post

যে স্মৃতি বেদনা ও প্রেরণার

আলী আহমাদ মাবরুর

২৩ ডিসেম্বর ২০২৩

বহুদিন পর একটু অবসর পেয়ে সেদিন ঘর গোছানোর কাজে হাত দিয়ছিলাম। কাপড় রাখার ওয়ারড্রবটি পরিষ্কার করতে গিয়ে শক্ত কাগজের একটি প্যাকেটের প্রতি দৃষ্টি আটকে গেল। খুলে দেখলাম খুব যত্ন করে প্যাকেটে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে আমার ২৮ অক্টোবরের স্মৃতি অর্থাৎ ছিন্ন ভিন্ন চকলেট রঙের প্যান্ট। বুঝতে বাকি রইল না কাজটি কার। ৩ বছর পূর্বেকার একটি রাতের কথা মনে পড়লো, তখন প্রায় ১১টা। নির্জন রাতে রাজপথের কোল ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিলছিলাম, সাথে সদ্য পরিচিতা একজন নারী, ২ দিন পূর্বে যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। চলতে চলতে সাংগঠনিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কথা ও প্রশ্নোত্তর চলছিল, হচ্ছিল অনেক স্বপ্ন, প্রত্যাশা ও প্রতিজ্ঞার কথা। হঠাৎ করেই আমি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা আমি যদি শহীদ হয়ে যাই তুমি কী করবে? বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হলেও কোন জবাব পেলাম না, বুঝলাম এ সরাসরি প্রশ্ন ঠিক হয়নি। পরক্ষণে কিছুটা সংশোধন করে বললাম, আচ্ছা তুমি কি শহীদের স্ত্রী হওয়া পছন্দ করবে, না শহীদের মা? এবারো সহসা জবাব পেলাম না। পরিবেশটা অকস্মাৎ ভারী হয়ে গেল। আমি কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না, ভাবনা থেকে উদ্ধার করলো সে নিজেই। ভারী অথচ দৃপ্তকণ্ঠে বললো- প্রথমত, আমি নিজেই শহীদ হতে চাই আর দ্বিতীয়ত, আমার চাওয়া শহীদের মা হওয়া, কোনভাবেই আমি শহীদের স্ত্রী হতে চাই না। পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য আমি রাতের নির্জনতা ভেঙে হো হো করে হেসে উঠলাম। ২৮ অক্টোবরে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি ২৮ অক্টোবরের স্মৃতি কলম দিয়ে বর্ণনা করা খুবই কষ্টকর। কিন্তু শিবিরের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক জীবন্ত শহীদ প্রিয়ভাই জাহেদুল ইসলামের পীড়াপীড়িতে এ কষ্টদায়ক কাজটিতে হাত দিতে আমাকে বাধ্য হতে হলো। যতদূর মনে পড়ে, আমার স্নেহময়ী মায়ের সাথে ঈদ শেষ করে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৭ অক্টোবর বিকেলে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছলাম। ঢাকায় পৌঁছাবার পর সকল ওয়ার্ড দায়িত্বশীলের সাথে ফোনে কথা হলো পরদিনের বায়তুল মোকাররমের সমাবেশের প্রস্তুতি সম্পর্কে। বেশির ভাগ ভাই-ই বলছিলেন, এখনো তাদের অধিকাংশ জনশক্তি বাড়ি থেকে ফেরেনি। উপস্থিতির যে টার্গেট তাদের দেয়া হয়েছে তা পূরণ করা খুবই কঠিন। থানা আমীর শ্রদ্ধাভাজন হেমায়েত ভাই উপস্থিতি নিয়ে খুব টেনশন করছিলেন। চারদিক থেকে আওয়ামী লীগের মারমুখী প্রস্তুতির খবর তার কাছে আসছিলো। মহানগরী সংগঠন থেকে আমাদের জানানো হলো  বেলা ২টার মধ্যে সকল জনশক্তি নিয়ে বায়তুল মোকাররম পৌঁছাতে হবে। ২৮ অক্টোবর সকালে ঘুম থেকে জাগতে গিয়ে পিঠে খুব ব্যথা অনুভব করলাম। নামাজ ও কুরআন তেলাওয়াত শেষ করে আবার মোবাইল ফোন নিয়ে ওয়ার্ড দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলতে বসবো, ঠিক তখনই মহানগরী সেক্রেটারি হামিদ ভাইয়ের ফোন এলো। তিনি জানালেন পরিস্থিতি সুবিধার মনে হচ্ছে না, কিছু দায়িত্বশীল ভাইসহ এখনই যাতে আমরা মহানগরী অফিসে চলে যাই। তার নির্দেশ পেয়ে তৎক্ষণাৎ ধানমন্ডি থানার ৫১ নং ওয়ার্ড সভাপতি এমদাদ ভাই ও ৪৯ (পশ্চিম) সভাপতি হান্নান ভাইকে ফোনে জানালাম, তারা যাতে ১০ জন করে জনশক্তি নিয়ে সকাল ৭টার মধ্যে মহানগরী অফিসে পৌঁছে যান। থানা আমীর হেমায়েত ভাইকে জানিয়ে আমি সাথে সাথে পল্টন অভিমুখে রওনা হয়ে গেলাম। রাস্তায় নেমে ১০-১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে রিকশা ছাড়া আর কোন যান চোখে পড়লো না। রিকশা ড্রাইভার কেউই পল্টনের দিকে যেতে রাজি হলো না। টাকা বাড়িয়ে দেয়ার কথা বললে একজন ড্রাইভার বললো, স্যার জীবন বাঁচলে তো টাকার দাম, জীবনই যদি না থাকে টাকা দিয়ে কী হবে? বুঝতে পারলাম আজ সত্যি সত্যিই এক কঠিন দিন আমাদের জন্য। দ্বিগুণ ভাড়ায় অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত একটি রিকশা ঠিক করলাম। পথে যেতে বিভিন্ন মোড় ও মহল্লায় লগি, বৈঠার ব্যাপক প্রস্তুতি লক্ষ্য করলাম। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না ঢাকার অন্যান্য থানা ও অঞ্চল থেকে আমাদের ভাইয়েরা কিভাবে বিকেলে সমাবেশে এসে পৌঁছবেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগের যে মারমুখী অবস্থান তাতে সমাবেশে আসার পথেই বিভিন্ন জায়গায় সংঘাত শুরু হয়ে যেতে পারে। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই পুরানা পল্টন এসে পৌঁছলাম। কামারুজ্জামান ভাই, শ্রদ্ধেয় মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ কেন্দ্রীয় ও মহানগর পর্যায়ের অনেক নেতৃবৃন্দ মহানগরী অফিসে চলে এসেছেন। সবার সঙ্গে এক সাথে নাশতা সেরে ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সম্মুখে স্থাপিত মঞ্চ দেখতে গেলাম। পায়ের ব্যথায় আমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। মঞ্চের আশপাশে প্রায় তিনশতাধিক স্বেচ্ছাসেবক। এমদাদ ভাই, নূর মোহাম্মদ ভাইসহ আমাদের থানার জনশক্তিদের সাথে দেখা হলো। সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আমার প্রিয় দায়িত্বশীল হালিম ভাই আমাকে মঞ্চে ডেকে নিলেন, আমার শারীরিক অবস্থা দেখে বললেন, এখানে শুয়ে থাকুন, বেশি হাঁটাহাঁটির দরকার নেই। আমি মঞ্চে বেশিক্ষণ না থেকে শিবিরের কেন্দ্রীয় অফিসে চলে  গেলাম। মহানগরী শিবিরের একজন দায়িত্বশীল আমাকে একটি ভলটারিন সাপোজিটরি এনে দিলেন। আমি একটা ডোজ নিয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতির বিশ্রাম কক্ষে শুয়ে থাকলাম। সকাল সাড়ে ১০টায় ব্যথা অনেকটা উপশম হয়ে এলে কেন্দ্রীয় সভাপতির চেম্বারে পরিষদের অনেক ভাইসহ অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে মিলিত হলাম। সারাদেশ থেকে একের পর এক হামলা ও সংঘর্ষের খবর আসতে লাগলো। ভাই শফিকুল ইসলাম মাসুদ ফোনে সবাইকে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিচ্ছেলেন। পরিস্থিতি অনুধাবন করে কারোই বুঝতে বাকি রইল না এক কঠিন পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পুরো দেশ। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ঘড়িতে সম্ভবত তখন সাড়ে ১০টা কী ১১টা বাজে। পল্টন মোড় থেকে ফোন এলো আওয়ামী লীগের একটি মিছিল বিজয় নগরের গলির মুখে আমাদের ভাইদের ওপর হামলা করেছে। আমরা আর বসে থাকতে পারলাম না। সবাই দ্রুততার সাথে নিচে নামলাম। নিচে নেমেই দেখলাম কয়েকজন ভাই রক্তাক্ত অবস্থায় অফিসের দিকে আসছেন। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ! রক্তে ভেসে যাওয়া একজন চিৎকার দিয়ে বলছিল, আমাদের ভাইয়েরা খালি হাতে অসহায়ভাবে মার খাচ্ছে। সামনে যতই এগুচ্ছিলাম, একের পর এক আহত ভাইদের দেখে অবাক হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে একদল মানুষের ওপর দিয়ে যেন অকস্মাৎ রক্তঝড় বয়ে গেছে। তাই এদের সবার হাত, পা ও মাথায় রক্তের আলপনা। কয়েকজন আহত ভাই এসে বললো, পল্টন মোড়ের পূর্ব দিক থেকে এসে আওয়ামী লীগের বিশাল এক মিছিল আমাদের ওপর আঘাত করেছে। উত্তর-দক্ষিণের রাস্তাও তাদের দখলে। মাথায় আর কোন কিছুই কাজ করছিলো না, যাদের মাথা আর বুক রক্তরাঙা তাদের যেন কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। সবার সামনে শাহাদাতের মোহনীয় স্বপ্ন। বাতিলের সাথে সরাসরি লড়াই করার সৌভাগ্য মহান আল্লাহ তার এ দুর্বল ও অক্ষম বান্দাকে বহুবার দিয়েছেন। নাগরিকত্ব লাভের পর অধ্যাপক গোলাম আযমের প্রথম প্রকাশ্য জনসভা অনুষ্ঠানের ঐতিহাসিক ২৬ জুলাই ঘটনার একটি স্পটে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চোখের সামনেই গুলিবিদ্ধ ভাইদের লুটিয়ে পড়া, রক্তস্রোতে গড়াগড়ির দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল এটা আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। এটাই বাংলার বদর প্রান্তর। শাহাদাতের সৌভাগ্য সেদিনও খুব কাছ থেকে ফসকে গেছে। কিন্তু আজকের পল্টন ময়দানকে কী বলা যায়? বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনের জন্য যে এটা অস্তিত্বের প্রশ্ন? আওয়ামী লীগের যে প্রস্তুতি ও মনোভাব, তাতে মনে হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে সারাদেশের ইসলামী আন্দোলন তারা নিশ্চিহ্ন করতে চায়। এগুলো ভাবতে গিয়ে শরীরের সমস্ত শিরদাঁড়ায় এক উষ্ণ স্রোত বয়ে যায়। আর ভাবনার মাঝে কখন যে পল্টনের ওভারব্রিজ পেরিয়ে বাসসের সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি বুঝতেই পারিনি। এ সময় কোন বোধশক্তি আর কাজ করছিলো না। ইতোমধ্যে দু-একটি ইটের টুকরো পা ও ডান বুকে এসে আঘাত করেছে। আমরা হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বাকি প্রায় সবারই শরীর কোন না কোনভাবে আহত রক্তাক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সেক্রেটারি ছোটভাই যোবায়েরের মাথা ফেটে অনবরত রক্ত ঝরছে, তবুও সে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। পল্টন মোড়ের সম্মুখভাগে এ-এক চরম অসম লড়াই, সামনে লগি, বৈঠা, রড ও পাথর হাতে হাজার হাজার হায়েনার দল আর তার প্রতিকূলে সামান্য সংখ্যক সীমান্ত পাহারাদার। তাদের বেপরোয়া ইট বৃষ্টির মধ্যে প্রতি মুহূর্তে আমাদের ভাইয়েরা গুরুতর আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ছে। অন্যদিকে তিনদিক থেকেই তাদের লোকজন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতোমধ্যে খবর পেয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আমাদের কর্মী ভাইয়েরা যারা গুলিস্তান, রমনা, কাকরাইল এ সকল এলাকা দিয়ে আসছিলেন তারাও বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে পথিমধ্যে হামলার শিকার হলেন অর্থাৎ শুধুমাত্র পেছনের মতিঝিল অঞ্চল ছাড়া আর সব পথ আমাদের জন্য রুদ্ধ। [caption id="attachment_21" align="alignleft" width="300" caption="আটাশে অক্টোবরের হত্যাযজ্ঞ"]monju[/caption]

এভাবে কতক্ষণ পল্টন মোড়ের প্রতিরোধ ব্যূহ ধরে রাখা যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। প্রতিপক্ষ তোপখানা রোড, বিজয়নগর সড়ক ও মুক্তাঙ্গনের বিভিন্ন ভবন ও আড়ালে শেল্টার নিয়ে অনবরত তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। আর থেমে থেমে গুলির আওয়াজ কানে আসছিল। বিএসএস ভবনের পশ্চিম পার্শ্বে নতুনভাবে নির্মিতব্য একটি ভবনের যে টিনের ঘেরাও ছিল আমাদের কিছু ভাই কৌশল করে সেখানে লাঠি দিয়ে আঘাত করে করে বিকট শব্দ তৈরি করছিলেন, যা শুনে অগ্রসরমান আওয়ামী লাঠিয়ালরা বার বার ভয়ে পিছু হটে যাচ্ছিল। একদল শিবিরকর্মী কিছু কাঠখড় জোগাড় করে মোড়ের মাঝামাঝি জায়গায় বুদ্ধি করে আগুন জ্বালিয়ে দিলেন। এতেও কিছুটা সুবিধা হলো। সচিবালয়ের পেছন কোনায় পুলিশ বক্সে শেল্টার নিয়ে যারা আমাদের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ করছিল তারা সেখান থেকে সরে গেল। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পুলিশের দল ফুটপাথের সাথে লেপ্টে থেকে ঢাল দিয়ে নিজেদের আড়াল করে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকলো। আমাদের এ কৌশল কতক্ষণ টিকবে সে উদ্বেগে মনটা বার বার আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। হঠাৎ মাথায় চিন্তা এলো, ভালোভাবে একটা ধাওয়া দিয়ে তাদের শেল্টারগুলো দখল করতে পারলে ভালো হতো।

সাথে সাথে কিছু ভাইকে বললাম, বেশি করে ইট পাথর জোগাড় করুন, আমরা অকস্মাৎ একটি ধাওয়া দেবো। ডান পার্শ্বে বিজয় নগরের যে টার্নিং, সেখানে সিটি কর্পোরেশনের একটি লম্বা লোহার গ্রিল আছে। আমি সেটাকে টার্গেট করলাম। এগিয়ে গিয়ে সেখানে যদি অবস্থান নেয়া যায় তাহলে সামান্য জনশক্তি নিয়েও আমরা কৌশলগত প্রতিরোধ রচনা করতে পারবো। ভাবনা এবং লড়াই সবই আমাদেরকে একসাথে করতে হচ্ছে। সময় ক্ষেপণ করার সুযোগ নেই। মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশ পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। পেছন থেকে ভাইয়েরা বেশ কিছু ইট পাথরের জোগান দিলেন। আমরা দু’ হাতে, শার্ট-প্যান্টের পকেটে যতটুকু পারা যায় পাথর ভরে নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে ১৫-২০ জনের একটি দল সামনে অগ্রসর হলাম। লগি-বৈঠাধারীরা সংখ্যায় অনেক। প্রথমাবস্থায় তারা দমলো না। তাদের অজস্র পাথর আমাদের কারো কারো শরীরে আঘাত হানলো। কিন্তু তবুও আমাদের অগ্রসরতা অব্যাহত রাখায় তারা পিছু হটতে শুরু করলো। দৌড়াতে দৌড়াতে তারা প্রায় প্রেস ক্লাব পর্যন্ত পৌঁছে গেল। আমাদের পাথরও প্রায় শেষ। দ্রুত শেল্টার নিতে হবে, তাই আমরা বেশি দূর এগোলাম না। আমাদের ভাইয়েরা কেউ কেউ চাইলেন আরো এগুতে। আমাদের এ দ্বিধা দেখে প্রেস ক্লাবের সম্মুখস্থ রাস্তায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা আবার সংঘবদ্ধ হতে লাগলো। সেই মুহূর্তে হাইকোর্টের রাস্তা ধরে হাজার হাজার উচ্ছৃঙ্খল লাঠিয়ালদের এক হিংস্র মিছিল সেখানে এসে যোগ দিল এবং পাল্টা ধাওয়া করলো আমাদের। আমরা মাত্র কয়েকজন বিজয়নগরের রাস্তায় লোহার গ্রিলে শেল্টার নিলাম। বাকিরা ফিরে গেল আগের জায়গায়। লোহার গ্রিলের শেল্টারে আমাদের সংখ্যা এবং প্রস্তুতি যে খুবই দুর্বল তা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেয়ে গেল হিংস্র প্রতিপক্ষ। চতুর্দিক থেকে ইট পাথরের বর্ষণের মাঝে আমরা অনেকটা ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। যে কয়েকজন ভাই সাথে ছিল, পাশ ফিরে দেখি তারাও নেই। এ অবস্থায় পিছু হটা কাপুরুষতা না কৌশল, আমি বুঝতে পারছি না। মনে মনে কলেমা শাহাদাত পড়ে নিলাম। হঠাৎ মনে হলো বাম পাশের গলিটার শেষ প্রান্তে আমাদের একটি গ্রুপ আছে, সেখানে পৌঁছাতে পারলে ঐ গ্রুপটাকে অগ্রসর করে এনে এদিক থেকে কিছুটা মোকাবেলা করা যেত, কিন্তু সেখানে পৌঁছানো কি সম্ভব? লোহার গ্রিলের কারণে আমার প্রতি নিক্ষেপিত পাথরগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, নতুবা অনেক আগেই চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেত সমস্ত শরীর। আমি জানি পাশের গলিতে পৌঁছানোর পর আমার পক্ষে আর অক্ষত থাকা সম্ভব নয়, তবু ধীরে ধীরে আমি গলিটার কাছে পৌঁছলাম। বাম পাশের রাস্তা ধরে এগেুনোর সাথে সাথে পেছন থেকে একটি গ্রুপ আমাকে ধাওয়া শুরু করলো। আমার লক্ষ্য এখন পল্টন মসজিদের গলি। আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু মাঝামাঝি পৌঁছতেই সামনে আরেক দলকে ‘জামাত-জামাত ধর’ বলে আমার দিকে দৌড়ে আসতে দেখলাম। আমি একটুও থামলাম না। আল্লাহু আকবর শব্দ ছাড়া আমার মুখে আর কোন শব্দ বেরুলো না। সামনে পেছনে লাঠি, লগির বেপরোয়া আঘাত আসতে থাকলো। আমি দুই হাত দিয়ে মাথা আড়াল করে টলতে টলতে দৌড়াতে লাগলাম, কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলাম না। ৫-১০ গজ এগুতেই একজন সামনে থেকে সজোরে আমার হাঁটুতে বৈঠা দিয়ে আঘাত করলো। আমি ছিটকে পড়ে গেলাম। কিল, ঘুষি ও বেধড়ক আঘাতে আমি আর টিকতে পারলাম না, হাল ছেড়ে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম আমার লাশ এখানে পড়ে থাকলেও কেউ খবর পাবে না। আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার প্রভুর সাথে সাক্ষাতের মহেন্দ্রক্ষণের জন্য। মুখে বললাম আল্লাহ তুমি কবুল করো। মুহূর্তের জন্য ১০ মাসের শিশু পুত্র আর শহীদের স্ত্রী হতে অস্বীকারকারিনী আমার স্ত্রীর মুখচ্ছবিখানি এক ঝলক হৃদয়পটে ভেসে উঠলো। মহান আল্লাহর অপার রহমতের কাছে মা ও সন্তানকে সঁপে দেয়ার প্রত্যাশায় কষ্ট করে মাথা কাত করে রাব্বুল আলামিনের বিশাল আসমানের দিকে দৃষ্টি দিতেই লক্ষ্য করলাম শত্রুরা তাদের নির্দয় প্রহার থামিয়ে দিল। কেউ একজন চিৎকার করে উঠলো এ আমাদের লোক, মকবুল ভাইয়ের লোক। থেঁতলে যাওয়া ডান বাহু দিয়ে আমি মাথাকে আড়াল করে রেখেছিলাম। কিছুক্ষণের জন্য হাত, পিঠ এবং পা যুগলে আর কোন আঘাত এলো না। তীব্র ব্যথায় আড়ষ্ট মাথাটি তুলতেই দেখলাম সামনে পল্টন মসজিদের সম্মুখস্থ রাস্তা। যারা আমার ওপর হামলে পড়েছিলো তারা পল্টন মসজিদের সামনে অবস্থানরত আমাদের ভাইদের ওপর ইট পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে দৌড়ে গেল। আমি আর বিলম্ব করলাম না, শরীরের সকল শক্তি জড়ো করে কোনমতে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে আবার দৌড় শুরু করলাম কিন্তু তাদের ইট বৃষ্টির মধ্যে বেশি দূর এগুতে পারলাম না। উপর্যুপরি ইট ও লাঠির আঘাতে জাফরান হোটেলের সামনে এসে পড়ে গেলাম। দূরে তাদের আক্রমণ মোকাবেলাকারী শিবিরের মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি রফিকসহ আরো কয়েকজন ভাই আমাকে দেখে নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে অঝোর ধারার ইট পাটকেলের মুখেও দৌড়ে এলেন। তাদের বেপরোয়া ভাব দেখে উন্মত্ত হামলাকারীরা পিছু হটে গেল। রফিক আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। অন্যরা মুহূর্তেই পাঁজাকোলা করে আমাকে কোলে তুলে পূর্ব দিকের রাস্তার প্রান্তভাগে দণ্ডায়মান একটি রিক্সায় উঠিয়ে শিবিরের কেন্দ্রীয় অফিসে নিয়ে এলো। অনেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন, জালিমদের হাত থেকে বেঁচে আসার জন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন কেউ কেউ কিন্তু আমি বুঝি না এটা আমার প্রতি আল্লাহর রহমত না অসন্তুষ্টি।

মুজাহিদের মায়ের যে সৌভাগ্য হলো আমার মায়ের তা হলো না। শহীদ হাবিবুর রহমান ভাইয়ের স্ত্রী যে, গৌরবময় কোরবানির অধিকারী হলেন, আমার স্ত্রী তা থেকে বঞ্চিত হলেন। আমি আর শহীদ শিপন আহত হয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। শিপন সেখান থেকে প্রভুর দরবারে পৌঁছে গেল আর আমি ফিরে এলাম কণ্টকময় পরীক্ষাস্থল পার্থিব জঞ্জালে।

২৮ অক্টোবরে আমাদের প্রস্তুতিগত দৈন্যতা ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের যে দুর্বলগত দিকগুলো ছিলো তা এখনো স্মরণে এলে কষ্ট পাই। হারিয়ে যাওয়া সাথীরা, তাদের ব্যথিত পরিবার এবং আহত কর্মীদের কথা ভাবলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়।

প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়ার সময় পল্টন মোড় এবং জাফরান হোটেলের সম্মুখস্থ রাস্তার স্মৃতি মনে পড়ে। এ স্মৃতি সত্যি সত্যিই বেদনার, কিন্তু যখনই প্রবল পরাক্রান্ত এক হিংস্র শক্তির মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের রক্তমাখা ভাইদের বীরদর্পে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি মনে পড়ে, তখন হৃদয় মাঝে অসামান্য যোজন যোজন প্রেরণার সৃষ্টি হয়। সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে তা বদর-ওহুদের আবেগকে স্পর্শ করে। বদরের সাথীরা যেমন ইসলামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ও বরণীয়, ২৮ অক্টোবরের মুজাহিদগণও শ্যামল সবুজ বাংলায় তেমন চির অম্লান উন্নত শির হয়ে থাকবেন। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের কবুল কর। তোমার বদরের জমিনকে প্রসারিত করে পল্টন মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত করে দাও। আমিন!

লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির