post

রাসূলুল্লাহ সা. এর হিজরত

মুহাদ্দিস ডক্টর এনামুল হক

৩১ মে ২০২২

মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা.-এর ওপর ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে আল্লাহর সুমহান বাণী আল কুরআন নাজিল হয়। নবুয়্যাতপ্রাপ্তির পর রাসূলুল্লাহ সা. তিন বছর গোপনে ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রচার করেন। তারপর আল্লাহর নির্দেশে প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেন। আর তখনই ঘটে বিপত্তি। অবিশ্বাসীদের কাছে প্রকাশ্য শত্রু বনে যান বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সা.। তারা বিভিন্নভাবে নবীজির ক্ষতি করার চেষ্টা করে। নানা প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে মক্কায় ১৩ বছর ইসলামের দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করেন বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা.। এরপর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর মাক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে হিজরত করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোতাবেক ৮ রবিউল আউয়াল মদিনার পার্শ্ববর্তী কোবায় পৌঁছান তিনি। ২৭ সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল মদিনা মুনাওয়ারায় পৌঁছান মহানবী সা.। প্রিয়নবী সা.-এর হিজরত থেকেই মূলত আরবি হিজরি সন প্রবর্তিত হয়। 


প্রাথমিক হিজরত

প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত প্রদানের প্রেক্ষিতে মুসলিমদের ওপর কুরাইশ কাফিরদের অমানবিক অত্যাচার-নির্যাতন ক্রমেই বাড়তে থাকে। অত্যাচারের জাঁতাকলে মুসলিমদের জীবন মক্কায় অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে। তাদের এহেন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে নবুওয়্যাতের পঞ্চম বর্ষে রজব মাসে ১১ জন পুরুষ ও ৪ জন মহিলা মিলে ১৫ জনকে আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দেন। তাঁরা হলেন, উসমান ইবন আফফান রা. ও তাঁর স্ত্রী ও নবীকন্যা রুকাইয়্যা রা., আবু হুজাইফা ইবন উতবা ও তাঁর স্ত্রী সাহলা, যুবাইর ইবন আওয়্যাম রা., মুসআব ইবন উমাইর রা., আবদুর রহমান ইবন আউফ রা., আবু সালামা আল মাখজুমী ও তাঁর স্ত্রী সালামা রা., উসমান ইবন মাজউন রা., আমির ইবন আবি রাবিয়া ও তাঁর স্ত্রী লায়লা রা., আবু সাবরা ইবন আবু রাহম রা., হাতিব ইবন আমির রা. ও সুহাইল ইবন বাইদা রা.। ইবন সাদ ও অন্যান্য ইতিহাসবিদগণের মতে, আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা.ও এ দলের সাথে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। সে মতে পুরুষের সংখ্যা ১২ জন। মোট হিজরতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ জনে। পরে জাফর ইবন আবি তালিব রা. সস্ত্রীক তাঁদের সাথে যুক্ত হন। (আত ত্বাবাকাতুল কুবরা, ইবন সাদ, ১ম খণ্ড, পৃ: ২০৪; আল কামিল ফিত তারিখ, ইবনুল আছির, ২য় খণ্ড, পৃ: ৭৭)

দ্বিতীয় পর্যায়ে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন ৮০ জন সাহাবি। ভিন্ন মতে ৮৩ জন। আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশি মুহাজিরদের আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেন এবং তাঁদের সাথে অত্যন্ত সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করেন। (শারহুল মাওয়াহিবুল লাদুননিয়াহ, মুহাম্মদ জুরকানী, ১ম খণ্ড, পৃ: ৩২৭; আর রউদুল উনুফ, সুহাইলি, ১ম খণ্ড, পৃ: ২১১)


মদিনায় হিজরতের বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশনা

অসহনীয় জুলুমে উত্তপ্ত মক্কার পরিবেশ। কুরাইশ কর্তৃক মুসলিমদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন ও জুলুমের মহোৎসব চলছে। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে সাহাবায়ে কিরাম জর্জরিত হচ্ছিলেন। কাফিররা তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এমন জঘন্য পরামর্শ সভা অত্যন্ত গোপনে করে মুহাম্মদ সা.কে হত্যার মত নিতান্ত ভয়াবহ ও লোমহর্ষক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এটা ছিল কুরাইশ কাফিরদের চক্রান্ত। অন্যদিকে আল্লাহ তায়ালাও কৌশল অবলম্বন করলেন। তাদেরকে এমনভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া হলো যে তারা বুঝতেও পারল না। তখন জিবরাঈল (আ) মহান ও বরকতময় প্রভুর তরফ থেকে আল্লাহর বাণী নিয়ে তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন এবং তাকে কুরাইশ মুশরিকদের ষড়যন্ত্রের কথা জনালেন। তিনি বললেন যে, ‘আপনার রব মক্কা থেকে হিজরত করার অনুমতি প্রদান করেছেন। জিবরাঈল (আ) তাঁকে হিজরতের সময় নির্ধারণ করে দিলেন এবং কুরাইশদের কিভাবে প্রতিহত করতে হবে তা বলে দিলেন। অতঃপর বললেন, আপনি এ যাবৎ যে শয্যায় শয়ন করে এসেছেন আজ রাতে সে শয্যায় শয়ন করবেন না। (তারিখুর রাসূল ওয়াল মুলুক, ইবন জরির আত ত্বাবারী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৩৭২; সিরাতুন নববয়্যিাহ, ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৮২; যাদুল মায়াদ ২য় খণ্ড, পৃ: ৫২)। হিজরত সংক্রান্ত আল্লাহর বাণী প্রাপ্ত হওয়ার পর মহানবী সা. ঠিক দুপুরে আবু বকর রা.-এর গৃহে তশরিফ আনয়ন করলেন। উদ্দেশ্য ছিল, হিজরতের সময় এবং পন্থা প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। আয়িশা রা. বর্ণনা করেছেন, আমরা আব্বার (আবু বকর রা.-এর) বাড়িতে ঠিক দুপুরে বসেছিলাম তখন এক ব্যক্তি এসে খবর দিল যে, নবী কারীম সা. মাথা ঢেকে আগমন করছেন। এটা দিবা ভাগের এমন সময় ছিল যে সময় রাসূলুল্লাহ সা. সাধারণত কোথাও যেতেন না। আবু বকর রা. বললেন ‘আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি এ সময় কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার জন্য আগমন করেছেন?’ আয়িশা রা. বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. ভিতরে আসার অনুমতি চাইলেন, তাঁকে ভিতরে আসার অনুমতি দেওয়া হলে তিনি ভিতরে প্রবেশ করলেন। তারপর আবু বকর রা.কে বললেন, ‘আপনার কাছে যে সকল লোক রয়েছে তাদের সরিয়ে দিন।’ আবু বকর বললেন, ‘যথেষ্ট, আপনার গৃহিণী ছাড়া এখানে আর কেউই নেই। আপনার প্রতি আমার মাতা-পিতা কুরবান হোক, হে আল্লাহর রাসূল সা.। তিনি বললেন, ‘ভালো, হিজরত করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের তরফ থেকে আমাকে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে।’ অন্যত্র সহীহ সনদে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. মক্কায় অবস্থান করছিলেন। অতঃপর হিজরতের নির্দেশ দেওয়া হলো। আল্লাহর বাণী, “এবং বলো, হে আমার রব! আমাকে যেখানেই তুমি নিয়ে যাও সত্যের সাথে নিয়ে যাও এবং যেখান থেকেই বের করো সত্যতার সাথে বের করো। আর আমার পক্ষ থেকে একটি কর্তৃত্বশীল পরাক্রান্ত শক্তিকে আমার সাহায্যকারী বানিয়ে দাও।” (সূরা ইসরা : ৮০; বুখারি-৩৬৩৮, ৩৬৮৯; মুসলিম-২৩৫১) 


হিজরতের প্রস্তুতি 

ঠাট্টা-বিদ্রƒপ, খানায়ে কা‘বায় সালাত আদায়ে বাধা ও নানাবিধ কষ্ট দানের পরও কোনভাবে রাসূলুল্লাহ সা.কে দমিত করতে না পেরে অবশেষে তারা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। যেটা ছিল হিজরতের প্রত্যক্ষ কারণ। হাদিসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বলেন, কুরাইশ নেতাদের একটি দল হিজরে একত্রিত হয়। অতঃপর লাত, মানাত ও ‘উযযার নামে শপথ করে বলে যে, এবার আমরা মুহাম্মাদকে দেখলে একযোগে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ব এবং হত্যা না করা পর্যন্ত তাকে ছেড়ে আসব না’। একথা জানতে পেরে ফাতিমা কাঁদতে কাঁদতে পিতার কাছে এলেন এবং উক্ত খবর দিয়ে বললেন যে, ঐ নেতারা আপনাকে হত্যা করে রক্তমূল্য নিজেরা ভাগ করে পরিশোধ করবে। রাসূল সা. বললেন, বেটি! আমাকে ওজুর পানি দাও। অতঃপর ওজু করে তিনি সোজা মসজিদুল হারামে চলে গেলেন ও তাদের মজলিসে প্রবেশ করলেন। তারা তাঁকে দেখে বলে উঠল, এই তো সে ব্যক্তি। কিন্তু কেউ তাঁর দিকে চোখ তুলে তাকাতে বা উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে সাহস করল না। এ সময় তিনি তাদের দিকে এক মুষ্টি মাটি ছুড়ে মেরে বলেন, ‘চেহারাসমূহ ধূলিমলিন হোক’! রাবী বলেন, ঐ মাটি যার গায়েই লেগেছিল, সেই-ই বদরের যুদ্ধে কাফির অবস্থায় নিহত হয়েছিল। (মুসনাদু আহমাদ-২৭৬২, ৩৪৮৫; আল মুসতাদরাক আলাস সহিহাইন লিল হাকম-৫৮৩, ৪৭৪২; সহীহ ইবন হিব্বান-৬৫০২)

উল্লেখ্য যে, হজরত নূহ, ইবরাহীম ও মূসা (আ) আল্লাহর পথে চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। অন্যদের মধ্যে বহু সংখ্যক নবীকে সরাসরি হত্যা করা হয়েছে। অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ সা.কে হত্যা করতে সক্ষম না হলেও তাকে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। যেমন, হাদিসে এসেছে, “আনাস ইবন মালিক রা. হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা.-এরশাদ করেন, আমাকে আল্লাহর পথে যেভাবে ভীত করা হয়েছে এমনটি কাউকে করা হয়নি। আমি আল্লাহর পথে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছি, এমনটি কেউ হয়নি। মাসের ত্রিশটি দিন ও রাত আমার ও আমার পরিবারের কোনো খাদ্য জোটেনি। বেলালের বগলে যতটুকু লুকানো সম্ভব ততটুকু খাদ্য ব্যতীত’ (অর্থাৎ খুবই সামান্য)।” (মুসনাদু আহমাদ-১২২১২, ১৪০৫৫; তিরমিজি-২৪৭২)

বলা বাহুল্য এভাবে চূড়ান্ত পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়ার পরেই আল্লাহ তাঁকে হিজরতের অনুমতি দেন।


রাসূলুল্লাহ সা.-এর বাড়ি ঘেরাও 

একদিকে রাসূলুল্লাহ সা. যখন হিজরতের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলেন, অন্যদিকে মক্কার পাপিষ্ঠরা দারুণ নাদওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকল। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নিম্নোক্ত এগারো জন পাপীষ্ঠকে নির্বাচন করা হলো। তাদের নাম হচ্ছে যথাক্রমে : (১) আবু জাহল বিন হিশাম, (২) হাকাম ইবন আবিল ‘আস, (৩) উক্ববা বিন আবু মু’আইত্ব, (৪) নাযর ইবন হারিস (৫) উমাইয়া ইবন খাআফ, (৬) যাম’আহ বিন আসওয়াদ, (৭) তু’আইইমা বিন আদী, (৮) আবু লাহাব, (৯) উবাই বিন খালাফ, (১০) নুবাইহ বিন হজাজ এবং তার ভাই (১১) মুনাব্বিহ ইবন হজাজ। (যা’দুল মাহদ ২য় খণ্ড, পৃ: ৫২)

রাসূলুল্লাহ সা.-এর স্বভাবগত অভ্যাস ছিল তিনি নিয়মিতভাবে ইশার সালাত পর রাতের প্রথম প্রহরে ঘুমিয়ে যেতেন এবং অর্ধ রাতে জেগে মসজিদুল হারামে চলে যেতেন। তিনি সা. সেখানে তাহজুদের সালাত আদায় করতেন। রাসূলুল্লাহ সা. আলী রা.কে বললেন, ‘তুমি আমার এ সবুজ হাযরামী (হাজমারাউতের দক্ষিণ ইয়ামানের তৈরি চাদরকে হাজরামী চাদর বলা হয়।) চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাক। তারা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। অতঃপর রাতের এক-তৃতীয়াংশ গত হলো, ধরণীতে নিস্তব্ধতা নেমে এল এবং অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে পড়ল, এমন সময় উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ অতি গোপনে রাসূলুল্লাহ সা.-এর বাড়িতে হাজির হলো। তাঁকে বাধা দেওয়ার জন্য তারা রাসূলুল্লাহ সা.-এর ঘরের দরজায় অবস্থান করলো। তাদের ধারণা ছিল, রাসূলুল্লাহ সা. ঘুমিয়ে আছেন, তিনি যখনই বের হবেন তারা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের চক্রান্ত বাস্তবায়ন করবে। তাদের এ ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও কার্যকর করার ব্যাপারে তাদের অবস্থা এতই দৃঢ় ছিল যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা কেল্লাহ ফতেহ করে দেবে। আবু জাহল চরম অহংকার, উপহাস ও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মহানবী সা.-এর গৃহ ঘেরাওকারী আপন সাথীদের বলল, মুহাম্মাদ সা. বলছে যে, যদি তোমরা তার ধর্মে প্রবেশ কর, তার অনুসরণ কর তাহলে অনারবদের ওপর আরবদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। মৃত্যুর পরে আবার যখন তোমাদের উঠানো হবে তখন উরদুনের বাগানসমূহের মতো বাগান দেওয়া হবে। আর যদি তোমরা তা না কর তাহলে তার পক্ষ থেকে তোমাদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো হবে। আর এ অবস্থায় মৃত্যুর পর আবার যখন তোমাদের উঠানো হবে তখন ঠিকানা হবে জাহান্নাম। সেখানে না কি অনন্ত কাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৮৩)। যাহোক, জঘন্যতম এ পাপাচার অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত সময় ছিল রাত দুপুরের পরক্ষণ। এ জন্য তারা রাত জেগে সময় কাটাচ্ছিল এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রতীক্ষারত ছিল। কিন্তু আল্লাহর ব্যবস্থাই হচ্ছে চূড়ান্ত এবং তাঁর বিজয়ই হচ্ছে প্রকৃত বিজয়। তাঁরই একক এখতিয়ারে রয়েছে আসমান ও জমিনের একচ্ছত্র আধিপত্য। তিনি যা চান তাই করেন। তিনি যাঁকে বাঁচাতে চান কেউই তাঁর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না। আবার তিনি যাকে পাকড়াও করতে চান পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাকে রক্ষা করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে নিম্নের আয়াতে কারিমায় রাসূলুল্লাহ সা.কে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, “স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন কাফিরগণ তোমাকে বন্দী করার কিংবা হত্যা করার কিংবা দেশ থেকে বের করে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে। তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহও কৌশল করেন। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।” (সূরা আনফাল : ৩০) সহীহ হাদিসে এসেছে, “আবু মূসা আল আশয়ারী রা. হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সা. হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি স্বপ্নে দেখতে পেলাম, আমি মক্কা হতে হিজরত করে এমন জায়গায় যাচ্ছি যেখানে বহু খেজুর গাছ রয়েছে। তখন আমার ধারণা হলো, এ স্থানটি ইয়ামামা অথবা হাজর হবে। স্থানটি মদিনা ছিলো, যার পূর্ব নাম ইয়াসরিব।” (বুখারি- ৩৪২৫, ৬৬২৯; মুসলিম-৬০৭২; মিশকাতুল মাসাবিহ-৪৬১৮)


হিজরতের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সা.-এর বাড়ি ত্যাগ

কুরাইশ মুশরিকগণ তাদের দুরভিসন্ধি বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও চরমভাবে ব্যর্থ হয়ে গেল। উন্মত্ত জিঘাংসু শত্রু পরিবেষ্টিত রাসূলুল্লাহ সা. আলী রা.কে বললেন, ‘তুমি আমার এ সবুজ হাজরামী (হাজরামাউতের দক্ষিণ ইয়ামানের তৈরি চাদরকে হাজরামী চাদর বলা হয়) চাদর গায়ে দিয়ে আমার বিছানায় ঘুমিয়ে থাকো। তারা তোমার ক্ষতি করতে পারবে না।’ রাসূলুল্লাহ সা. এ চাদর গায়ে দিয়েই শুয়ে থাকতেন। (ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৮২-৪৮৩)। তারপর মহানবী সা. গৃহের বাহিরে গমন করলেন এবং মুশরিকদের কাতার ফেঁড়ে এক মুষ্টি কঙ্করযুক্ত মাটি নিয়ে তাদের মাথার উপর ছড়িয়ে দিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের দৃষ্টি ধরে রাখলেন যার ফলে তারা রাসূলুল্লাহ সা.কে আর দেখতে পেল না। এ সময় তিনি এ আয়াতে কারিমাটি পাঠ করছিলেন, ‘তাদের সামনে আমি একটা (বাধার) প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, আর পেছনে একটা প্রাচীর, উপরন্তু তাদেরকে ঢেকে দিয়েছি; কাজেই তারা দেখতে পায় না।’ (সূরা ইয়াসিন : ৯) এ সময় এমন কোনো মুশরিক বাকি ছিল না যার মাথায় তিনি মাটি নিক্ষেপ করেননি। এরপর তিনি আবু বকর রা.-এর বাড়ি গমন করলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে সঙ্গে নিয়ে ইয়েমেন অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারপর রাতের অন্ধকার থাকতেই তাঁরা মক্কা থেকে কয়েক মাইল দূরত্বে ‘সাওর’ নামক পর্বত গুহায় গিয়ে পৌঁছলেন। (ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৮৩; যা’দুল মা’আদ ২য় খণ্ড, পৃ: ৫২)। এদিকে অবরোধকারীরা রাত ১২টার অপেক্ষা করছিল। কিন্তু তার আগেই তাদের নিকট তাদের ব্যর্থতা ও অক্ষমতার সংবাদ পৌঁছে গেল। অবস্থা হলো এই যে, তাদের নিকট এক আগন্তুক এসে তাদেরকে সা.-এর দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল ‘আপনারা কিসের জন্য অপেক্ষা করছেন? তারা বলল, ‘আমরা মুহাম্মাদ সা.কে খতম করার অপেক্ষায় রয়েছি। সে বলল, ‘উদ্দেশ্য সাধনে তোমরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছ। আল্লাহর কসম! কিছুক্ষণ পূর্বে মুহাম্মদ সা. তোমাদের সম্মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। যাওয়ার পূর্বে তিনি তোমাদের মাথার উপর এক মুষ্টি মৃত্তিকা ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন।’ তারা বলল, আল্লাহর কসম! আমরা তো তাকে দেখিনি। এ বলে তারা মাথা ঝাড়তে ঝাড়তে দাঁড়িয়ে পড়ল। এরপর দারুণ হতাশা ও ক্রোধের সঙ্গে তারা দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে গৃহের মধ্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকল। চাদর জড়ানো অবস্থায় শায়িত আলী রা. দৃষ্টিগোচর হলে তারা বলতে লাগল, আল্লাহর কসম! এই তো মুহাম্মাদ সা. শুয়ে আছে।’ তিনি শুয়ে আছেন এ ভ্রান্ত বিশ্বাস নিয়েই তারা সেখানে সকালের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। এ দিকে যখন সকাল হলো এবং আলী রা. বিছানা ছেড়ে উঠলেন তখন তারা বুঝতে পারল যে, সত্যি সত্যিই মুহাম্মাদ সা. নেই। তারা অত্যন্ত ক্রদ্ধ এবং বিক্ষুব্ধ কণ্ঠে আলী রা. কে জিজ্ঞেস করল, মুহাম্মাদ সা. কোথায়? আলী রা. বললেন, আমি জানি না।


বাড়ি থেকে সওর গুহা পর্যন্ত

২৭ সফর চতুর্দশ নবুওয়াত সাল মোতাবেক ১২-১৩ই সেপ্টেম্বর, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ (রাহমতুল্লিল আলামিন ১ম খণ্ড, পৃ: ৯৫) সফরের এ মাস চতুর্দশ নবুওয়াত বর্ষের ঐ সময় হবে যখন বছর আরম্ভ হবে মুহাররম মাসে। আর যদি রাসূলুল্লাহ সা. যে মাসে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সে মাস থেকে বছর গণনা করা হয়ে থাকে তাহলে তা ছিল নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের সফর মাসে। সাধারণ ইতিহাসবিদগণ প্রথম হিসাবটি গ্রহণ করেছেন। আর যাঁরা দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেছেন, তাঁরা ঘটনার ক্রমধারায় ভুল করেছেন। আমি মুহররম থেকে সফরের শুরু ধরেছি। মধ্যরাতের সামান্য কিছু সময় পর রাসূলুল্লাহ সা. নিজ বাড়ি থেকে বের হয়ে জান-মালের ব্যাপারে সবচেয়ে বিশ^স্ত সাথী আবূ বকর রা.-এর বাড়িতে গমন করেছিলেন এবং সেখান থেকে পিছনের একটি জানালা দিয়ে বের হয়ে দু’জনই পথ বেয়ে অগ্রসর হতে থাকেন যাতে রাতের অন্ধকার থাকতেই তারা মক্কা নগরীর বাহিরে চলে যেতে সক্ষম হন। কারণ, রাসূলুল্লাহ সা. জানতেন যে, কুরাইশগণ তাঁকে দেখতে না পেলে সর্বশক্তি দিয়ে তার সন্ধানে লেগে পড়বে এবং সর্বপ্রথম যে রাস্তায় দৃষ্টি দেবে তা হচ্ছে মদিনার কর্মব্যস্ত রাস্তা যা উত্তর দিকে গেছে। এ জন্য তাঁরা সেই পথে যেতে থাকলেন যে পথটি ছিল সেই পথের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। অর্থাৎ ইয়েমেন যাওয়ার পথ যা মক্কার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। এ পথ ধরে পাঁচ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে সুপ্রসিদ্ধ সওর পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে পৌঁছলেন। এ পাহাড়টি ছিল খুব উঁচু, পর্বত শীর্ষে আরোহণের পথ ছিল আঁকাবাঁকা ও পাক জড়ানো। আরোহণের ব্যাপারটিও ছিল অত্যন্ত কষ্ট ও আয়াশ-সাধ্য। এ পাহাড় গাত্রের এখানে-সেখানে ছিল প্রচুর ধারালো পাথর যা রাসূলুল্লাহ সা.-এর পদযুগলকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলেছিল। বলা হয়েছে যে, তিনি পদচিহ্ন গোপন করার জন্য আঙুলের ওপর ভর দিয়ে চলছিলেন। এ জন্য তাঁর পা জখম হয়েছিল। যাহোক, আবু বকর রা.-এর সহায়তায় তিনি পর্বতের শৃঙ্গদেশে অবস্থিত গুহার পাশে গিয়ে পৌঁছলেন। এ গুহাটিই ইতিহাসে ‘গারে সওর বা সওর গুহা’ নামে পরিচিত। (রাহমতুল্লিল আলামিন ১ম খণ্ড, পৃ: ৯৫; মুখাতাসারুস সিরাহ, পৃ: ১৬৭) 


সওর গুহায় প্রবেশ 

সওর গুহার নিকট উপস্থিত হয়ে আবু বকর রা. বললেন, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি এখন গুহায় প্রবেশ করবেন না। প্রথমে আমি প্রবেশ করে দেখি এখানে অসুবিধাজনক কোনোকিছু আছে কিনা। যদি তেমন কিছু থাকে তাহলে প্রথমে তা আমার সম্মুখীন হবে এবং এর ফলে আপনাকে প্রাথমিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে না। এ কথা বলার পর আবু বকর রা. গর্তের ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং প্রথমে গর্তটি পরিষ্কার করে নিলেন। গর্তের এক পাশে কিছু ছিদ্র ছিল। নিজের কাপড় টুকরো টুকরো করে তিনি ছিদ্রপথের মুখগুলো বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু কাপড়ের টুকরোর ঘাটতির কারণে দুটো ছিদ্র মুখ বন্ধ করা সম্ভব হল না। আবু বকর রা. ছিদ্র দুটোর মুখে নিজ পদদ্বয় স্থাপন করার পর ভিতরে আগমনের জন্য রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট আরজ করলেন। তিনি ভিতরে প্রবেশ করে আবু বকর রা.-এর ঊরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন।

এ পর্বত গুহায় তাঁরা উভয়ে একাদিকক্রমে তিন রাত (শুক্রবার, শনিবার ও রোববার রাত) অবস্থান করলেন। ফাতহুল বারী শারহুল বুখারি, ৭ম খণ্ড, পৃ: ৩৩৬। আবু বকর রা.-এর পুত্র আবদুল্লাহও ঐ সময় একই সঙ্গে সেখানে রাত যাপন করতেন। আয়িশা রা.-এর বর্ণনাতে, তিনি ছিলেন একজন কর্মঠ, বুদ্ধিমান ও ধীশক্তিসম্পন্ন যুবক। সকলের অগোচরে রাত গভীর হলে তিনি সেখানে যেতেন এবং সাহরির সময়ের পূর্বেই মক্কায় ফিরে এসে মক্কাবাসীগণের সাথে মিলিত হতেন। এতে মনে হতো যেন তিনি মক্কাতেই রাত যাপন করেছেন। গুহায় আত্মগোপনকারীগণের বিরুদ্ধে মুশরিকগণ যে সকল ষড়যন্ত্র করত তা অত্যন্ত সঙ্গোপনে তিনি তাঁদের নিকট পৌঁছিয়ে দিতেন। এদিকে আবু বকর রা.-এর গোলাম আমির ইবন ফুহাইরা পাহাড়ের পাদদেশে ছাগল চরাত এবং যখন রাতের একাংশ অতিবাহিত হয়ে যেত তখন সে ছাগল নিয়ে গারে সওরের নিকটে যেত এবং নবী সা. এবং তাঁর সাহাবীকে রা. দুগ্ধ পান করাত। আবার প্রভাত হওয়ার প্রাক্কালে সে ছাগলের পাল নিয়ে দূরে চলে যেত। পরপর তিন রাতেই সে এরূপ করল। (বুখারি-২১৪৪)। অধিকন্তু আবদুল্লাহ ইবন আবু বকরের গমনাগমন পথে তাঁর পদ চিহ্নগুলো যাতে মিশে যায় তার জন্য আমির বিন ফুহাইরা সেই পথে ছাগল খেদিয়ে নিয়ে যেত। (ইবনে হিশাম ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৮৬)


সওর গুহার মুখে শত্রুদল

রাসূলুল্লাহ সা.কে না পেয়ে কুরাইশরা চারদিকে অনুসন্ধানী দল পাঠায় এবং ঘোষণা করে যে, যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ ও আবু বকরকে বা দু’জনের কাউকে জীবিত বা মৃত ধরে আনবে, তাকে একশত উট পুরস্কার দেওয়া হবে। (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৮৯)। সন্ধানী দল এক সময় সওর গিরি গুহার মুখে গিয়ে পৌঁছে। এ সময়কার অবস্থা আবু বকর রা. বর্ণনা করেন এভাবে যে, যা বুখারিতে এসেছে, “আনাস ইবন মালিক রা. কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, ‘আবু বকর রা. বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে গুহায় থাকা অবস্থায় মাথা তুলে মানুষের পা দেখতে পেলাম।’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর নবী সা. তাদের মধ্যে কেউ যদি শুধু নিজ দৃষ্টি নিচের দিকে নামায় তাহলেই আমাদেরকে দেখে ফেলবে।’ তিনি বললেন, ‘আবু বকর রা. চুপচাপ থাক। আমরা দু’জন, আর তৃতীয় জন আছেন আল্লাহ তায়ালা।’ অন্য একটি বর্ণনায় ভাষা এরূপ আছে, ‘হে আবু বকর রা.-এরূপ দু’জন লোক সম্পর্কে তোমার কী ধারণা যাদের তৃতীয়জন হলেন আল্লাহ। (বুখারি-৩৩৮০, ৩৬২৯, ৪২৯৫; মুসলিম-৪৩৮৯; তিরমিজি-৩০২১)। এক্ষেত্রে অবশ্যই স্মরণ রাখা দরকার যে, আবু বকর রা.-এর অস্থিরতার কারণ নিজ প্রাণের ভয় নয় বরং এর একমাত্র কারণ ছিল যা এ রিওয়ায়াতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, যখন আবু বকর রা. পদরেখা বিশারদগণকে দেখেছিলেন তখন রাসূলুল্লাহ সা. সম্পর্কে তাঁর চিন্তা হলো। তিনি বললেন, ‘আমি যদি ইন্তেকাল করি তবে কেবলমাত্র আমি একজন লোকই ইন্তেকাল করবো। কিন্তু যদি আপনাকে হত্যা করা হয়, তাহলে পুরো উম্মতটাই ধ্বংস হয়ে যাবে। (মুখতাসারুস সিরাহ, পৃ: ১৬৮)। এ সময় রাসূলুল্লাহ সা. বলেছিলেন ‘চিন্তা করবেন না। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঙ্গে আছেন। বিষয়টির বর্ণনা আল্লাহ দিয়েছেন এভাবে, “যদি তোমরা তাকে (রাসূলকে) সাহায্য না কর, তবে মনে রেখো আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন কাফিররা তাকে বের করেছিল, যখন তিনি ছিলেন দু’জনের দ্বিতীয়জন। যখন তারা গুহার মধ্যে ছিল। যখন সে তার সাথীকে বলেছিল, চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি স্বীয় প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তার সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন, যা তোমরা দেখোনি। আর আল্লাহ তায়ালা কাফিরদের শিরকি কালেমা নিচু করে দিলেন। বস্তুত আল্লাহর তাওহিদের কালিমা সদা উন্নত আছেই। আল্লাহ হলেন পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’।” (সূরা তাওবা : ৪০)

রক্তপিপাসু শত্রুকে সামনে রেখে ঐ সময়ের নাজুক অবস্থায় (চিন্তিত হয়ো না, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন), এই ছোট্ট কথাটি মুখ দিয়ে বের হওয়া কেবলমাত্র তখনই সম্ভব, যখন একজন মানুষ সম্পূর্ণরূপে কায়মনোচিত্তে নিজেকে আল্লাহর ওপরে সোপর্দ করে দেন। দুনিয়াবি কোন উপায়-উপকরণের ওপরে নির্ভরশীল ব্যক্তির পক্ষে এরূপ কথা বলা আদৌ সম্ভব নয়। বস্তুত এ কথা রাসূলুল্লাহ সা. বিভিন্ন সঙ্কটকালে কয়েকবার বলেছেন। এখানে ‘অদৃশ্য বাহিনী’ বলতে ফিরিশতাগণ হতে পারে কিংবা অন্য কোনো অদৃশ্য শক্তি হতে পারে, যা মানুষের কল্পনার বাইরে। মূলত সবই আল্লাহর বাহিনী। সবচেয়ে বড়ো কথা, সারা পাহাড় তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর গুহার মুখে পৌঁছেও তারা গুহার মধ্যে খুঁজল না, এমনকি নিচের দিকে তাকিয়েও দেখল না। তাদের এই মনের পরিবর্তনটাই আল্লাহর পক্ষ থেকে ছিল সরাসরি গায়েবি মদদ এবং রাসূল সা.-এর অন্যতম মু‘জিযা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রভুর সেনাবাহিনীর খবর তোমার প্রভু ব্যতীত কেউ জানে না’ (সূরা মুদ্দাছছির : ৩১)। আর এ কারণেই হাজারো প্রস্তুতি নিয়েও অবশেষে কুফরির ঝাণ্ডা অবনমিত হয় ও তাওহিদের ঝাণ্ডা সমুন্নত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন যারা আল্লাহ ভীরুতা অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মশীল’। (সূরা নাহল : ১২৮)


মক্কা ত্যাগকালে রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতিক্রিয়া

সহিহ সনদে এসেছে, “আবদুল্লাহ ইবন আদি ইবনুল হামরা আয যুহরী রা. বর্ণনা করেছেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সা. হতে শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. যখন হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হন, তখন হাজুনে দাঁড়িয়ে মক্কাবাসী ও বায়তুল্লাহকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই তুমি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ জনপদ ও আল্লাহর নিকট আল্লাহর মাটিসমূহের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মাটি। যদি আমাকে তোমার থেকে বের করে না দেওয়া হত, তাহলে আমি বেরিয়ে যেতাম না।” (তিরমিজি-৩৯২৫; মুসনাদু আহমাদ-১৮৭১৫, ১৮৭১৬, ১৮৭১৭; সুনানু ইবন মাজাহ-৩১০৮)। এ প্রসঙ্গে যে আয়াতটি নাজিল হয় তা নিম্নরূপ, “যে জনপদ তোমাকে বহিষ্কার করেছে, তার চাইতে কত শক্তিশালী জনপদকে আমরা ধ্বংস করেছি। অতঃপর তাদেরকে সাহায্য করার কেউ ছিল না।” (সূরা মুহাম্মাদ : ১৩; আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বলেন, আয়াতটি হিজরতকালে মক্কা ত্যাগের সময় নাজিল হয়। তাফসীর ত্বাবারী, ২৬ খণ্ড, পৃ: ৩১; হাদিস নং ৩১৩৭২। হাদিস সহিহ)


মদিনার পথে

লাগাতার তিন দিন যাবৎ নিষ্ফল দৌড়ঝাঁপ এবং খোঁজাখুঁজির পর যখন কুরাইশদের আকস্মিক প্রজ্বলিত ক্রোধাগ্নি কিছুটা প্রশমিত হওয়ায় অনুসন্ধান কাজের মাত্রা স্তিমিত হয়ে এলো এবং তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা কিছুটা ধীরগতি হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সা. এবং আবু বকর রা. মদিনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলেন। আবদুল্লাহ ইবন আরিকাত লাইসী যিনি সাহারা জনমানবশূন্য পথ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ছিলেন, মদিনায় পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য পূর্বে তাঁর সাথে চুক্তি ও মজুরি নির্ধারিত হয়েছিল এবং তার নিকট দু’টি বাহনও রাখা হয়েছিল। ঐ ব্যক্তি তখনো কুরাইশ মূর্তিপূজকদের দলভুক্ত থাকলেও পথপ্রদর্শক হিসেবে তাঁর উপর নির্ভর করার ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ ছিল না। তাঁর সাথে এ মর্মে কথাবার্তা ছিল যে, তিন রাত অতিবাহিত হওয়ার পর চতুর্থ রাতে বাহন দু’টি নিয়ে তাকে গারে সওর পৌঁছতে হবে। সেই কথা মোতাবেক সোমবারের দিবাগত রাতে বাহন দু’টি নিয়ে উপস্থিত হয়ে (সেটি ছিল প্রথম হিজরি সনের রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদনী রাত মোতাবেক ১৬ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা.! আমার বাহন দু’টির মধ্যে একটি আপনি গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, মূল্যের বিনিময়ে। আবু বকর রা.-এর মেয়ে আসমা বিনত আবু বকর রা. তাঁদের বাহন ও সফরের সামগ্রী বেঁধে দিলেন। হাদিসে এসেছে, “আসমা বিনতে আবি বকর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-এর সফরের সামগ্রী নিয়ে এলাম কিন্তু তাতে ঝুলানোর জন্য বন্ধনের রশি লাগাতে ভুলে গিয়েছিলাম। যখন হিজরতের যাত্রার সময় হয়ে এলো এবং আমি সামগ্রী ঝুলাতে গিয়ে দেখলাম তাতে বন্ধন রশি নেই, তখন আমি তা আবু বকর রা.কে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, তুমি তোমার কোমরবন্ধ খুলে ফেল এবং তা দু’ভাগে ভাগ করে ছিঁড়ে ফেলে। তারপর এক অংশের সাহায্যে সামগ্রী ঝুলিয়ে দিলাম এবং দ্বিতীয় অংশের সাহায্যে কোমর বাঁধলাম। এ কারণেই আমার উপাধি দেওয়া হয়েছিল যাতুন নিত্বাক্বাইন।” (বুখারি-২৭৫৭, ৩৬১৬, ৩৬১৭; মুসনাদু আহমাদ-২৪৪৪৫, ২৫৬৯১)। এরপর রাসূলুল্লাহ সা. ও আবু বকর রা. উটের পিঠে আরোহণ করলেন। আমর বিন ফুহায়রাও সঙ্গে ছিলেন। পথপ্রদর্শক আবদুল্লাহ বিন আরিকাত মদিনা যাত্রার সাধারণ পথে না গিয়ে লোহিত সাগরের উপকূলের পথ ধরলেন। সর্বপ্রথম সওর গুহা হতে যাত্রা আরম্ভ করে তিনি (পথ প্রদর্শক) ইয়েমেনের পথে যাত্রা করলেন এবং দক্ষিণ দিকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। তার পরে পশ্চিমদিকে ঘুরে সমুদ্রোপকূলের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তারপরে এমন এক পথে নিয়ে গেলেন যে পথের সন্ধান সাধারণ লোকেরা জানত না। এরপর উত্তর দিকে মোড় নিলেন যে পথ লোহিত সাগরের খুব কাছাকাছি ছিল। এপথে খুব অল্প মানুষ চলাচল করত।

সহীহুল বুখারিতে আবু বকর রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘আমরা (গারে সওর থেকে বেরিয়ে) একটানা সারা রাত এবং পরের দিন দুপুর পর্যন্ত চলতে থাকলাম। রোদের প্রখরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমান্বয়ে পথচারীর সংখ্যা কমতে থাকল এবং ঠিক দুপুরে পথ জনশূন্য হয়ে গেল। আমরা তখন দীর্ঘ বড়ো পাথর দেখতে পেলাম যার ছায়ায় তখনো রোদ আসেনি। আমরা সেখানে নেমে পড়লাম। আমি নিজ হাতে রাসূলুল্লাহ সা.- এর শয়নের জন্য একটি জায়গা সমতল করে দিলাম এবং সেখানে একখানা চাদর পেতে দিয়ে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল সা.! আপনি এখানে শয়ন করুন আর আমি আপনার আশ-পাশের সবকিছু দেখাশুনা করছি। তিনি শয়ন করলেন এবং আমি সামনে ও পেছনের খোঁজ খবর নেওয়া এবং দেখাশোনার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একজন রাখাল তার ছাগলের পাল নিয়ে পাথরের দিকে চলে আসছে। সেই পাথর থেকে সেও ঐ জিনিসই চাচ্ছে যা আমরা চেয়েছিলাম। আমি তাকে বললাম, ‘হে যুবক তুমি কার লোক?’ সে মক্কা অথবা মদিনার কোনো লোকের কথা বলল। আমি তাকে বললাম, ‘তোমার ছাগীর ওলানে কি কিছু দুধ আছে?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’। আমি পুনরায় বললাম, ‘সেটি কি দোহন করতে পারি?’ সে বলল, ‘হ্যাঁ’। তারপর সে একটি ছাগী ধরে নিয়ে এলো। আমি বললাম, ‘মাটি, খড়কুটো এবং লোম থেকে ওলানটা পরিষ্কার করে নাও। পরিষ্কার করে নেওয়ার পর একটি পেয়ালায় অল্প কিছুটা দুধ দোহন করল। তারপর দুধটুকু আমি একটি চামড়ার পাত্রে ঢেলে নিলাম। রাসূলুল্লাহ সা.-এর পানি এবং ওজুর জন্য ঐ পাত্রটি আমি সঙ্গে নিয়েছিলাম। আমি দুগ্ধ পাত্র হাতে রাসূলুল্লাহর নিকট এসে দেখি তখনো তিনি ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছেন। কাজেই, তাকে ঘুম থেকে জাগানোর সাহস হল না। তারপর যখন তিনি জাগ্রত হলেন তখন আমি দুধের মধ্যে কিছুটা পানি ঢেলে দিলাম যাতে দুধের তলদেশ ঠাণ্ডা হয়ে যায় এবং বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সা. এ দুধটুকু পান করুন’, তিনি পান করলেন। তাকে পান করানোর সুযোগ প্রদানের জন্য আনন্দ চিত্তে আল্লাহর সমীপে শুকরিয়া আদায় করলাম। দুধ পানের পর রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, এখনো কি যাত্রার সময় হয়নি?’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! কেন হবে না, যাত্রার উপযুক্ত সময় হয়েছে, তারপর আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম। (বুখারি-৩৩৪৬; মুসলিম-৫৩২৯; মিশকাতুল মাসাবীহ-৫৮৬৯)। পথিমধ্যে রাস্তার লোকজনেরা পরিচয় জিজ্ঞেস করায় প্রজ্ঞাপূর্ণ জবাব প্রদান করেন আবু বকর রা.। হাদিসে এসেছে, “আনাস ইবন মালিক রা. হতে বর্ণিত, মক্কা হতে মদিনায় যাত্রাবস্থায় আবু বকর রা. সর্বদা সওয়ারিতে রাসূলুল্লাহ সা.-এর পিছনে বসতেন। কেননা আবু বকরের মধ্যে বার্ধক্যের নিদর্শন প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু রাসূল সা.-এর চেহারা-ছুরতে তখনো চাকচিক্য বজায় ছিল। তাই রাস্তায় লোকেরা কিছু জিজ্ঞেস করলে মুরব্বি ভেবে আবু বকরকেই করতো। সামনের লোকটির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলতেন, ‘এ ব্যক্তি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।” (বুখারি-৩৬৯৯; মুসনাদু আহমাদ-১৪০৬৩)। মূলত এর দ্বারা তিনি হিদায়াতের পথ বুঝাতেন। কিন্তু লোকেরা ভাবতো রাস্তা দেখানো কোনো লোক হবে। এর মাধ্যমে তিনি রাসূল সা.-এর পরিচয় গোপন করতেন। আরবি অলঙ্কার শাস্ত্রে এসব বক্তব্যকে ‘তাওরিয়া’ বলা হয়। যাতে একদিকে সত্য বলা হয়। অন্যদিকে শ্রোতাকেও বুঝানো যায়। 

আবার পথিমধ্যে সুরাক্বা বিন মালিকের পশ্চাদ্ধাবন, সহীহ সনদে বর্ণিত আছে, বনু মুদলিজ গোত্রের নেতা সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলেজী জনৈক ব্যক্তির কাছে মুহাম্মাদ গমনের সংবাদ শুনে পুরস্কারের লোভে দ্রুতগামী ঘোড়া ও তীর-ধনুক নিয়ে রাসূল সা.-এর পিছে ধাওয়া করল। কিন্তু কাছে যেতেই ঘোড়ার পা দেবে গিয়ে সে চলন্ত ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ল। তখন তীর ছুঁড়তে গিয়ে তার পছন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না। ইতোমধ্যে রাসূলুল্লাহ সা.-এর কাফেলা অনেক দূরে চলে গেল। সে পুনরায় ঘোড়া ছুটালো। কিন্তু এবারও একই অবস্থা হল। কাছে পৌঁছতেই ঘোড়ার পা পেট পর্যন্ত মাটিতে এমনভাবে দেবে গেল যে, তা আর উঠাতে পারে না। আবার সে তীর বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু আগের মতই ব্যর্থ হলো। তার পছন্দনীয় তীরটি খুঁজে পেল না। তখনই তার মনে ভয় উপস্থিত হল এবং এ বিশ্বাস দৃঢ় হল যে, মুহাম্মাদকে নাগালে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে তখন রাসূল সা.-এর নিকটে নিরাপত্তা প্রার্থনা করল। এ আহবান শুনে মুহাম্মাদ সা.-এর কাফেলা থেমে গেল। সে কাছে গিয়ে রাসূল সা.কে কিছু খাদ্যসামগ্রী ও আসবাবপত্র দিতে চাইল। রাসূল সা. কিছুই গ্রহণ করলেন না। সুরাকা বলল, আমাকে একটি ‘নিরাপত্তা নামা’ লিখে দিন। তখন রাসূল সা.-এর হুকুমে আমির বিন ফুহায়রা একটি চামড়ার উপরে তা লিখে তার দিকে নিক্ষেপ করলেন। অতঃপর রওয়ানা হলেন। (বুখারি-৩৬৯৩; আল মুসতাদরাক আলাস সহীহাইন-৪২৬৯)। লাভ হলো এই যে, ফেরার পথে সুরাক্বা অন্যান্যদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল, যারা রাসূল সা.-এর পিছু নিয়েছিল। এভাবে দিনের প্রথম ভাগে যে ছিল রক্ত পিপাসু দুশমন, দিনের শেষভাগে সেই হল দেহরক্ষী বন্ধু।

অন্য বর্ণনায় এসেছে, বারা বিন আজিব রা. স্বীয় পিতা হতে বর্ণনা করেন, একদিন আমি আবু বকরকে জিজ্ঞেস করলাম, হিজরতের রাতে আপনারা কিভাবে সফর করেছিলেন, আমাকে একটু বলুন। তখন তিনি বললেন, আমরা সারা রাত চলে পরদিন দুপুরে জনমানবহীন রাস্তার পাশে একটা লম্বা ও বড়ো পাথরের ছায়ায় রাসূল সা.কে শুইয়ে দিলাম। অতঃপর আমি চারিদিকে দেখতে লাগলাম। এমন সময় একটি মেষপাল আসতে দেখলাম। আমি মেষপালককে বললে সে দুগ্ধ দোহন করে দিল। অতঃপর আমরা উভয়ে দুধ পান করে তৃপ্ত হলাম। অতঃপর সূর্য ঢলে পড়লে আমরা রওয়ানা হলাম। ইতোমধ্যে দূর থেকে দেখলাম সুরাক্বা ইবন মালিক আমাদের পিছু নিয়েছে। তখন আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন, ‘চিন্তিত হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’। অতঃপর কাছে আসতেই তার ঘোড়া পেট পর্যন্ত শক্ত মাটিতে দেবে গেল। সে বলল, আমি দেখলাম তোমরা আমার বিরুদ্ধে বদ দোয়া করেছ। এক্ষণে আমার জন্য দোয়া কর। আমি তোমাদের পক্ষে শত্রুদের ফিরিয়ে নিয়ে যাব। তখন রাসূলুল্লাহ সা. তার জন্য দোয়া করলেন এবং সে মুক্তি পেল। অতঃপর সে ফিরে যাওয়ার পথে পিছু ধাওয়াকারী লোকদের বলতে থাকে যে, ‘আমি তাকে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছি। অতএব তোমরাও ফিরে চল। এভাবে সে সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।’ (বুখারি-৩৪১৯; মুসলিম-৭৭০৯; মিশকাতুল মাসাবিহ-৫৮৬৯)। প্রসিদ্ধ আছে যে, হুনাইন যুদ্ধের পরে জি‘ইর্রানাতে এসে সুরাকা মুসলমান হন (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৯০)।


কুবায় অবতরণ ও মসজিদ স্থাপন

একটানা আট দিন চলার পর ১৪ নববী বর্ষের ৮ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার দুপুরে কুবা উপশহরে শ্বেত-শুভ্র বসনে তাঁরা অবতরণ করেন। (আর রাহীকুল মাখতুম, পৃ: ১৭০; ইবনে হিশাম এ আছে, ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার। সুহায়লী বলেন, এটি ছিল ৮ রবিউল আউয়াল। (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৯২; সহীহ মুসলিমে ‘রাত’-এর কথা এসেছে- মুসলিম-২০০৯)। এর ব্যাখ্যায় ইবন হাজার আল আসকালানী বলেন, তাঁরা রাত শেষে অবতরণ করেন এবং দিনে শহরে প্রবেশ করেন (ফাতহুল বারী শারহুল বুখারি-৩৯০৬ এর আলোচনা)। অর্থাৎ তিনি মক্কার সওর গিরিগুহা থেকে সোমবারে প্রত্যুষে রওয়ানা দিয়ে পরবর্তী সোমবার দুপুরে কুবায় পৌঁছেন মোট ৮ দিনে। 

কুবায় মানুষের ঢল নামে। হাজারো মানুষের অভ্যর্থনার মধ্যেও রাসূল সা. ছিলেন চুপচাপ। তাঁর উপরে আবু বকর রা. চাদর দিয়ে ছায়া করলে লোকেরা রাসূলুল্লাহ সা. কে চিনতে পারে। এ সময় তাঁর উপরে ‘ওহি’ নাজিল হয়, ‘জেনে রেখ, আল্লাহ, জিবরাঈল ও সৎকর্মশীল মুমিনগণ তার সহায়। উপরন্তু ফিরিশতাগণও তার সাহায্যকারী।’ (সূরা তাহরীম : ৪; আর রাহীকুল মাখতুম, পৃ: ১৭১; যাদুল মা‘আদ, ৩য় খণ্ড, পৃ: ৫২)। কুবায় রাসূলুল্লাহ সা. বনু আমর বিন আওফ গোত্রের কুলছুম ইবন হিদমের বাড়িতে অবস্থান করেন। (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৯৩)। সুহাইলি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা.-এর মদিনা আগমনের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই কুলছুম ইবন হিদম ইন্তেকাল করেন। তিনি আনসার সাহাবীদের মধ্যে প্রথম ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকালের কয়েকদিন পরে ইন্তেকাল করেন আসআদ বিন যুরারাহ (আর রউদুল উনুফ, ১ম খণ্ড, পৃ: ২১১; ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৯৩)। এদিকে আলী ইবন আবি তালিব রা.ও মক্কায় তিনদিন অবস্থান করে গচ্ছিত আমানত সমূহ স্ব স্ব মালিককে ফেরত প্রদানের পর মদিনায় চলে আসেন এবং রাসূল সা.-এর সাথেই অবস্থান করতে থাকেন। কুবাতে রাসূলুল্লাহ সা. ১৪ দিন অবস্থান করেন। এতে মতভেদ থাকলেও এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, তিনি সোমবারে কুবায় অবতরণ করেন এবং শুক্রবারে সেখান থেকে ইয়াসরিবের উদ্দেশে রওয়ানা হন। এ সময়ে তিনি সেখানে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন ও সেখানে সালাত আদায় করেন। এ মসজিদ সম্পর্কেই সূরা তাওবার ১০৮ আয়াতে ‘তাক্বওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ’ বলে প্রশংসা করা হয়েছে। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম মসজিদ। (সিরাতুন্নবী, শিবলী নোমানী, ১ম খণ্ড, পৃ: ২৭৬) কুবা থেকে ইয়াসরিবের মসজিদে নববীর দূরত্ব হল ১ ফারসাখ তথা ৩ মাইল বা ৫ কিলোমিটার)


প্রথম জুম‘আ আদায় ও ইয়াসরিবে প্রবেশ

ইয়াসরিবের উপকণ্ঠে পৌঁছে বনু সালিম ইবন আওফ গোত্রের ‘রানুনা’ উপত্যকায় তিনি প্রথম জুম‘আর সালাত আদায় করেন। যাতে একশত জন মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। এটাই ছিল রাসূলুল্লাহ সা.-এর আদায়কৃত ইসলামের ইতিহাসে প্রথম জুম‘আ। কেননা হিজরতের পূর্বে মদিনার আনসারগণ আপসে পরামর্শক্রমে ইহুদি ও নাসারাদের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিনের বিপরীতে নিজেদের জন্য একটি ইবাদতের দিন ধার্য করেন ও সেমতে আস‘আদ ইবন যুরারাহ রা.-এর নেতৃত্বে মদিনার বনু বায়াযাহ গোত্রের ‘নাক্বী‘উল খাযেমাত’ নামক স্থানের ‘নাবীত’ সমতল ভূমিতে সর্বপ্রথম জুম‘আর সালাত চালু হয়। যেখানে চল্লিশ জন মুসল্লি অংশগ্রহণ করেন। (সুনানু ইবন মাজাহ-১০৮২; সুনানু আবি দাঊদ-১০৭১; আল মু’জামুল কবীর-১৭৬) 

সালাতুল জুম‘আ আদায় করে রাসূলুল্লাহ সা. পুনরায় যাত্রা করে দক্ষিণ দিক থেকে ইয়াসরিবে প্রবেশ করেন। এদিন ছিল ১২ রবিউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে সেপ্টেম্বর শুক্রবার (আর-রাহীকুল মাখতুম, পৃ: ১৮৪)। ইয়াসরিবের শত শত মানুষ তাকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানায়। বহু পুরুষ ও নারী বাড়ি-ঘরের ছাদের ওপরে আরোহণ করেন। এমনকি ছোট্ট শিশু-কিশোররা বলতে থাকে, এই যে, আল্লাহর রাসূল এসে গেছেন। এই যে, আল্লাহর নবী এসে গেছেন। হে মুহাম্মাদ! হে আল্লাহর রাসূল! (মুসলিম, হাদিস নং ৭৭০৭)। প্রত্যক্ষদর্শী সাহাবি বারা ইবন আজিব আনসারী রা. বলেন, ‘রাসূল সা.-এর আগমনে আমি মদিনাবাসীকে যত খুশি হতে দেখেছি, এত খুশি তাদের কখনো হতে দেখিনি’ (বুখারি-৩৭১০, ৪৬৫৭; মুসনাদু আহমাদ-১৮৫১২, ১৮৫৬৮) আনাস ইবন মালিক রা. বলেন, আমি রাসূল সা. ও আবু বকর রা.-এর আগমনের দিনের চেয়ে অধিক সুন্দর ও হাস্যোজ্জ্বল দিন আর কখনো দেখিনি। (মুসনাদু আহমাদ-১২২৫৬)


আবু আইয়ুবের বাড়িতে অবতরণ 

ইয়াসরিবে প্রবেশের পর প্রত্যেক বাড়িওয়ালা তার বাড়িতে রাসূল সা.কে মেহমান হিসাবে পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অনেকে উটের লাগাম ধরে টানতে থাকে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. বলতে থাকেন, তোমরা ওকে ছাড়। কেননা সে আদেশপ্রাপ্ত। অতঃপর উষ্ট্রী নিজের গতিতে চলে বর্তমানের মসজিদে নববীর দরজার স্থানে গিয়ে বসে পড়ে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সা. তখনো নামেননি। পরে উষ্ট্রী পুনরায় উঠে কিছু দূর গিয়ে আবার পূর্বের স্থানে ফিরে এসে বসে পড়ে। এটি ছিল রাসূলুল্লাহ সা.-এর মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারের মহল্লা। বনু নাজ্জার গোত্রের লোকদের মধ্যে হিড়িক পড়ে গেল কে রাসূলকে আগে তার বাড়িতে নিবে। আবু আইয়ুব আনসারী রা. উষ্ট্রীর পিঠ থেকে পালান উঠিয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ওদিকে আক্বাবার প্রথম বাইয়াতকারী আস‘আদ বিন যুরারাহ উটের লাগাম ধরে রইলেন। কেউ দাবি ছাড়তে চান না। (আর রাহীকুল মাখতুম, পৃ: ১৭৩; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩য় খণ্ড, পৃ: ২০২; যাদুল মা‘আদ, ১ম খণ্ড, পৃ: ৯৯; ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৯৪)। এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, কার বাড়ি নিকটে? আবু আইয়ুব বললেন, ‘এই তো আমার বাড়ি, এইতো আমার দরজা’। তখন রাসূল সা. তার বাড়িতে গেলেন। আবু বকরও তাঁর সাথে গেলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ সা. দোয়া করেন, ‘আল্লাহর রহমাতের উপরে তোমরা দু’জন (রাসূল ও আবু বকর) দাঁড়িয়ে যাও।’ (বুখারি-৩৬৯৯; মুসনাদু আহমাদ-১৩২০৫) এর মাধ্যমে তিনি সেখানে অবস্থান করার কথা ঘোষণা দেন। আবু আইয়ুবের বাড়িটি ছিল দোতলা। হাদিসে বর্ণিত আছে, আবু আইয়ুব রা. বলেন, তিনি তাঁকে দোতলায় থাকতে অনুরোধ করেন। কিন্তু রাসূল সা. বললেন, নিচতলাটাই সহজতর হবে। ফলে আবু আইয়ুব দোতলায় এক পাশে থেকে রাত্রি যাপন করতে থাকেন। এক রাতে তিনি চিন্তা করলেন, রাসূল সা. নিচে থাকবেন, আর আমরা তাঁর মাথার উপরে চলাফেরা করব, এটা কিভাবে সম্ভব? পরে তিনি এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে নিচে রেখে আমরা মাথার উপরে থাকতে পারব না। তখন রাসূল সা. দোতলায় উঠেন। আবু আইয়ুব রা. নিচ থেকে তাঁর জন্য খাবার রান্না করে উপরে পরিবেশন করতে থাকেন। খাওয়ার পর পাত্রে কিছু বাকি থাকলে আবু আইয়ুব ও তাঁর স্ত্রী তা (বরকতের আশায়) খেয়ে নিতেন। (মুসলিম-৫৪৭৯; মুসনাদু আহমাদ-২৩৫১৭) 


মসজিদে নববী স্থাপন

মহানবী সা.-এর উটনী আবু আইয়ুব আল আনসারী রা.-এর বাড়ির সামনে খালি জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। জমিটির মালিক ছিলে সাহল ও সুহাইল নামের দুই ইয়াতিম বালক। তাঁদের জমিতেই বর্তমান মসজিদে নববী অবস্থিত। (আদ দুরার, ইবর আবদুল বার, পৃ: ৯৪; তারিখ, ইবন খালদুন, সিরাতুন নববিয়্যা, ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৯৪)


মদিনায় নবী পরিবারের আগমন 

কয়েক দিনের মধ্যেই নবীপত্নী সওদা বিনত যাম‘আহ এবং নবীকন্যা উম্মু কুলছুম ও ফাতিমা এবং উসামা বিন যায়িদ ও তার মা রাসূল সা.-এর মুক্তদাসী উম্মু আইমান মদিনায় পৌঁছে যান। এদের সকলকে আবদুল্লাহ ইবন আবুবকর তার পারিবারিক কাফেলার সাথে নিয়ে এসেছিলেন। যাদের মধ্যে আয়িশা রা.ও ছিলেন। কেবল নবী কন্যা যয়নব তার স্বামী আবুল ‘আছির সঙ্গে রয়ে গেলেন। যিনি বদর যুদ্ধের পরে আসেন (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৯৮)


মদিনায় নবীগৃহ নির্মাণ 

এই সময় মসজিদে নববীর পাশে মাটি ও পাথর দিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর স্ত্রীদের জন্য প্রথমে সাওদা ও আয়িশা রা.-এর জন্য দু’টি ঘর নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে প্রয়োজনমত আরো ঘর নির্মাণ করা হয়। প্রত্যেকটি ছিল খেজুর পাতার ছাউনি। (আত ত্বাবাকাতুল কুবরা, ইবন সাদ, ১ম খণ্ড, পৃ: ২৪০) বাড়িগুলির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে আল্লাহর রাসূল সা. আবু আইয়ুবের বাড়ি ছেড়ে সপরিবারে এখানে চলে আসেন। তিনি সেখানে সাত মাস ছিলেন’। (সিরাহ সহীহাহ, ১ম খণ্ড, পৃ: ২২০) উল্লেখ্য যে, তাঁদের মৃত্যুর পর উক্ত ঘরসমূহ ভেঙ্গে মসজিদের মধ্যে শামিল করে নেওয়া হয়। খলীফা আবদুল মালিক ইবন মারওয়ানের সময় (৬৫-৮৬ হিঃ/৬৮৫-৭০৫ খ্রিঃ) যখন উক্ত মর্মে নির্দেশনামা এসে পৌঁছে, তখন মদিনাবাসীগণ কান্নায় ভেঙে পড়ে। যেমন তারা কেঁদেছিল রাসূল সা.-এর ইন্তেকালের দিন। (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ: ৪৯৮)


রাসূলুল্লাহ সা.-এর হিজরতের গুরুত্ব 

১. বিশ্বাসগত মজবুত পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কোনো বিধান প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। সে কারণে সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যখন মক্কায় সেরূপ পরিবেশ তৈরি হয়নি, তখন ইয়াসরিবে পরিবেশ তৈরি হওয়ায় সেখানে হিজরতের নির্দেশ আসে। সে কারণ হিজরত ছিল ইসলামের ইতিহাসে মোড় পরিবর্তনকারী ঐতিহাসিক ঘটনা।

২. ঈমানী বন্ধন দুনিয়াবি বন্ধনের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। যেমন রক্তের বন্ধন হিসাবে চাচা আবু তালিবের নেতৃত্বে বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব রাসূলুল্লাহ সা.কে সার্বিক সহযোগিতা করলেও তা টেকসই হয়নি। অবশেষে ঈমানী বন্ধনের আকর্ষণে রাসূল সা.কে সুদূর ইয়াসরিবে হিজরত করতে হয় এবং সেখানে গিয়ে তিনি নতুন ঈমানী সমাজের গোড়াপত্তন করেন।

৩. জনমত গঠন হলো ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আবশ্যিক পূর্বশর্ত। তাই মক্কার অধিকাংশ জনমত বিরুদ্ধে থাকায় আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সা.কে মদিনায় হিজরত করতে হয়। অতঃপর অনুকূল জনমতের কারণে শত যুদ্ধ-বিগ্রহ ও মুনাফেকির মধ্য দিয়েও তিনি সেখানে ইসলামী খিলাফত কায়েমে সক্ষম হন। আজও তা সম্ভব, যদি মহানবী সা. প্রদর্শিত পন্থায় আমরা পরিচালিত হই।

৪. হিজরত হয়েছিল বলেই ইসলামী বিধানসমূহের প্রতিষ্ঠা দান সম্ভব হয়েছিল। এমনকি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে সিয়াম, জাকাত ও হজ তিনটিই ফরজ হয়েছিল হিজরতের পর মদিনায়।

৫. ইসলামের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিধানসমূহ মদিনায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যা হিজরতের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।

৬. উমর রা. হিজরতকে ‘হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী’ বলে আখ্যায়িত করেন। মদিনায় হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ সা. দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার সাহাবীদের হিজরত অব্যাহত রাখ এবং তাদেরকে পিছনে ফিরিয়ে দিয়ো না’ (বুখারি-১২৩৩, ৩৭২১, ৪১৪৭, ৬০১২; মুসলিম-৪২৯৬; তিরমিজি-২১১৬)। ফলে মুহাজিরগণ নতুন পরিবেশে নানা অসুবিধা সত্ত্বেও সেটাকে মেনে নেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, দীনের হিফাজত ও দাওয়াতের স্বার্থে মু’মিনের জন্য হিজরত করা ওয়াজিব। 


রাসূলুল্লাহ সা.-এর হিজরতের তাৎপর্য

মদিনায় হিজরতের ফলে রাসূল সা. নতুন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হলেন। তিনি হলেন পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ রাষ্ট্রপতি। যে সম্মান ও মর্যাদা আল্লাহ তার প্রিয় রাসূলকে দিয়েছেন, তা শুধু মদিনাবাসীর জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমার কাছে সত্যসহ কিতাব নাজিল করেছি যাতে করে তুমি আল্লাহর দেখানো নিয়ম অনুযায়ী মানুষের মাঝে শাসন করতে পারো। আর তুমি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে বিতর্ককারী হয়ো না।’ (সূরা নিসা : ১০৫) ইসলামের ইতিহাসে মুহাম্মাদ সা.-এর মদিনায় হিজরত একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এ হিজরত পুরো মানবজাতির কাছে ইসলামকে নতুনভাবে উপস্থাপিত করে। 


হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ নতুন যে অধ্যায়ের সূচনা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো- 

১. হিজরতকৃত স্থানের নতুন নামকরণ : রাসূলুল্লাহ সা. এবং মুহাজিররা হিজরত করে যেই স্থানে যান, তার নাম ছিল ‘ইয়াসরিব’। রাসূলুল্লাহ সা. সেখানে হিজরতের ফলে শ্রেষ্ঠ নবীর সম্মানার্থে ইয়াসরিববাসী তাদের শহরের নাম রাখেন ‘মদিনাতুন নবী সা. বা নবীর শহর। মদিনার পূর্ব নাম যে ইয়াসরিব ছিল, যা আল কুরআনে মহান আল্লাহই বলেছেন। খন্দকের কঠিন যুদ্ধের সময় একদল মুনাফিক বলেন, ‘হে ইয়াসরিববাসী, এটা তোমাদের টিকবার স্থান নয়। অতএব তোমরা ফিরে চলো।’ (সূরা আহযাব : ১৩)। বর্ণিত আছে, ইয়াসরিবের নাম আল মদিনা আল মুনাওয়্যারা (আলোকোজ্জ্বল শহর) ও আল মদিনা আত তাইয়্যিবা (পবিত্র শহর) নামে অভিহিত হয়। (আর রউদুল উনুফ, আবদুর রহমান সুহাইলী, ১ম খণ্ড, পৃ: ১৬; মুহাম্মাদ দ্য ফাইনাল মেসেঞ্জার, পৃ: ১২৮) 

২. নতুন রাষ্ট্র গঠন : রাসূল সা. মদিনায় হিজরতের ফলে মদিনাবাসী রাসূলকে সাদরে গ্রহণ করেন, নতুন ধর্মের সুন্দর বিধি-বিধানে মুগ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। আর এভাবেই রাসূলুল্লাহ সা. প্রথমবারের মতো নতুন একটি ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেন।

৩. হিজরি সন প্রবর্তন : রাসূল সা.-এর মদিনা হিজরতকে কেন্দ্র করে ইসলামের ইতিহাসে মুসলমানদের জন্য নতুন একটি সনের প্রবর্তন হয়। যাকে বলা হয় হিজরি সন। উমর ফারূক রা. স্বীয় খিলাফতকালে (১৩-২৩ হিজরি) হিজরি সন প্রবর্তন করেন এবং রবিউল আউয়াল মাসের পরিবর্তে মুহাররম মাসকে প্রথম মাস হিসাবে নির্ধারণ করেন। কারণ হজ পালন শেষে মুহাররম মাসে সবাই দেশে ফিরে যায়। তাছাড়া জিলহজ মাসে বাইয়াতে কুবরা সম্পন্ন হওয়ার পর মুহাররম মাসে হিজরতের সংকল্প করা হয়। ঘটনা ছিল এই যে, আবু মূসা আশ‘আরী রা. খলিফা উমর রা. কে লেখেন যে, আপনি আমাদের নিকটে যেসব চিঠি পাঠান তাতে কোন তারিখ থাকে না। যাতে সমস্যা সৃষ্টি হয়। তখন উমর রা. পরামর্শ সভা ডাকেন। সেখানে তিনি হিজরতকে হক্ব ও বাতিলের পার্থক্যকারী বলে আখ্যায়িত করেন এবং মুহাররম মাস থেকে বর্ষ গণনার প্রস্তাব করেন। বিস্তারিত আলোচনার পর সকলের ঐকমত্যে তা অনুমোদিত হয়। ঘটনাটি ছিল ১৭ হিজরি সনে। (ফাতহুল বারী শারহু সহীহুল বুখারি-৩৯৩৪ এর আলোচনা; সিরাহ সহীহাহ, ১ম খণ্ড, পৃ: ২২৩; তারিখুর রুসূল ওয়াল মুলুক, আত ত্বাবারী, ২য় খণ্ড, পৃ: ৩৮১)। ইতিহাসে এ হিজরি সন অনেক গুরুত্ব বহন করে।

৪. নতুন সংবিধান প্রণয়ন : রাসূলুল্লাহ সা. মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ফলে মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র গঠিত হয়। রাষ্ট্রগঠনের পর সব শ্রেণি, সব ধর্মাবলম্বীর মধ্য শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা. মদিনার সব নাগরিকের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে যাকে বলা হয় ‘মদিনা সনদ’। আর এই মদিনা সনদই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। রাসূলুল্লাহ সা. কতটা প্রাজ্ঞ, মেধাবী, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী ছিলেন, তা মদিনা সনদের মাধ্যমে মানবজাতি বুঝতে পারে। সব শ্রেণিপেশার মানুষের সবরকম অধিকার আদায়ে মদিনা সনদের বিকল্প নেই।

৫. অন্য সব রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক : মুহাম্মদ সা. মদিনায় একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে ইসলামের সুমহান খ্যাতির কথা মক্কা-মদিনার বাইরে অন্যান্য দেশে পৌঁছে যায়। রাষ্ট্রগঠনের মাধ্যমে আস্তে আস্তে সারা দুনিয়ার নজরে আসে ইসলাম। রাসূলুল্লাহ সা. রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে সর্বদা সুসম্পর্ক বজায় রাখেন। সামরিক বাহিনী গঠন করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তায় নতুন বিধান সংযোজন করেন।

৬. আল্লাহর সাহায্য : যাবতীয় দুনিয়াবি কৌশল ও উপায়-উপাদান ব্যবহার করার পরেই কেবল আল্লাহর বিশেষ রহমত নেমে আসে, যদি উদ্দেশ্য শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা হয়। হিজরতের পথে রাসূলুল্লাহ সা.-এর ওপরে যেসব গায়েবি মদদ এসেছিল, সেগুলো আল্লাহর সেই বিশেষ রহমতেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। 

পরিশেষে বলা যায়, মানবতার বন্ধু মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সা.-এর মদিনায় হিজরত একাধারে ইসলামকে সামাজিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, মানবিক সবদিক থেকে সমুন্নত করে তোলে। আল্লাহর জমিনে তাঁরই বিধান কায়েমে মদিনায় হিজরতের পর মদিনাকেন্দ্রিক যে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, সে আদলে ইক্বামাতে দীনের জন্য আমাদের জান-মাল দিয়ে সর্বাত্মক ও প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রতিবারের রবিউল আউয়াল মাসে দীপ্ত শপথ নেওয়া সময়ের অনিবার্য দাবি। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রধান মুহাদ্দিস (সহকারী অধ্যাপক), বিজুল দারুল হুদা কামিল স্নাতকোত্তর মাদরাসা, বিরামপুর, দিনাজপুর 

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির