বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই দেশে মোট ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ঘুরে ফিরে তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ক্ষমতার রদবদল নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রথম, সপ্তম, নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নিয়ে মোট ছয়বার, বিএনপি দ্বিতীয়, পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম সংসদ নিয়ে মোট চারবার এবং জাতীয় পার্টি তৃতীয় ও চতুর্থ সংসদ নিয়ে মোট দুইবার বিজয়ী হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ই মার্চ। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচন হয়েছে ২০১৮ সালের ৩০ শে ডিসেম্বর। প্রতিটি সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানাবিধ কারণে এগারটি সংসদের মধ্যে পাঁচটি সংসদ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। মেয়াদ পূর্ণ না হওয়া সংসদগুলো হলো প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ। তবে এ পর্যন্ত পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম, দশম ও একাদশ সংসদ তার মেয়াদকাল পূর্ণ করতে পেরেছে।
উইকিপিডিয়া তথ্য অনুসারে জানা যায়, বাংলাদেশে মোট ১০০-এর অধিক রাজনৈতিক দল আছে। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে জোট- মহাজোট গঠনের হিসাবে আওয়ামী লীগ ১৮ দল, বিএনপি ২০ দল, জাপা এরশাদ ৫৮ দলসহ বাংলাদেশে মোট প্রায় শতাধিক দলের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব দলসমূহের মধ্যে কিছু কিছু দল তথাকথিত নিজেদের স্বার্থে কিংবা জাতীয় স্বার্থে জোট কিংবা মহাজোট গঠন করে, আবার ত্যাগ করে হয় স্বতন্ত্র দল না হয় ভিন্ন দলে যোগ দিয়ে রাজনীতির অঙ্গনে আবির্ভূত হয়ে থাকে। এখানে সচেতন দেশবাসীর অবগতির জন্য বলে রাখা দরকার, বিশ্বে অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে গ্রেট ব্রিটেনে প্রধানত দু’টি রাজনৈতিক দল আছে। ১. কনজারভেটিভ পার্টি এবং ২. লেবার পার্টি। ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকায় আছে মূলত দু’টি দল। ১. ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, ২. রিপাবলিকান পার্টি।
ভারতে মূলত পাঁচটি দল আছে- (১) ভারতীয় কংগ্রেস। (২) অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস। (৩) ভারতীয় জনতা পার্টি। (৪) কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া। (৫) কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী)। ভারতে বহুজন সমাজ পার্টি এবং ন্যাশনালিস্ট পার্টি নামেও দু’টি দলের কথা জানা যায়। অথচ বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি দেশে জানা গেল শত সংখ্যারও বেশি রাজনৈতিক দলের পদচারণা। বলতে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে, বাংলাদেশের শত সংখ্যার রাজনৈতিক দলগুলো যতো না জাতীয় স্বার্থে কাজ করে তার চাইতে বরং দলীয় এবং ব্যক্তিগত নেতৃত্বের খায়েশ কিংবা অধিকতর ভোগের স্বার্থে বেশি তৎপর থাকে। দলগুলোর বিগত আচার-আচরণ চরিত্র বিশ্লেষণ করলে তারই যথার্থ প্রমাণ মেলে। দু-একটি উদাহরণ দিলে দেখা যাবে, স্বাধীনতার পরেই যে দলটি ক্ষমতায় ছিল সেটি হলো আওয়ামী লীগ। এ দলের মহান নেতা ও স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বলেছেন, পাকিস্তান থেকে সদ্য স্বাধীন হয়েছি কিন্তু পাকিস্তান পেয়েছে সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি। বিদেশ থেকে অনুদান পাওয়া সাড়ে সাত কোটি কম্বলের আমারটা আমি পাইনি। সব সম্পদ চাটার দল চেটেপুটে খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। এছাড়া তৎকালীন দলীয় লোকদের দ্বারা সংঘটিত ব্যাংক লুট, সম্পদ লুট, পাটের গুদামে আগুন, আলুর গুদামে আগুন এসব ঐতিহাসিক সত্য।
এরপরের সরকার ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিএনপি। তার আমলে লুটপাটের খুব বেশি খবর চাউর না হলেও বিএনপির পরবর্তী শাসনামলসমূহে নেতা-নেত্রীদের সম্পদ ভোগ, অর্থপাচার, আত্মসাতের ঢের খবরের প্রমাণ আছে। এরপর সৈনিক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের আমলে তো কথিত আছে দশটি হোন্ডা বৃষ্টি গুন্ডা নির্বাচন ঠান্ডা। যারা এভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতা দখল করেছে, তারা দেশের সম্পদ লুটপাটে কতই না আত্মসাৎ করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এসব দলের নেতৃত্বে যেসকল দল জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতার স্বাদ আস্বাদন করেছে তারাও অবর্ণনীয় লুটপাট করে নিজের এবং তাদের দলের নেতাকর্মীদের আখের গুছিয়ে ভোগের প্রতিযোগিতায় মোটেই পিছপা হয়নি। এ ধারা ক্রমাগত অব্যাহত থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে যে দলই ক্ষমতায় এসেছে তারাই দেশের সম্পদ, জনগণের সম্পদ, ট্যাক্সের টাকা, বিদেশ থেকে চড়া সুদে ঋণ করে আনা টাকা সবকিছুতে লুটপাটে ভোগ এবং ভাগ বসিয়ে দেশে এবং বিদেশে সম্পদের পাহাড় তৈরি করেছে। এসব বিষয়ে ঐতিহাসিক সত্যতা হলো- বিদেশে নিরাপদ সুইস ব্যাংকে টাকার স্তূপ জমা করা, কানাডায় বেগম পাড়ায় ভোগের গ্রাম তৈরি করা, দুবাই-সিঙ্গাপুর-লন্ডন-আমেরিকায় হাজার হাজার কোটি ডলারের ব্যবসায় বাণিজ্য, চোখধাঁধানো বিলাসী প্রাসাদ নির্মাণ, সমাজের ক্ষমতাসীন ও উঁচু তলার লোকদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-জামাতাদের স্বদেশে বিদেশ বিলাস, ব্যাংকের রিজার্ভসহ পুঁজিবাজারে স্টক মার্কেট বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, দেশের তাবৎ মেগা প্রকল্পে প্রকৃত অর্থে ব্যয়িত অর্থের ৫ গুণ থেকে ১০ গুণ অর্থ আত্মসাৎ। এসব খবর তো সাধারণ বাংলাদেশী এবং প্রায় শতভাগ মেহনতি মানুষের কর্ণকুহরে এখন সাধারণ বুলি হিসেবে অতিমাত্রিক শ্রুত। দলীয় মন্ত্রী-এমপি মহোদয়রাসহ দেশের আর্থিক খাতের কর্মকর্তা/আমলারা প্রচার করে সরকারি স্টেটমেন্ট দিয়েছেন, এ তথ্য বলে যে- দেশে এখন হাজার কোটি টাকার ব্যাংকহোল্ডারদের সংখ্যা হাজার হাজারের অধিক ছাড়িয়ে গেছে। শতকোটির সংখ্যা লাখ লাখ গ্রাহকের। আর সাধারণ কোটির সংখ্যা তো অগণিত। আবার কোনো কোনো নেতা তাদের নিজস্ব সম্পদের আধিক্যে আপ্লুত হয়ে এখন দেশে বেহেশতখানার পরিবেশ বিরাজিত বলে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। আবার কোনো নেতা সাধের ঢেকুর তুলে বলেছেন, দেশে এখন ভোগ্যপণ্যের বাজারদর যাই থাকুক না কেন শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করে স্বস্তি ও আরামের জীবন যাপন করছেন। এতসব সুখ বিলাসী বক্তব্য-খবরদারি শুধু কেবল ওই সকল তপকার নেতা-নেত্রীদের কল্কধ্বনি থেকে প্রচারিত, যারা দেশের অর্থ-সম্পদ লুট করে দেশে বিদেশে সম্পদের পাহাড় তৈরি করে সেসব উপার্জন হালাল করতে সদা-সচেষ্ট। আর ওইসব কারণেই ছোট-বড় মাঝারি মানের রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে সুযোগ সম্ভোগে জোট গঠন এবং জোট বদলের ওইরূপ লীলা খেলা। মজার বিষয় হলো যখন যে দল বা জোট ক্ষমতাসীন থাকে তারা তারস্বরে চিৎকার করে প্রতিপক্ষকে ওইরূপ আত্মসাৎকারী, পাচারকারী, লুটেরা ইত্যাদি বচন গেয়ে গালি দিয়ে নিজেদের আত্মসাৎকে ঢাকার কসুর করতে দ্বিধা করে না। দেশে ৫২ বছরের রাজনৈতিক নেতৃত্বের খতিয়ানে তারই সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের ওইসব কৌশল বুঝতে গেলে উপরের পর্যালোচনাটি সামনে রাখা দরকার। বাংলাদেশের সকল রাজনীতিবিদদের কাছে আমি সবিনয়ে ক্ষমা চেয়ে পরবর্তী লেখাটা শুরু করতে যাচ্ছি। ক্ষমা চাচ্ছি এ কারণে যে সম্মানিত রাজনীতিকরা একটি দেশের পরিচালনায় মূল কর্ণধারের ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাদের হতে হয় দেশের আপামর জনগণের আস্থাভাজন। দেশ পরিচালনায় দূরদর্শিতাসম্পন্ন, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সকলকে সাথে নিয়ে সিসাঢালা প্রাচীর গঠনের অবিনাশী তৎপরতায় দেশনায়কের ভূমিকা পালন, দেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব সম্পর্কে সচেতন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব। সর্বোপরি মহৎ নৈতিকতাসম্পন্ন সকলের শ্রদ্ধাভাজন নেতৃত্ব। ঐতিহাসিক সাক্ষ্যমতে অনেক দেশের প্রতিভাবান মর্যাদাশীল বিশ্ব নেতৃত্বের মর্যাদায় উত্তীর্ণ। এমনতর দেশনায়কদের নিয়ে লেখা আমার মতো অযোগ্য ব্যক্তির হয়তোবা শোভা পায় না। তবুও বেদনাহত হৃদয়ে দেশ-জাতির করুণ দুর্দিনে লিখতে হচ্ছে বাধ্য হয়ে, তাই আমার এ ক্ষমা চাওয়া।
বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন দেশে যেসকল রাজনৈতিক নেতৃত্ব নন্দিত এবং গৌরবান্বিত হয়েছেন তাদের কয়েকজনের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে আলোচিত আছেন যথা ইংল্যান্ডের উইনস্টন চার্চিল, আমেরিকার আব্রাহাম লিংকন, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, মাদার তেরেসা, জর্জ ওয়াশিংটন উল্লেখযোগ্য। পুরাকালে যেসব বিশ্বখ্যাত দেশ ও রাষ্ট্রনায়কগণের নাম ইতিহাসে উল্লেখ আছে, তাদের মধ্যে আছেন সাইরাস দ্য গ্রেট (পারসিয়া), আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট (মেসোপটেমিয়া), অগাস্টিন (রোম), যোয়ান অফ আর্ক (ফ্রান্স), সম্রাট সোলেমান (অটোমান), কুইন এলিজাবেথ (ইংল্যান্ড), টমাস জোফারসন (ইউএস) প্রভৃতি জগদ্বিখ্যাত মনীষী নেতৃবৃন্দ। হাল আমলে ওই কাতারে যাদের নাম উল্লেখযোগ্য তারা হলেন- আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ডেভিড ক্যামেরুন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন, জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেল, কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, প্রভৃতি।
এখানে যে বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য সেটি হলো- বিশ্বের উন্নয়নসমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে কোটি কোটি জনসাধারণের জন্য প্রতিটি দেশে মাত্র দুই অথবা তিনটি রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকে নেতৃত্ব দিয়ে তারা দেশে ও বিদেশে বিশ্ববিজয়ী অবস্থান অধিকার করেছেন। তাদের দেশের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণমূলক প্রতিযোগিতায় শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচিত হয়ে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে দেশের জনগণের চাহিদা অনুযায়ী পরবর্তী কর্ণধারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন। সাথে সাথে তারা দেশপ্রেমের অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনগণের মনের মণিকোঠায় শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সাথে সাথে বহির্বিশ্বেও বিশ্বনেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে দুটি নয়-পাঁচটি নয়, শতাধিক সংখ্যক রাজনৈতিক দলের ভুঁইফোড় উৎস থেকে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা জ্ঞাত-অজ্ঞাত সংখ্যক দলসমূহ একবারে জোটবদ্ধ হওয়া আবার জোট ভেঙে নতুন জোট গঠন করা কিংবা একক অবস্থান থেকে অন্যদের অথর্ব বাহাদুরির ভূমিকায় ষোলকলা দেখানো ইত্যাদি রকমের হযবরল পরিবেশ সৃষ্টি করে দেশে-বিদেশে রাজনীতির মানদণ্ডে যেমন হালকা অপাঙক্তেও হয়েছেন তেমনি ক্ষমতা ও ভোগের লোভে রাজনীতির হাটে গরু-ছাগলের বাজারদরের পশু পণ্য হিসেবে কোরবানি হচ্ছেন। এতে যেমন উন্মুক্ত রাস্তায় পাগল-পাগলিনীর প্রলাপের পাগলামি হিসেবে দেশ-জনতার কাছে হাসাহাসির পাত্র বনে যাচ্ছেন তেমনি সচেতন ও সুচতুর বিদেশীরা ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপে পণ্যের পাইকারি বাজারদরের মূল্য হ্রাসের দরপতনে ইচ্ছেমতো হাঁক-ডাক দিয়ে আমাদের দেশটাকে কেউ পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রণে, কেউ সমাজতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে, কেউ ধর্মনিরপেক্ষতার বেড়াজালে, আবার কেউবা স্বৈরতন্ত্রের একনায়কতান্ত্রিক অক্টোপাসে আবদ্ধ করতে চেয়েছেন। কেউবা আবার এক ধর্ম এক রাষ্ট্রের স্লোগানের মহাবাণীতে নিপাতনে সন্ধিযোগে মহাভূ-ভাগের অধিকারী হবার লিপ্সায় মেতেছেন। আমরা বাংলাদেশীরা এখন বোকা হাঁদা-গঙ্গারামের মতো ষড়যন্ত্র আর বেঈমানির যূপকাষ্ঠে ইতিহাসের নিহত মহানায়ক সিরাজউদ্দৌলাহর পরাজিত হতভাগ্য জনগণের মতো ভাগীরথীর তীর থেকে ষড়যন্ত্রের সিপাহসালার ব্রিটিশ বেনিয়া লর্ড ক্লাইভের লুট করা জাহাজও বজরাবোঝাই নবাবী-সম্পদ সামগ্রীর দিকে দেশের কোটি কোটি জনগণ হতাশার দৃষ্টি নিয়ে বিমূঢ় ও বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। হাই হতোস্মি সিরাজ! হায় হতভাগ্য স্বাধীন বাংলাদেশের কপালপোড়া কোটি কোটি স্বাধীনচেতা জনগণ!
বাংলাদেশ একটি অস্বাভাবিক বহুমাতৃক রাজনৈতিক দলের গোবর-গর্ভ এর কারণ কী? যদিও বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দল গঠনের অধিকার আছে তাই বলে কি ছোট্ট ভূখণ্ডটিতে শতাধিক দল গঠন করে নাগরিকদের শত মত ও পথের সবক দিতে হবে? এতে করে বিভাজিত হচ্ছে শান্তিপ্রিয় জনগণ তেমনি বিস্ময়ে বিমূর্ত পুলকিত হচ্ছে সচেতন বিদেশীরাও। এসবের মূল কারণ বোধ করি অন্যের মতামতে শ্রদ্ধা না দেখিয়ে নিজের মতকে অগ্রাধিকার দেয়া, অতিমাত্রায় দল গঠন করে নেতা হওয়ার বাসনা, ক্ষমতার ভোগের অসম্ভব রকমের নেশা, প্রতিপক্ষের প্রতি চোখরাঙানো, হিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করে একে অপরকে একেবারে নির্মূল করার বন্য মানসিকতা। এদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেন একে অপরের প্রতি শত্রু এবং জাতশত্রু বললে অত্যুক্তি হবে না। যেমন কুকুর বিড়াল, ব্যাঘ্র হরিণ একে অপরের জাতশত্রু। তেমনি জঘন্য পশুত্ব এবং পাশবিকতা এদেশের তথাকথিত রাজনীতিবিদ এবং তাদের সংকীর্ণমনা অনুগামীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
এদেশের রাজনীতিবিদরা দল গঠন করে একে অপরকে মাঠে ময়দানে ঘোষণা দিয়ে নির্মূল করতে চায়, একটা লাশের বিনিময়ে দশটা লাশ ফেলতে চায়, এমনকি হাতের বিনিময়ে সমগ্র দেহটাকে আগুনে পোড়াতে চায়। এদেশের রাজনীতিকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে প্রতিপক্ষকে রাষ্ট্রীয় উপায়ে-উপাদান ব্যবহার করে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতে চায়, গুম করতে চায়, রহস্যজনক ক্রসফায়ারের ব্যাকরণ ব্যবহার করে রাতের আঁধারে মানব সন্তানকে হত্যা করে ঝোপে ঝাড়ে বাদাবনে লুকিয়ে রাখতে চায়। জনগণের আমৃত্যু অধিকার কথা বলার অভিব্যক্তি বন্ধ করতে চায়, প্রতিবাদী জনগণকে রাস্তার আলো নিভিয়ে বুলডোজার দিয়ে নিষ্পেষণ করতে চায়। কিন্তু কেন এ আক্রোশ! কেন এ প্রতিহিংসা পরায়ণতা! কেন প্রতিপক্ষকে সবংশে নির্মূল করার এ পাশবিক অপসংস্কৃতি? এরা কি আসলে গণতন্ত্রের সঠিক সংজ্ঞায় রাজনীতিবিদ নাকি পাশবিকতার সংজ্ঞায় হিংস্র বন্যপশু। আজ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে এসব বিষয় নিয়ে দেশের জ্ঞানী বিজ্ঞ সচেতন বিদগ্ধজনদের চিন্তা ভাবনা করা, উন্নত গবেষণা করা। এ দেশে খুশিমতো দলগড়া আবার দল ভাঙা জোট গড়া আবার জোট ভাঙা আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নিষ্প্রয়োজনীয় নতুন দল তৈরি করা, কী তার কারণ? কী তার তাত্ত্বিক এবং বাস্তবিক বিশ্লেষণ? তার সঠিক পন্থা অনুসন্ধান করা এখন সময়ের অনিবার্য দাবি। আমার ক্ষুদ্র চিন্তায় যা আমি ধারণ করতে চাই তা হলো এদেশে বহুবাদী জনসমষ্টির অবস্থান।
প্রথমত ইসলামী দল
এদেশে সতেরো কোটি জনগণের ১৬ কোটি মুসলমান। বলা হয়ে থাকে এরা এক কোরআন এবং এক কালিমায় বিশ্বাসী। তবে এদের মধ্যে কেন বহু বিভক্তি। শুধু ইসলামী দলই হলো প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব। এরা ইসলামের কথা বললেও একে অপরের প্রতি অনেক দলেই শত্রুভাবাপন্ন। একদল যে ঘাটে অজু করতে চায় অন্য দল সে ঘাটে অজু করতে দ্বিমত শুধু নয়, এই ঘাট নাপাক বলে কঠিন ফতোয়ার তর্কবাণ নিক্ষেপ করে ওই ঘাটকে উচ্ছেদ করতে চায়। এতে সাধারণ মুসলমানরা বিভক্ত। আর ওই বিভক্তি নিয়ে তৈরি হয়েছে দেশে মুসলিম জনসমষ্টির মধ্যে বিভেদ-সংঘাত-দ্বন্দ্ব।
দ্বিতীয়ত সমাজতান্ত্রিক দল
এদেশে সমাজতান্ত্রিকমনা সাধারণ জনগণের বড়ই অভাব তবুও কেন জানি না কিছু ভব্য সভ্য নেতানেত্রী কোনোকালে গুজরে যাওয়া কাল মার্কস- লেনিন- মাওসেতুং বস্তাপচা সমাজতন্ত্রের ধুয়া তুলে কিছু তাত্ত্বিক কিছু নৃতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের নিগঢ়ে এদেশে গরিব-দুঃখী খেটেখাওয়া মেহনতি মানুষদের তন্ত্র-মন্ত্রের মুখরোচক বক্তব্য বিশ্লেষণে আকৃষ্ট করতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ৫২ বছরে তারা এবং তাদের ভ্রমাত্মক মতবাদ বাহান্নবার পানিতলে সমাহিত। এক কথায় তারা অযথা নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব, ক্ষমতা ও ভোগের লালসায় সমাজতন্ত্রের বুলি ছাড়তে নারাজ। সমাজতন্ত্রের স্লোগানে সকলকে এক শ্রেণীতে এক কাতারে আনতে চাইলেও তারা কিন্তু নিজেরাই বহুধা শ্রেণীতে বিভক্ত এবং এদের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরপরই আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিপক্ষ হয়ে তার দলের লুটেপুটে খাওয়ার সুযোগ নিয়ে শেখ মুজিবুরের গায়ের চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাবার মুখরোচক বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিয়ে সমাজতন্ত্রের রঙিন স্লোগানে এ দেশের গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে সাধের সমাজতান্ত্রিক রাজত্ব গড়তে চেয়েছিল। তাদের নেতৃত্বে ক্ষমতার বাহাদুরি দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কল্যাণে একাত্ম হওয়া জনগোষ্ঠীকে মারাত্মক ধ্বংসাত্মক শ্রেণী সংগ্রামের স্লোগান তুলে, বিভাজন করে ধনী, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে শোষণ করে, ধ্বংস করে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র চালু করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন সাধ পূরণ হয়নি আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় ‘র’-এর পরামর্শে এদেশে দুর্ধর্ষ রক্ষীবাহিনী তৈরি করে নবোদ্যমে তৈরি হওয়া জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, সোস্যালিস্ট পার্টি- সব দলকে ভেঙে চুরমার করে কথিত ষাট হাজার গণবাহিনীর সদস্যসহ সিরাজ শিকদার প্রমুখ অতি বিপ্লবীদেরকে হত্যা করে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু মজার বিষয় সেই বাসদ কমিউনিস্টরা এখন তদ্বীয় কন্যা মাননীয় শেখ হাসিনার আঁচলের ছায়াতলে মুখ গুঁজে এদেশে হাসিনাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লাল-রঙিন কথা বলার বিবরে একদিকে ইসলামী ও ডানপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে সঙ্গিন উঁচু করে খামোশ রাখতে চায়, অপরদিকে শেখ হাসিনার পারপাস সার্ভ করে তার আনুগত্য ভাজন হওয়ার কসরত করে ক্ষমতার হালুয়া রুটিতে ভাগ বসাতে চায়। শেখ হাসিনা তার পিতার চামড়া ছেদনকারী কসাইদের কেউটে পোষার ভান করে তার প্রধানতম প্রতিপক্ষ ডানপন্থী শক্তি ও জনগণকে রুখে দিতে চায়। এভাবেই এ দেশে তৈরি হয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দল বা গোষ্ঠী দিয়ে জোট ও মহাজোট গড়ে ক্ষমতা ধরে রাখার ধ্বংসাত্মক পাঁয়তারা।
তৃতীয়ত আওয়ামী লীগ
মূলত আওয়ামী লীগ ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। এদেশে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের কাছে টানতে মূল দলের নাম পরিবর্তন করে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে রাখা হয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগকে বলা হয় এদেশে অতি পুরাতন একটি ঐতিহ্যবাহী দল। মুক্তিযুদ্ধে এ দলটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে, যে কারণে দলটি গর্বিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন কর্ণধারদের মধ্যে যিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং স্বাধীনতা ও তৎপরবর্তী যিনি মূল নেতৃত্বে ছিলেন সেই অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতার স্থপতি রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমান স্বয়ং ১৯৭৪ সালের স্বপ্নের এবং সাধের আওয়ামী লীগের প্রয়োজন বাংলাদেশে ফুরিয়ে গেছে এই আত্মবিশ্বাসে আওয়ামী লীগ ভেঙে গড়ে তুললেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। যেখানে পূর্বে মুসলিম লীগের যেমন আওয়ামী মুসলিম শব্দের তাত্ত্বিক নিষ্প্রয়োজনে আওয়ামী লীগ, তেমনি নৃতাত্ত্বিক প্রয়োজনে কৃষক শ্রমিক সংযোগ। মূলত এবারে এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সমাজতান্ত্রিক দলে রূপায়িত হলো। এরপর বঙ্গবন্ধুর দুঃখজনক হত্যার পর পুনরায় যখন শেখ হাসিনার হাতে দলের নেতৃত্ব এলো তখন আবার কৃষক শ্রমিক বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ তার পুরনো নামে পরিচিতি পেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হয়ে যায়। এবারের আওয়ামী লীগ ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত হয়ে এদেশের ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী ডানপন্থী শক্তিকে চরম প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে। এই কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা পেতে এককালের শেখ মুজিবের গায়ের চামড়া ছোলা সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মভোলা নিরপেক্ষতাবাদীর বহুধা বিভক্ত দল ও গোষ্ঠীকে নিয়ে গড়ে তোলে একটি জোট-মহাজোট। উদ্দেশ্য ওই সমাজতন্ত্রী ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী গোষ্ঠীকে দিয়ে ইসলাম ও ডানপন্থীদের কথায় কথায় ল্যাং মেরে কাবু রাখা অথবা নির্মূল করে নিজেদের ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করা। এছাড়া আরো মজার বিষয় হলো এরা যুগ যুগ ক্ষমতায় থাকার জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থ ঘুষ দিয়ে তথাকথিত কিছু দুর্বল ডানপন্থী এবং লোভী ভোলানাথদের বাগে এনে অদ্ভুত কিসিমের কিংস পার্টি তৈরি করে জোট মহাজোটকে আরো সম্প্রসারণ করে তথাকথিত গণতন্ত্রের বহু দলীয় মাত্রায় উত্তীর্ণ করে ফাটা গণতান্ত্রিক সেজে দেশ ও বিশ্বের চোখে ধুলো দিয়ে প্রহসনের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতার মসনদে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমরা জানি কিংস পার্টি অর্থ রাজার দল। আর রাজা রানীর দল তো প্রধানত ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডের রাজা বা রানী ভুলেও কোনোদিন তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে অনুগত কোনো পার্টিকে মদদ দিয়ে তথাকথিত ‘কিংস পার্টি’ তৈরি করে না, গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলে খ্যাত ইংল্যান্ডে মূলত দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল তার একটি কনজারভেটিভ পার্টি, অপরটি লেবার পার্টি। সেই সুদূর শতাব্দী অতীত থেকে চলছে এ দুটি দলের পর্যায়ক্রমিক দেশ শাসনের প্রতিযোগিতা। তৃতীয় দুই একটি পার্টির কথা শোনা গেলেও ইংল্যান্ডের দেশপ্রেমিক বিজ্ঞ সচেতন জনগণ তাদের সামনে আসতে দেয় না। গণতন্ত্রের পরিশীলিত ধারায় অতি ঐতিহ্যর সাথে দুটি পার্টিকে তারা পর্যায়ক্রমিক ধারণ করে গণতন্ত্রের সুকুমার সৌকর্যকে বজায় রেখেছে। জনগণ যেমন ক্ষমতার লোভে সম্পদের লোভে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মতবাদী দল তৈরি করে লেবার পার্টি কিংবা কনজারভেটিভ পার্টিকে নিয়ে জোট মহাজোট তৈরি করে না তেমনি মহারানী কিংবা মহারাজা নিজ গদিকে চিরন্তন রাখতে কিংস পার্টি তৈরি করে দেশের জনগণকে বিভাজিত করে না- এটাই তাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির মুকুরে চিরনন্দিত একটি সৌন্দর্যের প্রতিচ্ছবি। দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখার, শক্তিশালী করার এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের উপর প্রভুত্ব না হলেও মুরব্বিয়ানা বজায় রাখা ইংরেজদের একটি ঐতিহ্যগত কৌশল- যে কৌশলের কারণে তারা প্রায় দুইশত বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের উপর কর্তৃত্ব চালিয়েও গণতন্ত্রের মর্যাদায় তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে পুনরায় আবার ওই সমস্ত দেশের সমন্বয়ে কমনওয়েলথ তৈরি করে তাদের ঐতিহ্যগত মুরব্বিয়ানা বজায় রেখেছে। এটাই রাজনীতি, এটাই রাজনৈতিক ভদ্রতা, শিষ্টাচার ও সভ্যতা, যা আমাদের মতো শিষ্টাচারবর্জিত রাজনীতিকদের দেশে কল্পনাও করা যায় না। আমরা কি শিক্ষা নিতে পারি না এসব দেশ-জাতি-রাষ্ট্র এবং তাদের জননন্দিত বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক রাজনীতিকদের কাছ থেকে!
চতুর্থত বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল)
১৯৭৫ সনে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে, ক্ষমতার অলিন্দে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বিচরণের জন্য সংঘটিত করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং ডানপন্থী ইসলামী ভাবধারার সংগঠন। জিয়ার বিএনপি মূলত এ ভাবধারাটি বাংলাদেশের ১৭ কোটি মুসলিম জনসমষ্টির ভাবধারার মূল্যবোধের সাথে কিছুটা সামঞ্জস্যশীল। কিছুটা বললাম এ কারণে, আসলে আল-ইসলাম কোনো জাতীয়তাবাদকে সমর্থন করে না। নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে আরব জাতীয়তাবাদের মূলোৎপাটন করে বিশ্ব ইসলামী খেলাফতে জাতীয়তাবাদকে চিরতরে অগ্রাহ্য করেছিলেন। যাহোক, বিএনপি কোনো ইসলামী দল নয়- সেহেতু তারা তাদের গঠনতন্ত্রের রাজনৈতিক কারণে জাতীয়তাবাদী তত্ত্ব গ্রহণ করতে পারে এটা তাদের মূল্যবোধের বিষয়, এদেশে বিএনপিও একক দল হিসেবে কেন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে পারেনি, তাদেরকেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাঝারি ধরনের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট-মহাজোট গঠন করে ক্ষমতার লাগাম হস্তগত করতে হয়েছে।
তবে এক্ষেত্রে বিএনপি মূলত দেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করেছে। আবার আঁতাত করতে এসে অনেক ইসলামী শক্তি হয় ভেঙেছে, না হয় জোটের আঁতাতে ক্ষমতা প্রলুব্ধতায় ছোট ছোট ইসলামী দলের নেতা সেজে জোট মহাজোটের স্বাদ নিতে প্রবৃত্ত হয়েছে। এখানে আবার ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ফেরকা এবং আকিদাগত মতভেদের কারণে কিছুটা ছোট ছোট দলকে বড় এবং প্রকৃত ইসলামী দলগুলোর বিরুদ্ধে হয় তারা উসকিয়ে দিয়ে না হয় ওই দলগুলো নিজেরা অতি উৎসাহী হয়ে ইসলামের মূল তরিকা ইসলামী আন্দোলন এবং রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব কায়েমে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রদর্শিত পথ থেকে দূরে যেয়ে নিজেদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে প্রকৃত ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে। এতে করে বিএনপি কিছুটা হলেও সুবিধাভোগীর স্থানে নিজেদের উন্নীত রেখে বামপন্থী ও ইসলামী দলগুলোর মধ্যে সূক্ষ্মভাবে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের ভূমিকাও তথৈবচ। তারাও ক্ষমতা আর ভোগের টোপ দিয়ে অনেক ডানপন্থী ও ছোটখাটো ইসলামী দলগুলোকে ভাণ্ডারি এবং কাণ্ডারি সাজিয়ে নিজেদের জোটে-মহা জোটে টানার অযাচিত কৌশল করেছে। এতে করে বিভাজিত হয়েছে জনগণ, নেতৃত্ব হয়েছে শতধাবিভক্ত বাংলাদেশে বড় বড় দলগুলো-যারা মূল নেতৃত্বের মর্যাদায় উন্নীত তারা কোনদিন দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার, একই সমতলে এনে দেশের ভাব গাম্ভীর্য, মর্যাদা রক্ষা করে শক্তিশালী জাতিতে পরিণত করার চেষ্টা করেনি। যার কারণে আক্ষেপ করে বলতে হয় আমরা এক জাতিগোষ্ঠী হয়ে বিড়াল কুকুরের মতো একে অপরকে, একদল আরেক দলকে দন্ত-নখরে কামড়াকামড়ি করে নিঃশেষ করার জঘন্য এবং আত্মঘাতী খেলায় নিয়োজিত হয়েছি। আর এ জাতীয় দুঃখজনক ঘটনার সুদূরপ্রসারী পরিণতি হলো বিজাতীয় শক্তির হস্তক্ষেপ, আধিপত্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণ এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে অতীতের মতো শত শত বছরের গোলামির জিঞ্জিরে শৃঙ্খলিত হওয়া- যার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি দেখা গিয়েছে, এদেশে ঘোষিত ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচন যা নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিদের নিরন্তর তৎপরতা। এর জন্য বলা যায় স্পষ্ট দায়ী এ দেশের ক্ষমতালিপ্সু অবিবেচক অহঙ্কারী তথাকথিত অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক শক্তি, তথাকথিত রাজনীতির এই জঘন্য কৌশল থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশের জনগণকে দিতে হতে পারে অযাচিত ও অপরিমেয় মাশুল।
লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক সংসদ সদস্য
আপনার মন্তব্য লিখুন