বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদায় অনুষ্ঠানের নামে ‘র্যাগ ডে’ পালন করা হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে বিদায় অনুষ্ঠানকে ঘিরে দোয়ার মাহফিলের আয়োজন করা হলেও বর্তমানে এর রূপ নিয়েছে র্যাগ ডে নামে বিজাতীয় ও অপসংস্কৃতির দিকে। এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে র্যাগ ডে পালন করা হলেও বর্তমানে এর কালো থাবা ছড়িয়ে পড়েছে স্কুল ও কলেজগুলোতে। আর এসব র্যাগ ডের অশ্লীলতা আর বেহায়াপনার বিভিন্ন ছবি, ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব কার্যকলাপকে ঘিরে সৃষ্টি হচ্ছে অশ্লীলতা, উচ্ছৃঙ্খলতার মতো ঘটনা। র্যাগ ডে কেন্দ্র করে হিন্দি, ইংলিশ আর অশ্লীল গানের সাথে নেচে-গেয়ে আনন্দ-উল্লাস করছে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। হঠাৎ করে এ বছর বিদায় অনুষ্ঠান র্যাগ ডেতে রূপ নিলো। গত এক থেকে দেড় মাস যাবৎ ঢাকাসহ দেশের নামি-দামি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে র্যাগ ডে পালন, চলছে দেদার নাচ-গান, রঙের মাখামাখি। অনেক ক্ষেত্রে এসব অশ্লীল কার্যকলাপে শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়ছেন। দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদেরও এ ধরনের নাচ-গানে অংশ নিতে। মানা হচ্ছে না ছেলে-মেয়ের ভেদাভেদ। অনেক জায়গায় যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠছে। এসব নোংরামির ছবি, ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। আর এসব দেখার যেন কেউ নেই! র্যাগ ডের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, সাদা টি-শার্ট পরে চলছে উদ্দাম নাচ-গান। চলছে ডিজে পার্টি। একে আপকে জড়িয়ে ধরছে শিক্ষার্থীরা। কেউ মেতেছে রঙের খেলায়, আবার কেউবা সহপাঠীদের টি-শার্টে লিখছে অশ্লীল কথাবার্তা। যেসব শব্দ সীমা ছড়াচ্ছে অশ্লীলতার। এভাবে এখন উদযাপিত হয় স্কুলজীবনের শেষ দিন। যার নাম দেয়া হচ্ছে ‘র্যাগ ডে’। এসব র্যাগ ডের ভিডিওগুলোতে দেখা যাচ্ছে উচ্ছৃঙ্খলা আর অশ্লীলতার বিভিন্ন দৃশ্য। এমনকি স্কুল ছাড়ার আগে ভেঙে দেয়া হচ্ছে শিক্ষাজীবনে ব্যবহৃত আসবাবপত্র, বেঞ্চ ও টেবিল, নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে দেয়াল কিংবা টয়লেট। বাঁকা করে দেয়া হচ্ছে ফ্যানের হাতল। যে স্কুলটায় শৈশব-কৈশোর কাটলো, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জীবন চলার পথের কয়েক ধাপ এগিয়ে দিলো, বিদায় বেলায় সে স্কুলের সাথে কেন এমন নিষ্ঠুর আচরণ? বলা হয়, নৈতিকতা আর মূল্যবোধ শিখার আঁতুড়ঘর হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের মন-মানসিকতা গড়ে ওঠে এই তীর্থস্থানে। এমন আচরণে শিক্ষকদের নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে! কিছু কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, স্কুলপ্রাঙ্গণেই হচ্ছে ডিজে পার্টি আর অনৈতিক কাজ। এসব পার্টির অনেক ভিডিওতে শিক্ষকদেরও অংশ নিতে দেখা গেছে। যা দেখে ক্ষুব্ধ শিক্ষক মহল। এ বিষয়ে রাজধানীর উদয়ন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা জহুরা বেগম অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন, এটা একটা অপসংস্কৃতি ও অনৈতিক কাজ। বেসরকারি আর সরকারি যে প্রতিষ্ঠানই হোক, এটা অবশ্যই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। তিনি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেন, কোন প্রতিষ্ঠান এগুলো করে তা বের করে আনতে হবে এবং সেসকল শিক্ষকদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক সময় মাধ্যমিক স্কুল থেকে বিদায় নেয়ার সময় দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হতো। নাম ছিলো বিদায় অনুষ্ঠান। সেদিন অতীতের সকল ভুলের জন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে ক্ষমা চাওয়া হতো। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে বিশেষভাবে প্রার্থনা করা হতো। অতীতের সে শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন অভিভাবক। স্কুলজীবনের সে সময়ের বিদায় অনুষ্ঠান আর বর্তমান সময়ের র্যাগ ডে কী চোখে দেখছেন তারা? অনেকের মতে, তখন ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে বিদায় অনুষ্ঠান উদযাপন হতো। র্যাগ ডের ব্যাপারটা এতো ভয়ঙ্কর হবে এটা কেউ চিন্তা করেনি। পরিকল্পনা থাকতো, বিদায়ের সময় একটা দোয়ার মাহফিল করার। জুনিয়ররা খুব সুন্দরভাবে বিদায় দিতেন। সিনিয়ররা তাদের কাছে আইডল হিসেবে থাকতো। অভিভাবকরা মনে করেন, র্যাগ ডের নামে বর্তমানে যে সকল নোংরা ও অশ্লীল অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে, সেগুলোকে অচিরেই বন্ধ করা হোক। বর্তমান শিক্ষার্থীদের এমন আচরণকে মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবে দেখছেন বিশিষ্টজনেরা। প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেছেন, “এগুলো তারাই করে যাদের বেড়ে ওঠা সুন্দর ছিলো না। যাদের মধ্যে মূল্যবোধের সঙ্কট আছে। এখন এটা থেকে পরিত্রাণের বিষয় হলো। আমাদের দেশে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূল্যবোধের চর্চা করতে হবে।” যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একজন শিক্ষার্থীর নৈতিকতার ভিত্তি গড়ে দেয় সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে র্যাগ ডে নামে অনৈতিকতা বা উচ্ছৃঙ্খলতার চর্চা। স্কুল আর কলেজজীবনের শেষ দিনটিতে বিদায়ের নামে হচ্ছে এই র্যাগ ডে। যেখানে ছড়াচ্ছে নানা ধরনের অপসংস্কৃতি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কতটা প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা? কয়দিন আগে একজন সচেতন শিক্ষকের একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস সবার নজরে এসেছে। শিক্ষক লিখেছেন, “র্যাগ ডের নামে ১৫ থেকে ১৭ বছরের ছেলে-মেয়েরা গত এক সপ্তাহ ধরে যা করছে তা দেখার আগে আমাদের মৃত্যু হওয়া উচিত ছিলো। বিষয়টি তখনই আরো বেশি খারাপ লাগছে যখন দেখছি কিছু শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের এ কুৎসিত কাজে বাধা না দিয়ে নিজেরাও যুক্ত হচ্ছে। প্রতিদিন স্কুলে আসা বোরকা পরা মেয়েটিও র্যাগ ডের টি-শার্ট পরে নিজেদের স্পর্শকাতর জায়গায় অশ্লীল কথা লিখিয়ে আনন্দ পাচ্ছে। ছবি ও ভিডিও আপলোড করে দিচ্ছে ফেসবুক আর টিকটকে। বাহ্ বিদায়! শিক্ষকদের এখনো ক্ষমতা সীমিত কিন্তু অভিভাবক ও সমাজ এগিয়ে না এলে সত্যিই আমরা ভিন্ন এক সমাজে চলে যাবো। যে সমাজের চোখে কোন লজ্জা থাকবে না।” অনেকেই বলছেন, এ ধরনের ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এমন অশ্লীলতা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যোসাল ওয়েলফেয়ার ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর অধ্যাপক ড. গোলাম আজম বলেন, “সমাজ এভাবে চলতে থাকলে আগামী দু’-এক প্রজন্মের পর আমাদের সমাজে ‘নৈতিকতা’ শব্দটি আর থাকবে না। সমাজ থেকে লজ্জা-শরম সব উঠে যাবে।” শিশু ও কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা: হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “শিক্ষার্থীদের এসব বিদায় অনুষ্ঠান স্কুল কর্তৃপক্ষকে আয়োজন করতে হবে। যেন আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সমন্বিত থাকে। ফলে অশ্লীল ও বিজাতীয় সংস্কৃতিতে তারা ধাবিত হবে না। বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিদায় অনুষ্ঠান হতে পারে। কিন্তু অবশ্যই সেটা শালীনতার ভিত্তিতে হতে হবে। যেন আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির পরিমণ্ডলের সাথে সাংঘর্ষিক না হয় সেটা মনে রাখতে হবে। আরো একটি বিষয় মনে রাখতে হবে এটি যেন আমার স্কুল, আমার পরিবারকে কোনো ভাবেই অসম্মানিত না করে। সোস্যাল মিডিয়ায় আমাদের নিজেদেরকে প্রকাশ করা একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পিছনে একটা সাইকোলজি কাজ করে, যেটা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের আধিপত্য বিস্তার করা। লাইক, কমেন্টস ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কে এক ধরনের ডিক্রেশন হয়, এটা এক প্রকার আচরণগত আসক্তি। শুধুমাত্র মাদকাসক্তকেই আমরা আসক্তি বলি না, আচরণগত এই অভ্যাসকেও আসক্তি বলে থাকি।” র্যাগ ডে নামক এই ধরনের নগ্নতা কখনো শিক্ষার অংশ হতে পারে না। এতে আমাদের শিক্ষার্থীদের মারাত্মক চারিত্রিক স্খলন ঘটছে। অতিসত্বর এর বিরুদ্ধে আমাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে- যাতে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এসব পালিত না হয়। তবে অতি কষ্টের সাথে বলতে হচ্ছে, দেশের প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব নগ্নতা আরো বেশি হচ্ছে যার প্রভাব পুরো দেশের উপর পড়ছে। যা অত্যন্ত হতাশাজনক! এসকল বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করে শিক্ষার্থীদেরকে আদর্শিক ও নৈতিকভাবে গড়ে তোলে সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
আপনার মন্তব্য লিখুন