শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতা জীবন
মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত
১১ এপ্রিল ২০২২
চলতে ফিরতে বিভিন্ন স্থানে ‘শৃঙ্খলা বজায় রাখুন’ বাক্যটি কত শত বার দেখেছি তার কোনো হিসাব নেই। অফিস আদালত টার্মিনাল যানবাহন কোথায় দেখিনি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এত শতবার দেখার পরও কখনো সেভাবে একবারও ভাবার চেষ্টা করিনি এই লাইনটির গুরুত্ব কতটুকু, কেনইবা সব জায়গায় এই বাক্যটি সবাই ব্যবহার করছে। প্রচলিত একটি কথা আছে শৃঙ্খলাই জীবন। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের সচেতনতার লক্ষ্যে ‘শৃঙ্খলাই জীবন’ স্লোগানটি প্রতিপাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সে হিসেবে জীবনের আরেক নাম শৃঙ্খলা। শৃঙ্খলা জীবনের এক অতুলনীয় সৌন্দর্যের নাম। তার পাশাপাশি জীবন-সৌন্দর্যের আরেক নাম পরিচ্ছন্নতা। শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতা জীবন-সৌন্দর্যের নান্দনিক প্রতিচ্ছবি।
জীবন যখন এক যুদ্ধের নাম তখন এ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকে। অংশ নেয় তীব্র প্রতিযোগিতায়। তীব্র এ প্রতিযোগিতায় শৃঙ্খলা যদি না থাকে তাহলে বিজয়ী হওয়াতো দূরের কথা ছিটকে পড়ার আশঙ্কাই থাকে বেশি। একজন ব্যক্তির জীবনে বহু ধাপ আছে। বহু ধাপ অতিক্রম করেই ব্যক্তিকে সাফল্যের মঞ্জিলে পৌঁছতে হয়। তখন প্রতিটি ধাপেই তাকে অতি সন্তর্পণে এগোতে হয়। কোন এক ধাপে যদি ব্যক্তি হোঁচট খায় তাহলে সাফল্যের মঞ্জিলে পৌঁছা ব্যক্তির পক্ষে কখনো সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় ব্যক্তিজীবনের প্রতিটি ধাপে সফলতার সাথে অগ্রসর হওয়ার জন্য শৃঙ্খলা প্রয়োজন। শৃঙ্খলা ছাড়া ব্যক্তিজীবনে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে কখনো পৌঁছতে পারে না।
জীবনের সর্বাবস্থায় প্রতিটি পদক্ষেপে শৃঙ্খলা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনের পরিমন্ডলে শৃঙ্খলিত না হলে সমাজ ভেঙে পড়তে বাধ্য। ব্যক্তি যেখানে নিজেকে গড়ে তোলে আগামীর জন্য, সেখানে তার মধ্যে যদি শৃঙ্খলা না থাকে তাহলে গড়াতো দূরের কথা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা থেকেই ছিটকে পড়ার আশঙ্কা বেশি। ছাত্রজীবনে, পরিবারে, সমাজে, সংগঠনে, ক্যাম্পাসে, পাঠাভ্যাসে যদি শৃঙ্খলার চর্চা না হয় তাহলে বৃহত্তর কর্মক্ষেত্রে যখন পা বাড়াবে তখন তা হবে জীবনের জন্য দুর্বোধ্য দেয়াল। আগে শৃঙ্খলার চর্চা না থাকায় কর্মজীবনকে বেশি কষ্টসাধ্য এমনকি কঠিন আজাবের মত মনে হবে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, শৃঙ্খলাহীন জীবন হালহীন তরী আর কূলকিনারাহীন নদীর মত।
পৃথিবীর সকল সৃষ্টিই শৃঙ্খলার অধীন। যদি তা-ই না হতো তাহলে সব ধ্বংস হয়ে যেত। এই বিশাল ব্রহ্মান্ড, গ্রহ, নক্ষত্র সব কিছুই তার নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলছে। আল্লাহতায়ালা মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলেন, আর প্রত্যেকেই তার আপন কক্ষ পথে পরিভ্রমণ করছে। (সূরা ইয়াসিন : আয়াত ৪০) যুদ্ধক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ছাড়া কেউ জয়লাভ করতে পারে না। জীবনে সাফল্য লাভের প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে সাফল্য ছিনিয়ে আনা এক বিশাল যুদ্ধের নাম। এই সাফল্য অর্জনে শৃঙ্খলার কোনো বিকল্প নেই। ওয়াটার লুর যুদ্ধে নেলসন বীরবীক্রমে যুদ্ধ করে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেছিল। পরে পর্যালোচনা করে দেখা গেল যে, কী এমন শক্তি ছিল নেলসনের যা তাকে নেপোলিয়ানের বিরুদ্ধে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল। জানা গেল, শৃঙ্খলাই তাকে বিজয়ী করেছিল। স্যার উইনস্টন চার্চিলের মতে, যুদ্ধক্ষেত্র এমনকি সর্বক্ষেত্রেই শৃঙ্খলাই সাফল্য অর্জনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার।
যে ছাত্র নিয়মিত পড়াশোনা করে না, ক্লাসে অংশগ্রহণ করে না, প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন আদায় করে না, পড়ার সময় পড়া আর খেলার সময় খেলাকে গুরুত্ব দেয় না, নিয়মিত যথাসময়ে ঘুম থেকে ওঠে না, ইবাদত করে না আবার নিয়মিত যথাসময়ে ঘুমাতেও যায় না, তার জীবনকে প্রকৃত ছাত্রজীবন না বলে এক কথায় নিয়ম-নীতিহীন উচ্ছৃঙ্খল জীবন ছাড়া আর কী বলা চলে। এ সকল ছাত্রই জীবনের গতি হারিয়ে ফেলে, স্বাস্থ্য হারায়, রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত হয়, আর বছর শেষে তাদের সাফল্য খাতায় অর্জন শূন্য। তারা সফলতার দেখা কোনো দিনই পায় না। গোল্ডেন এ+ তো দূরের কথা, পাস করে কোনো রকম সাফল্য ছিনিয়ে আনাই তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়ে। কারণ, তারা ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে।
শৃঙ্খলার পাশাপাশি পরিচ্ছন্ন জীবন ব্যক্তিকে সাফল্য অর্জনে সহায়তা করে। পরিচ্ছন্নতাই জীবনের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য। ব্যক্তিজীবনের পরিচ্ছন্নতা, নিজের পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা এবং মনমানসিকতা ও চিন্তার পরিচ্ছন্নতা জীবন-সৌন্দর্যের গুরুত্বপূর্ণ দিক। শুধু সফলতা অর্জন করলেই ব্যক্তি বিজয়ী হয় না বরং জীবনের পরিচ্ছন্নতা সফলতাকে পূর্ণতা দান করে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে মহান আল্লাহ পরিচ্ছন্নতা অর্জনকারীকেই সফল বলে অভিহিত করেছেন। আল্লাহ বলেন, সে-ই সফলকাম হয়েছে যে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করেছে। (সুরা আ’লা : আয়াত-১৪)
পরিচ্ছন্নতা ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। আমাদের অনেকেই আছেন যারা পোশাকের চাকচিক্যেই পরিচ্ছন্নতার ভাব দেখান। বাস্তবে পরিচ্ছন্নতা থেকে তাদের অবস্থান অনেক দূরে। এরা যখন কোনো মজলিশে হাজির হন তখন এদের শরীর থেকে নিঃসৃত ঘামের দুর্গন্ধ উপস্থিতিকে অস্বস্তিতে ফেলে। অনেকে আছেন যখন কথা বলেন, তখন মুখ থেকে এমন দুর্গন্ধ বের হয় যে শ্রোতার বমি হওয়ার অবস্থা হয়। এরা কবে যে দাঁতে ব্রাশ ব্যবহার করেছে তারাই ভালো বলতে পারেন। কেউ এমন আছেন যাদের দিকে তাকালে মনে হবে শার্ট প্যান্টে দুনিয়ার সবার চাইতে তাদের সুন্দর এবং স্মার্ট লাগছে। কিন্তু যখন এরা জুতা থেকে পা বা পায়ের মোজা বের করেন তখন দুর্গন্ধে উপস্থিত সবাইকে নাক ধরতে বাধ্য করেন। পোশাক পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে আল্লাহ কুরআনে বলেন, তোমরা তোমাদের পোশাক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখ। (সূরা মুদ্দাচ্ছির : আয়াত-৪) পরিচ্ছন্নতা অর্জনকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, অবশ্যই আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অবলম্বনকারীদেরকে ভালোবাসেন। (সূরা বাকারা : আয়াত-২২২) হজরত আবু মালেক আশআরী (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা) বলেছেন: পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংশ। (মুসলিম) পরিচ্ছন্ন জীবনের পাশাপাশি মনমানসিকতাকে প্রফুল্ল রেখে সাফল্য অর্জনে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিজের পরিবেশেরও পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজন। তিরমিজি শরিফে হাদিসে কুদসিতে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্রতা ভালোবাসেন। তিনি পরিচ্ছন্ন, অতএব তিনি পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সাথে শরীরের সুস্থতা জড়িত। আমরা অনেকে আছি ব্যস্ততার কারণে কিংবা আলসেমি করে যথাসময়ে নিজেদের কাপড় পরিষ্কার করি না। মাসে কোনো একদিন কখনো বা সপ্তাহে অনেকগুলো কাপড় আমরা একসাথে ধোয়ার চেষ্টা করি। ছাত্রজীবনে এ প্রবণতা অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে আমি আমার সেজ ভাই নুর মুহাম্মদ ভাইয়ের শিখিয়ে দেয়া একটি পদ্ধতি এখনো অনুসরণ করার চেষ্টা করি। সেটা হলো ধোয়ার উপযুক্ত থাকলে প্রতিদিন কমপক্ষে একটি কাপড় ধোয়া। প্রতিদিন গোসলে যাওয়ার আগে ধোয়ার জন্য অন্তত একটি কাপড় নিয়ে গোসল করতে যাওয়া। তাহলে সপ্তাহ কিংবা মাস শেষে আর অনেকগুলো কাপড় একসাথে ধোয়ার কষ্ট সইতে হবে না। কাপড়ও নোংরা অবস্থায় পড়ে থাকবে না। কাপড় গুছিয়ে রাখা, নিয়মিত পরিষ্কার রাখা, যথাসময়ে চুল কাটা, নখ কাটা, নিজের বিছানা গোছগাছ করে রাখা, পড়ার টেবিল সুন্দর করে গুছিয়ে সাজিয়ে রাখা এসব কাজ খুবই নগণ্য হলেও এগুলো ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়।
পরিচ্ছন্নতার সৌন্দর্য প্রকাশের জন্য অনেক দামি কিংবা অসংখ্য জামা কাপড়ের প্রয়োজন নেই বরং দু-একটি পোশাকই পরিচ্ছন্ন জীবনের জন্য যথেষ্ট। যদি সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকালের সেরা মেধাবী ছাত্র শহীদ আবদুল মালেকের একটি মাত্র জামা ছিল। কিন্তু এই একটি জামা দিয়েই তিনি দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে ছুটে বেড়িয়েছেন ঢাকা শহরের প্রতিটি অলিগলি। কিন্তু কখনো তিনি অপরিচ্ছন্ন থাকেননি। সময়মত ধুয়ে শুকিয়ে এই একটি জামা গায়ে দিয়েই আবার বেরিয়ে পড়েছেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে। পোশাক পরিধানের সময় একটি বিষয়ে আমাদের অনেক বেশি সতর্কতা জরুরি। তা হলো টাখনুর নিচে প্যান্ট বা পায়জামা পরিধান না করা। এ ব্যাপারে আমরা অনেকেই বিষয়টি জানি না, আবার জেনেও সতর্কতা অবলম্বন করি না। এ প্রসঙ্গে দু’টি হাদিস উল্লেখ করছি- হজরত আবু যর (রা) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কিয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তিন ব্যক্তির সাথে কথা তো বলবেনই না বরং তাদের দিকে তাকিয়েও দেখবেন না। এমনকি তিনি তাদেরকে গুনাহ থেকে পবিত্র করবেন না বরং তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারা কারা? তবে এরা তো ধ্বংস, তাদের বাঁচার কোনো রাস্তা নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা তিনবার বলেছেন। তারা হলোÑ ১. যে ব্যক্তি টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে কাপড় পরে। ২. যে ব্যক্তি মিথ্যা কসম খেয়ে ব্যবসার পণ্য বিক্রি করে। ৩. যে ব্যক্তি কারো উপকার করে আবার খোঁটা দেয়। (মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ্) এ প্রসঙ্গে হজরত আবু হুরায়রা (রা) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, “কাপড়ের যে অংশ টাখনুর নিচে থাকবে তা জাহান্নামের আগুনে প্রজ্বলিত হবে।” (সহিহ বুখারি)
শৃঙ্খলা এবং পরিচ্ছন্নতা মানবজীবন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ দু’টি উপাদান। এ দু’টি উপাদান জীবনকে সুন্দর করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে, শৃঙ্খলিত রাখে, পবিত্র রাখে। সুন্দর এবং কল্যাণময় শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য যেমন শৃঙ্খলা প্রয়োজন তেমনি সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যও প্রয়োজন পরিচ্ছন্নতা। প্রচলিত একটি কথা আছে তাহলো শৃঙ্খলাই শৃঙ্খলমুক্তির পথ। আরেকটি কথাও বর্তমানে খুব প্রচলিত, শৃঙ্খলাই জীবন। আসুন আমরা সুশৃঙ্খল জীবনের অধিকারী হই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নান্দনিক সুন্দর এক জীবন গড়ি। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : এমফিল গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন