post

রাসূলুল্লাহ সা.

মু. রাজিফুল হাসান বাপ্পী

০২ এপ্রিল ২০২২

সপ্তম হিজরির মহররম মাস। আরবি বর্ষের প্রথম মাস এটি। চারিদিকে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ দাওয়াতের জন্য এমন সুন্দর বাধাহীন পরিবেশ ইতঃপূর্বে মুসলমানরা পায়নি। এইতো সেদিন, কয়েক বছর হলো মাত্র ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ (অর্থ- আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। মুহাম্মদ সা. আল্লাহর রাসূল।) এর দাওয়াত দিতে গিয়ে নিজ ভূমি মক্কায় নির্যাতিত হচ্ছিল তারা। নির্যাতিত হয়ে অবশেষে বাধ্য হয়েছিল মদিনায় হিজরত করতে। সেখানেও মিলেনি স্বস্তি। মুশরিক, মুনাফিক আর ইহুদিদের তুমুল বিরোধিতার মাঝে বাধাগ্রস্ত হয়েছিল দাওয়াতি কার্যক্রম। ফলে অনিবার্যভাবে পরপর তিনটি যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছে মুসলমানদের। বদর, ওহুদ আর খন্দক পেরিয়ে অবশেষে হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে মিলল দাওয়াতি কাজের সেই কাক্সিক্ষত পরিবেশ। তাইতো গেল বছর হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে অর্জিত এই পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে তাওহিদের দাওয়াত আরও বড় পরিসরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে দিতে বছরের প্রথম দিন পহেলা মহররম এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বিশ্বাসীদের নেতা মুহাম্মদ সা.। আর এই উদ্যোগটি হলো তৎকালীন আরবসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তরে থাকা প্রতাপশালী শাসকদের নিকট এক আল্লাহর বার্তা প্রেরণ। সার্বভৌমত্বের মালিক হিসেবে এক আল্লাহকে এবং সর্বশেষ নবী হিসেবে মুহাম্মদ সা.কে মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে পৃথিবীর প্রতাপশালী আট শাসকের নিকট পত্র প্রেরণ করেন সাইয়েদুল মুরসালিন। এসকল শাসক হলেন:
১. হাবশার শাসক নাজ্জাশি
২. বাহরাইনের শাসক মোনযের ইবনে সাওয়ার
৩. আম্মানের শাসক জিফার ও তার ভাই আবদ
৪. মিশর ও আলেকজান্দ্রিয়ার শাসক মোকাওকিস
৫. পারস্যের স¤্রাট কিসরা (মূল নাম খসরু পারভেজ)
৬. রোম স¤্রাট কায়সার (মূল নাম হিরাক্লিয়াস)
৭. দামেস্কের শাসক হারেস বিন আবি শেমার গাসসানি
৮. ইয়ামামার শাসক হাওযা বিন আলি

এসময় রাসূল সা. তার পক্ষ থেকে প্রেরিত পত্রসমূহে সিলমোহর মেরে দেন। সিলমোহর হিসেবে একটি রুপার আংটি তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে তিনটি লাইনে খোদাই করা ছিল-
আল্লাহ
রাসূল
মুহাম্মাদ
রাসূল সা.-এর নির্দেশে এসকল চিঠি নিয়ে পহেলা মহররম যাত্রা শুরু করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবিগণ।
হাবশার শাসক নাজ্জাশির নিকট রাসূল সা.-এর চিঠি বহন করে নিয়ে যান সাহাবি আমর ইবনে উমাইয়া যামরি রা.। এই চিঠিতে লেখা ছিল:
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি-
‘আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে হাবসার বাদশা নাজ্জাশির প্রতি। সালাম সেই ব্যক্তির উপর যিনি হিদায়াতের অনুসরণ করেন। আমি আপনার কাছে মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই। যিনি কুদ্দুস, যিনি সালাম, যিনি নিরাপত্তা ও শান্তি দেন, যিনি হেফাজতকারী ও তত্ত্বাবধানকারী।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, ঈসা ইবনে মারইয়াম আল্লাহর রূহ এবং তাঁর কালেমা। আল্লাহ তায়ালা তা পূত-পবিত্র সতী মারইয়ামের উপর স্থাপন করেছেন। আল্লাহর রূহ এবং ফুঁ-এর কারণে হযরত মারইয়াম (আ) গর্ভবতী হয়েছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা হযরত আদম (আ)কে নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন। আমি (আপনাকে) এক অদ্বিতীয় আল্লাহ এবং তাঁর আনুগত্যের প্রতি পরস্পরকে সাহায্যের দাওয়াত দিচ্ছি। এছাড়া একথার প্রতিও দাওয়াত দিচ্ছি, আপনি আমার আনুগত্য করুন এবং আমি যা কিছু নিয়ে এসেছি তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করুন। কেননা আমি আল্লাহর রাসূল, আমি আপনাকে এবং আপনার সেনাদলকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দিকে আহ্বান জানাচ্ছি। আমি দাওয়াত ও নসিহত করছি। কাজেই আমার দাওয়াত ও নসিহত কবুল করুন। (পরিশেষে) সালাম সেই ব্যক্তির উপর, তিনি হিদায়াতের আনুগত্য করেন।’

রাসূলুল্লাহ সা.-এর এ চিঠি নাজ্জাশির হাতে পৌঁছালে তিনি তা চোখে লাগান এবং তার আসন ছেড়ে নিচে নেমে আসেন। অতঃপর নাজ্জাশি রাসূলুল্লাহ সা.-এর চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবু তালিবের হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর রাসূলুল্লাহ সা.-এর চিঠির জবাবে নাজ্জাশি লিখেন:
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
‘আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের নামে, নাজ্জাশি আসহামার পক্ষ থেকে। হে আল্লাহর নবী, আপনার উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম, তার রহমত ও বরকত নাজিল হোক। সেই আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি ব্যতীত ইবাদতের উপযুক্ত কেউ নেই। অতঃপর, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার চিঠি আমার হাতে পৌঁছেছে। এই চিঠিতে আপনি হযরত ঈসা (আ) সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। আসমান জমিনের মালিক আল্লাহর শপথ, আপনি যা কিছু উল্লেখ করেছেন হযরত ঈসা (আ)-এর চেয়ে বেশি কিছু ছিলেন না। তিনি সেই তেমনি ছিলেন আপনি যেমন উল্লেখ করেছেন। আপনি আমার কাছে যা কিছু লিখে পাঠিয়েছেন, আমি তা জেনেছি এবং আপনার চাচাতো ভাই ও আপনার সাহাবিদের মেহমানদারি করছি। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর সত্য ও খাঁটি রাসূল। আমি আপনার কাছে বাইয়াত করছি, আপনার চাচাতো ভাইয়ের হাতে বাইয়াত করেছি এবং তার হাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য ইসলাম কবুল করেছি।’
এভাবেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন নাজ্জাশি।

বাহরাইনের শাসক মোনযের ইবনে সাওয়ারের নিকট রাসূলুল্লাহ সা.-এর দাওয়াতি চিঠি নিয়ে যান সাহাবি হযরত আলা ইবনে হাযরামি। চিঠি পেয়ে তিনি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্যকে মেনে নিয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। অতঃপর রাসূল সা.-এর উদ্দেশ্যে নির্দেশনা চেয়ে লিখেন:
‘হে আল্লাহর রাসূল, আপনার চিঠি আমি বাহরাইনের অধিবাসীদের পড়ে শুনিয়েছি। কিছু লোক ইসলাম পছন্দ করেছে, একে পবিত্রতার দৃষ্টিতে দেখেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করেছে। আবার কিছু লোক তা অপছন্দ করেছে। এখানে ইহুদি এবং অগ্নি উপাসকরাও রয়েছে। আপনি ওদের ব্যাপারে আমাকে নির্দেশ দিন।’
মোনযেরের এই বার্তা পেয়ে প্রতি-উত্তরে চিঠি লিখেন আল্লাহর রাসূল সা., যেখানে তিনি বলেন,
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
‘আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে মোনযের ইবনে সারওয়ার নামে।
আপনার প্রতি সালাম। আমি আপনার কাছে আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি ব্যতীত ইবাদত পাওয়ার উপযুক্ত কেহ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। অতঃপর আমি আপনাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি ভালো কাজ করবে সে তার নিজের জন্যই করবে। যে ব্যক্তি আমার দূতদের আনুগত্য করবে এবং তাদের আদেশ মান্য করবে, সে ব্যক্তি আমারই আনুগত্য করেছে। যারা আমার দূতদের সাথে ভালো ব্যবহার করবে তারা আমার সাথেই ভালো ব্যবহার করেছে বলে মনে করা হবে। আমার দূতরা আপনার প্রশংসা করেছেন। আপনার জাতির সম্পর্কে আপনার সুপারিশ আমি গ্রহণ করেছি। কাজেই মুসলমানরা যে অবস্থায় ঈমান এনেছে তাদের সে অবস্থায় ছেড়ে দিন। আমি দোষীদের ক্ষমা করে দিয়েছি, আপনিও তাদের ক্ষমা করুন। আপনি যতদিন সঠিক পথ অনুসরণ করবেন, ততদিন আমি আপনাকে স্বপদ থেকে বরখাস্ত করব না। যারা ইহুদি দ্বীন ও অগ্নি উপাসনার ওপর কায়েম রয়েছে, তাদের কাছ থেকে জিজিয়া আদায় করুন।’

এখানে রাসূল সা.-এর এই চিঠির মাঝে রাসূলের অনুপস্থিতিতে তাঁর প্রতিনিধিদের আনুগত্য করার বিষয়টি উঠে এসেছে, যারা নওমুসলিম তাদের পূর্ববর্তী অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দেওয়ার বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে এবং যারা ইসলামকে গ্রহণ করেনি তবে ইসলামী শাসনব্যবস্থার অধীনে বসবাস করছে তাদেরকে জিজিয়া কর আদায়ের বিষয়ে নির্দেশ পাওয়া যায়। আর এ সবগুলো বিষয় ইসলামের শান্তিপূর্ণ নীতির কিছু অনন্য দৃষ্টান্ত।
আম্মানের শাসক জিফার ও তার ভাই আবদের উদ্দেশ্যে লেখা রাসূলুল্লাহর দাওয়াতি চিঠি বহন করে নিয়ে যান সাহাবি আমর ইবনুল আস রা.। আম্মানে পৌঁছে বাদশা জিফারের ছোট ভাই আবদের হাতে চিঠি তুলে দেন আমর। আবদ চিঠি ও রাসূলুল্লাহ সা. সম্পর্কে অনেক বিষয় আমরের নিকট জানতে চান। আমর যথাযথভাবে আবদের সকল জিজ্ঞাসার জবাব দিয়ে যাচ্ছিলেন। কথোপকথনের এক পর্যায়ে আবদ বললেন: ‘আচ্ছা বলুন তিনি (মুহাম্মাদ সা.) কি কাজের আদেশ দেন আর কি কাজ করতে নিষেধ করেন?’
আমর: ‘তিনি আল্লাহ তায়ালার আনুগত্যের আদেশ প্রদান করেন এবং তার নাফরমানি থেকে নিষেধ করেন। প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ভালো ব্যবহার করার আদেশ দেন। জুলুম, অত্যাচার, বাড়াবাড়ি ব্যভিচার, মদপান এবং পাথরের মূর্তি ও ক্রুশ-এর উপাসনা করতে নিষেধ করেন।’
আবদ: ‘তিনি যেসব কাজের আদেশ করেন এর সবই তো ভালো কাজ। আমার ভাই যদি আমার অনুসরণ করবেন বলে ভরসা পেতাম, তবে আমরা সওয়ার হয়ে মদিনায় ছুটে যেতাম এবং মুহাম্মদ সা.-এর উপর ঈমান আনতাম। কিন্তু রাজত্বের ওপর আমার ভাইয়ের প্রবল লোভ, তিনি রাজত্ব হারানোর ভয়ে অন্য কারো আনুগত্য মেনে নেবেন কিনা, সন্দেহ রয়েছে।’
আমর: ‘তিনি (আপনার ভাই) যদি ইসলাম গ্রহণ করেন তবে আল্লাহর রাসূল তাকেই তার বাদশাহিতে বহাল রাখবেন। তবে তাকে একটা কাজ করতে হবে, ধনীদের কাছ থেকে সদকা আদায় করে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে।’
অতঃপর আবদের সহযোগিতায় বাদশার কাছে যান রাসূলের বার্তাবাহক আমর ইবনুল আস।
বাদশা আমরকে উদ্দেশ্য করে বললেন: ‘বলুন কী বলতে চান।’
আমর তার হাতের চিঠিটি বাদশার হাতে তুলে দেন। বাদশা তখন চিঠিখানা পড়লেন। যে চিঠিতে লেখা ছিল-
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
‘আবদুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে জুলানদির দুই পুত্র জিফার আবদের নামে।
সালাম সেই ব্যক্তির উপর, যিনি হিদায়াতের অনুসরণ করেন। অতঃপর আমি আপনাদের দুজনকেই ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, শান্তিতে থাকবেন। কেননা আমি সকল মানুষের প্রতি আল্লাহর রাসূল। যারা জীবিত আছে তাদের (পরকালীন) পরিণামের ভয় দেখানো এবং কাফেরদের জন্য আল্লাহর কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য আমি কাজ করছি। ইসলাম গ্রহণ করলে আপনাদেরকেই শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখা হবে। আর যদি (ইসলামকে) অস্বীকৃতি জানান তবে আপনাদের বাদশাহি শেষ হয়ে যাবে। আপনাদের ভূখণ্ড অশ্বের হামলার শিকার হবে, আপনাদের বাদশাহির উপর আমার নবুয়াত বিজয়ী হবে।’১
বাদশা এই চিঠি পড়ার পর এটি তার ভাই আবদের হাতে দিলেন। অতঃপর বাদশা বার্তাবাহক আমরের কাছে আল্লাহর রাসূল ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা নতুন অনুসারীদের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। আমরের নিকট হতে সবকিছু শোনার পর বাদশা বললেন: ‘আপনি আগামীকাল আমার সাথে দেখা করুন।’
পরের দিন আমর বাদশার কাছে গেলে তিনি বললেন: ‘আপনার উপস্থিত দাওয়াত সম্পর্কে আমি ভেবে দেখেছি। আমি যদি বাদশাহি এমন একজনের কাছে ন্যস্ত করি যার সৈন্যবাহিনী এখনো (আম্মানে) পৌঁছেনি, তবে আমি আরবে সবচেয়ে দুর্বল ও ভীরু বলে পরিচিত হব। আর যদি তার সৈন্যরা এখানে এসেই পড়ে, তবে আমরা তাদের যুদ্ধের সাধ মিটিয়ে দেবো।’
এ কথা শুনে আমর বললেন: ‘ঠিক আছে আমি আগামীকাল ফিরে যাচ্ছি।’
আমরের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে বাদশা যখন নিশ্চিত হলেন, তখন তার ভাই আবদের সাথে গোপনে পরামর্শ করেন। এসময় বাদশাহ তার ভাইকে বললেন: ‘এ রাসূল যাদের উপর বিজয়ী হয়েছে, তাদের তুলনায় আমরা কিছুই না। তিনি যার কাছেই পয়গাম পাঠিয়েছেন তিনিই দাওয়াত কবুল করেছেন।’
অতঃপর পরদিন সকালে আমরকে বাদশার দরবারে ডাকা হলো এবং বাদশা ও তার ভাই আমরের নিকট ইসলাম গ্রহণ করেন। বাদশার ইসলাম গ্রহণের পর আম্মানের অভ্যন্তরীণ সাদকা আদায় ও বাদি-বিবাদির মধ্যে ফয়সালা করার দায়িত্ব আমর ইবনুল আসের নিকট অর্পণ করেন।
উল্লেখ্য এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেখে বিশেষজ্ঞগণ মতামত প্রকাশ করেছেন যে, সম্ভবত এই চিঠি মক্কা বিজয়ের পর প্রেরণ করা হয়েছিল।
রাসূলের চিঠি পাওয়া উপরোক্ত তিনজন শাসক ইসলাম গ্রহণ করে শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় নেন।
এছাড়া অন্য সকল শাসক ইসলাম গ্রহণ করেননি। তাদের মধ্যে পারস্যের স¤্রাট খসরু পারভেজ রাসূল সা.-এর চিঠির বার্তা শোনার পর তা ছিঁড়ে ফেলে দেয় এবং দাম্ভিকতা প্রকাশ করে বলে উঠে, ‘আমার প্রজাদের মধ্যে একজন সাধারণ প্রজা নিজের নাম আমার নামের আগে লিখেছে।’
অতঃপর কিসরার এই প্রতিক্রিয়ার খবর জানার পর রাসূল সা. বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তার বাদশাহি ছিন্নভিন্ন করে দিন।’
পরবর্তীতে একটা সময় আল্লাহর রাসূলের একথা সত্যে পরিণত হয়েছিল।
রোম স¤্রাট হিরাক্লিয়াসের কাছে রাসূল সা.-এর চিঠি পৌঁছলে তিনি মক্কার একটি বাণিজ্য প্রতিনিধিদলকে তার দরবারে তলব করেন। উদ্দেশ্য হলো মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে বিস্তারিত জানা। এ সময় রাসূলের বংশের দিক থেকে নিকটবর্তী আবু সুফিয়ানের নিকট থেকে দোভাষীর মাধ্যমে মুহাম্মাদ সা.-এর বংশমর্যাদা, সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা, নেতৃত্ব ও অনুসারীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন রোম স¤্রাট কায়সার।
অতঃপর কায়সার মন্তব্য করে বলেন, ‘তুমি (আবু সুফিয়ান) যা কিছু বলছো, যদি এসব সত্য হয়ে থাকে, তবে তিনি খুব শিগগিরই আমার দুই পায়ের নিচের জায়গারও মালিক হয়ে যাবেন। আমিও জানতাম এমন একজন নবী আসবেন। কিন্তু আমার একথা ধারণা ছিল না যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকে আসবেন। আমি যদি নিশ্চিত জানতে পারতাম যে তার কাছে পৌঁছাতে পারবো, তবে অবশ্যই তার সাথে সাক্ষাতের কষ্ট স্বীকার করতাম এবং তার দুই চরণ ছুঁয়ে দিতাম।’
অতঃপর হিরাক্লিয়াস রাসূলের প্রেরিত চিঠি দরবারে উপস্থিত সকলের সামনে পাঠ করা শুরু করেন। চিঠি পড়া শেষ হতেই উপস্থিত সকলের মাঝে উচ্চকণ্ঠে শোরগোল শুরু হয়ে যায়। এ সময় দরবারিদের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে নিজের অবস্থান হারানোর ভয়ে ইসলামের সত্যকে অনুধাবন করার পরও ঈমানের স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকলো রোম স¤্রাট হিরাক্লিয়াস।
দামেস্কের শাসক হারেস বিন আবি শেমার গাসসানির হাতে রাসূল সা.-এর চিঠি পৌঁছলে তিনি বলে উঠলেন, ‘আমার বাদশাহি আমার কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে? শিগগিরই আমি তার বিরুদ্ধে হামলা করতে যাচ্ছি।’
একথা বলে তিনি ইসলাম গ্রহণ থেকে বিরত থাকলেন।
ইয়ামামার শাসক হাওযা বিন আলীকে মুহাম্মাদ সা. প্রেরিত চিঠি পড়ে শোনানোর পর তিনি নিজের অবস্থান কিছুটা অস্পষ্ট রেখে রাসুলের সা. উদ্দেশে এই বার্তা প্রেরণ করেন যে, ‘আপনি যে বিষয়ের দাওয়াত দিচ্ছেন তার কল্যাণ ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীত। আরবদের উপর আমার প্রভাব রয়েছে। তাই আপনি আমাকে কিছু কাজের দায়িত্ব দিন, আমি আপনার আনুগত্য করব।’
অতঃপর রাসূল সা.-এর নিকট হাওয়ার বার্তা পৌঁছলে তিনি তা পাঠ করে এ মন্তব্য করেন যে, ‘‘সে যদি আমার কাছে এক টুকরো জমিও চায়, তবুও আমি তাকে তা দেবো না। সে নিজেও ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তার হাতে রয়েছে, ঐসবও ধ্বংস হবে।’
উল্লেখ্য পরে রাসূল সা. মক্কা বিজয় করে মদিনায় ফিরে এলে জিবরাইল (আ) এ সংবাদ নিয়ে হাজির হলেন, ‘হাওযা মারা গেছে।’
মিশরের শাসক মোকাওকিসের নিকট রাসূলের বার্তা নিয়ে তিনি তা পাঠ করেন এবং দাওয়াতের বিষয় দূত হাতেব ইবনে আবি বালতায়ার রা.-এর সাথে আলাপচারিতা করেন। অতঃপর ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো জবাব না দিয়ে আল্লাহর রাসূল সা.-এর উদ্দেশে এই বার্তা প্রেরণ করেন যে, ‘আপনার প্রতি সালাম। আমি আপনার চিঠি পাঠ করেছি এবং চিঠির বক্তব্য ও দাওয়াত বুঝেছি। আমি জানি এখনো একজন নবী আগমনের বাকি রয়েছেন। তবে আমি ধারণা করেছিলাম তিনি সিরিয়া থেকে আবির্ভূত হবেন। আমি আপনার দূতকে সম্মান করেছি। আপনার খেদমতে দু’জন দাসী পাঠাচ্ছি। কিবতীয়দের মধ্যে তাদের যথেষ্ট মর্যাদা রয়েছে। আপনার জন্য কিছু পোশাক এবং সওয়ারির জন্য একটি খচ্চর হাদিয়া হিসেবে পাঠাচ্ছি। আপনার প্রতি সালাম।’
উল্লেখ্য দুজন দাসী ছিল মারিয়া কিবতিয়া ও সিরিন। এদের মধ্য থেকে মারিয়াকে রাসূল সা. স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন, যার গর্ভে পরবর্তীতে রাসূলপুত্র ইবরাহিম জন্মগ্রহণ করেছিল।
তৎকালীন আরব ও এর পার্শ্ববর্তী শাসকদের নিকট প্রেরিত রাসূল সা.-এর চিঠিসমূহ একটু সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে দেখা যায়, এক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আনুগত্যের দিকেই আহ্বান করা হয়েছিল। ইসলাম গ্রহণ করলে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং শাসকদের স্বপদে বহাল রাখার বিষয়টিও উল্লেখ হয়েছে। আর ইসলাম গ্রহণ না করলে দুনিয়ায় পরাজয় ও পরকালীন বিপর্যয়ের কথা বর্ণিত হয়েছে।
রাসূল সা.-এর চিঠির এসকল কথাগুলো প্রায় সকল শাসকই যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তবে দাম্ভিকতা আর দুনিয়াবি (রাজত্বের) ক্ষমতার লোভে অনেকেই বিরত থেকেছে ইসলাম গ্রহণ থেকে। তবে শান্তির ধর্ম হতে দূরে থেকে ঠেকাতে পারেনি তাদের পরাজয়কে। বরং এটিই ছিল তাদের রাজত্ব হারানোর প্রধান কারণ। আর বুদ্ধিমান শাসকরা দাম্ভিকতা পরিহার করে ইসলামকে গ্রহণ করে নিয়েছিল। ফলে পেয়েছিল দুনিয়া শাসনের দায়িত্ব আর পরবর্তী জীবনে চূড়ান্ত সফলতার নিশ্চয়তা। (আর রাহিকুল মাখতুম ৪১৪-৪২৯ পৃষ্ঠা; রাহমাতুল্লিল আলামিন, প্রথম খণ্ড, ১৭১ পৃষ্ঠা; বুখারি, দ্বিতীয় খণ্ড, ৮৭২-৮৭৩ পৃষ্ঠা; মুসলিম, দ্বিতীয় খণ্ড; ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খণ্ড; যাদুল মায়াদ, দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় খণ্ড ৬১-৬৩ পৃষ্ঠা; রাসূলুল্লাহ সা. কি সিয়াসি জিন্দেগি)
লেখক : সাবেক নির্বাহী সম্পাদক, ছাত্র সংবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির