪/৫ বছর ধরে পড়াশোনা করছে, কিন্তু না তার ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে, না কর্মজীবনে।
- বুয়েট-মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করে পুলিশ হচ্ছে বা সিভিল প্রশাসনে যোগ দিচ্ছে।
- বিএ-এমএ/অনার্স-মাস্টার্স পাস করছে কিন্তু কমন নলেজ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। সমাজের অন্যান্য নিয়মিত কম মেধাবী ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর মতো কথাবার্তা-আচরণ।
- একজন শিক্ষিত হিসেবে সমাজে কোনো অবদান রাখার পরিবর্তে সমাজের মৌলিক মানবীয় গুণাবলি হ্রাসে ভূমিকা রাখা।
- ঝগড়াবিবাদ এমনকি হত্যাকাণ্ডের মতো ন্যক্কারজনক কাজের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়া।
- অন্যায় দেখে সয়ে যাওয়ার মানসিকতা।
- পরবর্তী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় ব্যক্তি হতে না পারা। বিশেষ করে ক্যারিয়ার অথবা চরিত্রগত দিকে অথবা উভয় বিষয়ে নির্মলতা ও নিষ্কলুষতার পরিবর্তে এমন ভুল ও অন্যায় করা, যা সমাজে দুঃখজনক নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া।
- সমাজের সিনিয়র ব্যক্তিদের মানসিকতার মধ্যে এমন মনোভাব সৃষ্টি হওয়া যে, কিছু ভুল কিছু অন্যায় জীবনে থাকবে, এটা সাথে করেই চলতে হবে। যেমন, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা-প্রেমপ্রীতিকে অন্যায় মনে না করা, কিছু মিথ্যার সাথে জড়িয়ে যাওয়া জীবনে ঘটতেই পারে, সুদ-ঘুষ যেহেতু প্রচলিত বিষয় তাই কেউ জড়িয়ে যেতেই পারে, ধর্মীয় নির্দেশনা পুরোপুরি না-ই মানতে পারে ইত্যাদি।
উপরোক্ত এসব বিষয়গুলো যেন সমাজে না ঘটতে পারে, তার জন্য সতর্কতামূলক পদক্ষেপ এবং নজরদারি রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু আমাদের দেশ এর ব্যতিক্রম এবং উল্টো। সমাজে এরকম অন্যায় ও ভুল বৃদ্ধির উদ্যোগ রাষ্ট্রীয়ভাবে নেওয়া হয়। যেমন:
- শিক্ষা কারিকুলাম এবং পাঠদানকে এমনভাবে সঙ্কুচিত করা হয়েছে যে, শিক্ষাকে একশ্রেণির ব্যক্তি পণ্য হিসেবে গ্রহণ করে ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছে; ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচার করছে না।
- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ উন্নত নৈতিকতার আবহে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য নিত্যনতুন উদ্যোগ নেওয়ার কথা, তা না করে মুক্ত চর্চার নামে অনৈতিকতার চর্চা বৃদ্ধির পথ সুগম করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক যেমন মধুর ও শ্রদ্ধার হওয়ার কথা ছিলো, তা না হয়ে বন্ধু বা ইয়ার-দোস্তের মতো হয়ে যাচ্ছে; একসাথে নাচ-গান, মদ্যপানের মতো জঘন্য কাজের সাথে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
- সাংস্কৃতিক কিছু বাহনকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, অশ্লীলতা-বেহায়াপনা এবং উলঙ্গপনার বিষয়টি খুব একটা অন্যায় হিসেবে তো নয়ই বরং এসব যৌক্তিক এবং বাস্তবতা হিসেবে মানুষ মেনে নিচ্ছে। সন্তান এসব অন্যায়ে লিপ্ত হলেও বাবা-মা কিছু বলছেন না, কারণ তারাও এরকম জীবনাচারে লিপ্ত।
- সমাজের নেতৃস্থানীয়রা পরবর্তীদের জন্য নৈতিকতার দিক থেকে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হতে পারছেন না। বরং তারা যেভাবে অসাধু কাজের সাথে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তাদের অনুজদেরকেও সেভাবে চলতে উপদেশ দিচ্ছে। চাঁদাবাজ-টেন্ডারবাজ, জোচ্চোর-ধর্ষকদের অধীনস্থরা একইরকম চরিত্র ধারণ করবে এটাই স্বাভাবিক।
- একজন মানুষ যেন অন্য মানুষের উপকারে আসতে না পারে, তার মনিটরিং করা হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে।
- সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার তো দূরের কথা, সম্পদ কুক্ষিগত করার নজির স্থাপনকারীও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায় অনায়সে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। রাষ্ট্রের চতুর্থ শ্রেণির চাকরিজীবীরা কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে এবং তার রিপোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশন পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে, কিন্তু কোনো কেয়ার নেই কারো।
- রাষ্ট্রীয় সেবাদানে নিয়োজিত ব্যক্তিরা অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সম্প্রতি একজন রাষ্ট্রীয় বড় কর্মকর্তা বিদেশী হাইকমিশনে কর্মরত অবস্থায় নিয়মিত মাদক সেবন এবং লিভটুগেদারে লিপ্ত হলেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছেন, এ নিয়ে তাদের কিছু করার নেই।
এরকম নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র। এই পরিস্থিতি যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে আমাদের একথা বলতে আর কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তির খুব গবেষণা করতে হবে না যে, একটি জাতি নৈতিক মানদণ্ডে দুর্বল এবং পরাধীন গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হবে। শুধু তা-ই নয়, এখান থেকে উদ্ধার বা নিষ্কৃতি পাওয়া অনেক দুরূহ একটি বিষয়ে পরিণত হবে।
এই পরিস্থিতির জন্য বর্তমান প্রজন্মের দায়
আমরা অনেকেই মনে করি, দেশের এই নাজুক সংস্কৃতির জন্য একমাত্র সমাজের নেতৃস্থানীয়রাই দায়ী। রাষ্ট্রকাঠামোতে নিয়োজিত ব্যক্তিরাই দায়ী। সরকারব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাই দায়ী। এক্ষেত্রে বলবো যে, নেতৃস্থানীয়, রাষ্ট্রকাঠামোতে নিয়োজিত এবং সরকারব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের এসব অন্যায়-অনাচার সয়ে যাওয়া এবং প্রতিবাদে দীর্ঘমেয়াদি কোনো উদ্যোগ না রেখে চলার অপরাধে আমরা যারা শিক্ষা গ্রহণকারী, তারাই সবচেয়ে বেশি দায়ী। কারণ, আমাদের এই উদাসীনতা এই পরিস্থিতিকে আরো দীর্ঘায়িত করছে এবং করবে।
মানুষকে নিয়ে মহান আল্লাহর সাথে শয়তানের যে চ্যালেঞ্জ, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আল্লাহ মানুষকেই দায়িত্ব দিয়েছেন। আজ যদি আমরা আল্লাহর দেওয়া সেই দায়িত্ব ভুলে যাই, তাহলে শয়তানের ফাঁদে আটকে জীবনের ধ্বংস করার কাজকে নিজ ক্রিয়েটিভিটি বলে বেছে নেওয়া হয়ে যায়।
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন প্রতিনিধি হিসেবে। প্রতিনিধি হিসেবে একজন বান্দা সবচেয়ে বড় যে দায়িত্ব নিয়ে এসেছে তা হলো, আল্লাহর জমিনে তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজের বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে, মানুষের জীবনে কল্যাণ সাধন করা। প্রথমত নিজেকে আল্লাহর দেখানো পথে চলার জন্য প্রস্তুত করা। তারপর নিজ পরিধির মধ্যে থাকা মানুষদের জন্য কাজ করা। এই পরিধি নিজ নিজ সাধ্যের মধ্যে ব্যাপৃত। যেমন, রাসূল সা. গোটা বিশ্বমানবতার জন্য দায়িত্বরত ছিলেন। সাহাবাগণ যখন ইসলামী রাষ্ট্রকাঠামোর অধীনে দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন কেউ নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নিয়ে কাজ করেছেন, কেউ নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন বিশ্বব্যাপী দায়িত্ববোধ নিয়ে। আসলে একটি সাংগঠনিক সিস্টেম ধরে ধরে সাহাবায়ে কেরাম দ্বীন বিজয়ের জন্য কাজ করেছেন।
আমরা যারা বর্তমান প্রজন্মের তরুণ-যুবক, তাদের পক্ষে নিজেকে আল্লাহর বান্দার বাইরে ভাববার সুযোগ নেই। আর আল্লাহর বান্দা মানেই শেষ কিতাব আল কুরআনের বিধানের আলোকে আমাদের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত। এর বাইরেও যাওয়ার সুযোগ নেই। এই নির্ধারিত গতিপ্রকৃতি মানে মহান আল্লাহ আমাকে ছোট কোনো খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতে বলেছেন, এমন নয়। বরং বিশ্বব্যাপী আমার চারণভূমি। বিশাল এই কর্মক্ষেত্র পরিচালনার মূল দায়িত্বশীলতা অবশ্যই সক্ষম ও দক্ষদের জন্য। যারা তাদের সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কুরআনিক ফরম্যাট ফলো করে পথ চলবে। বিশেষ করে আমরা যারা নিজেদের সক্ষমতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির পথে হাঁটছি, তাদের তথা শিক্ষার্থীদের এটা কমন প্রবণতা হওয়ার কথা।
একজন শিক্ষার্থীর করণীয়
উপরের আলোচনার ধারাবাহিকতায় আমরা একজন জ্ঞান অন্বেষণকারী হিসেবে কিছু মৌলিক দিক নির্দেশনা পেলাম। যে দিকনির্দেশনার মধ্যে কাজের গণ্ডি, কাজের পদ্ধতি ও পলিসির কথা বলেছি আমরা। আমরা যদি এর সামারি করি, তাহলে যা পাই, তা হলো:
বিশ্ব ব্যাপী আমাদের চারণভূমি। অতঃপর আমরা আল্লাহর নির্দেশে রাসূল সা.-এর পলিসি হিসেবে সাংগঠনিক একটি সিস্টেম পাই। যার পরিধি বিভিন্ন দিক বিভাগে সুবিন্যস্ত ছিলো। তার অনুসরণ-অনুকরণ আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
মহান আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব ও শয়তানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাসূলুল্লাহ সা.-এর পদ্ধতি মানেই সক্ষমতা ও দক্ষতা হাসিলের পথে হাঁটা বাধ্যতামূলক। কারণ, এই দায়িত্ব পালনকারীকে মধ্যমপন্থী হিসেবে অপরাপর সকল মানুষকে সহনশীলতা, উদারতা, মানবিকতা, বিচক্ষণতা ও পরিপক্বতা দিয়ে পথনির্দেশ করতে হবে।
সহনশীলতা, উদারতা, মানবিকতা, বিচক্ষণতা ও পরিপক্বতা অর্জনের জন্য জ্ঞান-বুদ্ধির রাজ্যে বিচরণ করা। এজন্য আমাদের জন্য প্রধান দুটো সোর্স হচ্ছে আল কুরআন ও আস সুন্নাহ; তার নিবিড় সান্নিধ্যে আসা।
আল কুরআন ও আস সুন্নাহর নিবিড় সান্নিধ্য মানে কুরআন-সুন্নাহর মূল আলোচনা যাদের জন্য তাদের (মানুষের) কাছে যাওয়া তথা কুরআনের ময়দানে অবস্থান করা। আল কুরআনের ময়দানে অবস্থান করতে গিয়ে সাহাবায়ে আজমাঈন যেমন প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন, প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন, তেমন করে নিজেকে নিয়োজিত রাখা।
কুরআন-সুন্নাহর সাথে সম্পৃক্ত না থাকতে পারার কারণ
এই পৃথিবীতে আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিস সালামের মাধ্যমে মানুষের জন্য যতোবার আল্লাহ জীবনবিধান অবতীর্ণ করেছেন, ততোবার মানুষের বড় অংশই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা যদি বর্তমান বিশে^র দিকে তাকাই তা আরো স্পষ্ট হবে। প্রথমত বিশ্বের প্রায় ৭০০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র ২০০ কোটি মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী। এই ২০০ কোটির মধ্যেও আল্লাহ এবং রাসূল সা.-এর আনুগত্যকারী কুরআন-সুন্নাহর পথে চলা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। এর বড় কারণ তিনটি:
- আল কুরআনের জ্ঞানকে সীমাবদ্ধ জ্ঞান মনে করা এবং জ্ঞানের প্রধান সোর্স মনে না করা।
- কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উদাসীন থাকা।
- নিবিড়ভাবে কুরআন-সুন্নাহর ময়দানে নিজেকে নিয়োজিত না রাখা এবং কুরআন-সুন্নাহর বাইরের অবাঞ্ছিত বিষয়াদি থেকে নিজকে দূরে না রাখা।
এই তিনটি বিষয়ের ক্ষেত্রে আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে অবাঞ্ছিত জীবনধারা। শয়তানের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় নিজেকে দুর্বলভাবে ময়দানে রাখার কারণে এই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা ঘটছে। যার কারণে আমরা এমন এক ফাঁদে আটকে যাচ্ছি যেখানে থেকে চাইলেও আমরা কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করে সহনশীলতা, উদারতা, মানবিকতা, বিচক্ষণতা ও পরিপক্বতা অর্জনের পথে এগোতে পারছি না।
অবাঞ্ছিত জীবনধারার স্বরূপ
অবাঞ্ছিত জীবন বলতে নীতিহীন ও উদ্দেশ্যবিহীন জীবন। নীতিহীন জীবন বলতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধিনিষেধ আরোপ সংবলিত কঠোর নির্দেশ রয়েছে এমন জীবনাচার। বিষয়টি হালাল হারামের সাথে সম্পর্কিত। মদ্যপান একটি জঘন্য হারাম কাজ। তাই মদ্যপান করে নামাজের মতো মৌলিক ইবাদতে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই। আর নামাজের মতো মৌলিক ইবাদত থেকে দূরে থাকা মানে আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী বান্দা অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকতে পারবে না। অন্যায়-অশ্লীলতা থেকে যে ব্যক্তি দূরে থাকতে পারবে না, তার পক্ষে ন্যায়ের পক্ষে কাজ করা অসম্ভব। বিশেষ করে মহান আল্লাহ যেসকল ন্যায় কাজ ন্যায়ানুগ পন্থায় করতে বলেছেন।
উদ্দেশ্যবিহীন কাজের মূল অংশ হচ্ছে আল্লাহর আদেশকৃত কাজ থেকে দূরে থাকা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিপরীতধর্মী কাজ করা। আর অপর অংশ হচ্ছে আল্লাহর আদেশকৃত এবং নিষেধকৃত কাজের বাইরে এমন কাজ যা আদেশকৃত কাজকে বাধাগ্রস্ত করে এবং নিষেধকৃত কাজের উৎকর্ষ সাধন করে। বিষয়টি এমন যে, আমি সারাদিন সামাজিক কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে থাকতে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায়ের সময় পেলাম না। এদিকে যে সামাজিক কাজটিতে লিপ্ত থাকলাম, তা হলো একটি প্রচলিত ধারার বিবাহ অনুষ্ঠান, যেখানে গান-বাজনা ও পর্দাহীনতার অমুসলিম সংস্কৃতি চর্চার সয়লাব। বস্তুত এই অনুষ্ঠানে লিপ্ত থেকে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলাম।
বর্তমান সময়ের তরুণ ও যুবকদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় অহেতুক সময়দান অবাঞ্ছিত জীবনধারা চর্চার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে বিচরণকালে তিনটি বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে, তা আমরা অনেক সময় অনেকেই বুঝতে পারছি না।
- সময় অপচয়। একজন ব্যবহারকারীর সামনে একসাথে হাজার হাজার একটিভ দর্শক-শ্রোতা (অডিয়্যান্স) সবসময় হাজির থাকছে। আসলেই এতো মানুষের সাথে একসাথে যুক্ত থাকার দরকার আছে কিনা, তার বাছবিচার না করেই যোগাযোগ করছি, সময় পার করছি। অগণন মিনিট-ঘণ্টা চলে যাচ্ছে আমরা টের-ই পাচ্ছি না।
- আসক্তি। এখানকার প্রতিটি উপাদান (কন্টেন্ট) দর্শক-শ্রোতাদের জন্য আকর্ষণীয়। কন্টেন্ট নির্মাতাদের টার্গেটই থাকে আকৃষ্ট করা। আমরা যখন এখানে উদ্দেশ্যহীনভাবে বিচরণ করি (স্ক্রল করি) তখন আকর্ষণীয় উপকরণ দেখতে অভ্যস্ততা চলে আসে। পাশাপাশি অন্তর ব্রেইনকে কোন কোন উপকরণে বেশি আকর্ষণবোধে উদ্বুদ্ধ করে, তার সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা তো আছেই। ফলে আমরা এখান থেকে চাইলেই আর বেরোতে পারি না। সেই সাথে এসব আকর্ষণীয় উপকরণের বিপরীতে মৌলিক দায়িত্ব সংক্রান্ত বিষয়াদি তুলনামূলকভাবে ফিতরাতগত কারণেই কম আকর্ষণীয়।
- নৈতিক অবক্ষয়। আকর্ষণীয় উপাদানের একটি ফিতরাত হচ্ছে দুনিয়ামুখিতা। আর দুনিয়ামুখিতার বড় ক্ষেত্র অনৈতিকতা। অনৈতিকতার সাথে সেসব ব্রেইন সম্পৃক্ত হয়, যারা অহেতুক কাজ বেশি করে। তার মানে, সময় অপচয়কারী আসক্ত অন্তরের শেষ পরিণতি নৈতিক অবক্ষয়।
- শর্টটাইম মেমোরিলস। আমরা যেহেতু অস্থায়ী বিষয়ের সাথে বেশি সম্পৃক্ত থাকছি, যার কারণে স্থায়ী বিষয়গুলো থেকে আমাদের ব্রেইন অটোমেটিক দূরে থাকছে। স্বাভাবিকভাবেই কোনো কিছু মনে রাখার প্রয়োজন পড়ছে না। হাতের নাগালেই সব পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অযথা কাজগুলো যেখানে হয়, সেখানকার নির্ধারিত আকর্ষণীয় ও আসক্তির উপাদান-উপকরণগুলো সব একসাথেই থাকে। এসবে দিন দিন অভ্যস্ততা এসে গেলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কেও তাৎক্ষণিক আমরা ভুলে যাই।
আসলে মহান আল্লাহ আমাদের পরীক্ষার জন্য এসব অবাঞ্ছিত উপকরণ সামনে আনেন এবং দেখেন যে, আমরা দুনিয়ার এসব উপকরণকে বেশি গুরুত্ব দিই নাকি তিনি যা করতে বলেছেন, তাকে।
অবাঞ্ছিত জীবনধারা থেকে দূরে থাকতে না-পারার কারণ
এই জীবনাচার থেকে দূরে থাকতে না-পারার সবচেয়ে বড় কারণ হলো আল্লাহ প্রদত্ত খিলাফতের দায়িত্ব ভুলে শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করা। এর সাথে যে বিষয়গুলো এই পথে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করছে, তা হলো:
- দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে না পারা এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিলম্ব করা।
- আখিরাতের জীবন বলে কিছু একটা আছে, এ ব্যাপারে উদাসীন থাকা এবং সন্দেহ পোষণ করা। বিপরীতে দুনিয়াকেই মূল জীবন মনে করা।
- বন্ধু নির্বাচনে ভুল করা এবং নিজের ভালো গুণ দ্বারা বন্ধুকে প্রভাবিত করার পরিবর্তে বন্ধুর অসৎ গুণে প্রভাবিত হয়ে পড়া।
- সোশ্যাল মিডিয়ার মতো বিরাট বড় ক্ষেত্রে বিচরণ করতে করতে চিন্তার পরিধি যে সঙ্কীর্ণ হচ্ছে এবং বাস্তবজগৎ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে, তা ধরতে না পারা।
- বাস্তবজগতে বিচরণ কম থাকায় দিন দিন শারীরিক ও মানসিক অলসতার প্রভাব।
শেষকথা
মানুষের কর্মপরিধি যেহেতু বিশ্বজুড়ে। সেহেতু মানুষকে মহান রবের দেওয়া সেই কর্মপরিধি সম্পর্কে সচেতন থেকে উদ্যমী উদ্যোগী হওয়া অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে চিন্তার জগৎকে সঙ্কীর্ণ করা থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি। একজন তরুণ-যুবকের দায়িত্ব অনেক বিশাল। বিস্তৃত দুনিয়ার সকল মানুষ আল্লাহর খিলাফতের অধীনে। তাই খিলাফতের দায়িত্ব পালনকারী তরুণ-যুবককে এই পথে উদ্যমী সদা চঞ্চল থাকতে হলে এ বিষয়ে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হতে হবে। এজন্য কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাপক অধ্যয়ন প্রয়োজন। মুমিনের মূল আসক্তির জায়গা হওয়া প্রয়োজন খিলাফতের দায়িত্ব পালন ও দায়িত্ব পালনের জন্য নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রস্তুত করা।
লেখক : কেন্দ্রীয় সভাপতি
আপনার মন্তব্য লিখুন