রাসূল (সা) ও তার সাহাবায়ে কিরামগণের পর ইসলামের ঝাণ্ডাবাহী ও ধারক-বাহক হিসেবে যারা গোটা দুনিয়ার অগণিত ইসলামী আন্দোলনের কর্মীর মানসপটে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে জাজ্বল্যমান, তন্মধ্যে সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ) অন্যতম। তিনি তাঁর পরিণত বয়স হতে পরবর্তী গোটা জিন্দেগি তাঁর মেধা, যোগ্যতা, সৃজনশীলতা এবং অফুরন্ত লেখনীশক্তির সবটুকু ইসলামের জন্য বিলীন করে অবশেষে জীবনটাকেই হাসিমুখে আল্লাহর রাহে কোরবান করে দিয়ে সারা দুনিয়ার ইসলামের সৈনিকদের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয় ও চিরভাস্বর হয়ে আছেন। সমসাময়িক পৃথিবীর অন্যতম সেরা শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাসংস্কারক, পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ইসলামের মাঝে তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের পথিকৃৎ, সেক্যুলার-নাস্তিক ও খোদাদ্রোহীদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রামী এক বিপ্লবী অগ্নিপুরুষ সাইয়েদ কুতুব (রহ)। আমাদের নিকট তিনি শুধু একজন ইসলামী চিন্তানায়ক, সমাজসংস্কারক, তাফসিরকারক এবং ইখওয়ানের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা হিসেবেই সমধিক পরিচিত। কিন্তু আধুনিক আরবি সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদান সম্পর্কে আমরা অনেকাংশেই নাওয়াকিফ। আলোচ্য লেখায় তার জীবনের সকল দিক ও বিভাগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচিতি তাঁর মূল নাম সাইয়েদ, কুতুব তাঁর বংশীয় উপাধি। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে ১৯০৬ সালের ৬ অক্টোবর শুক্রবার মিসরের আসইয়ুত জেলার মুশা নামক গ্রামে সাইয়েদ কুতুব জন্মগ্রহণ করেন। সাইয়েদের পিতার নাম হাজী ইবরাহিম কুতুব। তিনি পেশায় একজন কৃষক এবং অত্যন্ত ধর্মভীরু ছিলেন। তাঁর মাতার নাম ফাতিমা হোসাইন ওসমান। তিনিও অত্যধিক ধার্মিক নারী ছিলেন। দুই ভাই ও তিন বোন তথা পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সাইয়েদ ছিলেন সবার বড়। তাঁর অপর ভাই মুহাম্মদ কুতুব, যিনি সৌদি আরবের ‘উম্মুল কুরা’ ও ‘কিং আব্দুল আজিজ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইসলামিক স্টাডিজ’ এর শিক্ষক ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল মক্কায় ইন্তেকাল করেন। বোনেরা হলেন- হামিদা কুতুব, আমিনা কুতুব ও নাফিসা কুতুব। ইতিহাস থেকে পাওয়া যায়, তার পূর্বপুরুষগণ আরব উপদ্বীপ হয়ে মিসরের উত্তরাঞ্চলে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
শিক্ষা এবং কর্মজীবন গ্রামের অন্যান্য শিশুদের ন্যায় নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাইয়েদ কুতুবের শিক্ষা শুরু হয়। মায়ের একান্ত ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি শৈশবেই কুরআন হিফয্ করেন। পরবর্তীকালে তার পিতা কায়রো শহরের উপকণ্ঠে হালওয়ান নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষে তিনি কায়রোর তাজহিয়াতু দারুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯২৯ সালে ঐ মাদরাসার শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি কায়রোর বিখ্যাত মাদরাসা দারুল উলুমে ভর্তি হন। তাঁর বিরল প্রতিভা দেখে প্রধান শিক্ষক আশান্বিত হন যে, একদিন এ কিশোর অনেক বড় কিছু হবে। তিনি সব সময় যেই মসজিদ এ নামায পড়তেন সেখানে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক দারস দিতেন। তিনি সেগুলো বুঝতেন যা তার বয়সের অধিকাংশই বুঝতো না। তিনি উক্ত মাদরাসা থেকে ১৯৩৩ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ঐ মাদরাসায়ই অধ্যাপক নিযুক্ত হন। অধ্যাপনা শেষে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হন। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতির ওপরে অধিক জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেরণ করে।
আমেরিকা গমনের পথে সাইয়েদ কুতুব সমুদ্রপথে আমেরিকা যাচ্ছেন। সাগরে ঢেউয়ের তালে তালে জাহাজ চলছে। অথৈ পানির মাঝে চাঁদের কিরণ। জাহাজ সমুদ্রে সাঁতার কেটে নীল জলরাশির বুক চিড়ে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছে। সাইয়েদ গম্ভীর হয়ে ভাবছেন আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে। নিজে নিজে ভাবছেন, আমি কি সেই আমেরিকা যাচ্ছি, যারা খাওয়া ও ঘুমকেই যথেষ্ট মনে করে! যারা ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে! বৈধ-অবৈধের কোনো সীমারেখা নেই যাদের জীবনে! তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আমেরিকায় গিয়ে ইসলামের ওপর অবিচল থাকবেন। মনে মনে ভাবলেন, আমি এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছি। আল্লাহর এই বান্দা জাহাজেই পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। সাইয়েদ কুতুব তার কক্ষে অবস্থান করছেন। বাহির থেকে কে যেন দরজায় নক করছে। তিনি দরজা খুলেই চমকে উঠলেন। এক সুন্দরী রূপসী যুবতী নগ্নপ্রায় দেহে তার সামনে দণ্ডায়মান। সাইয়েদ কুতুবকে সুন্দরী রমণী বললেন। জনাব, আমি কি আজ রাতে আপনার রুমের মেহমান হতে পারি? সাইয়েদ কুতুব জবাব দিলেন, দুঃখিত। রুমে একটিই খাট। আর তা একজনের জন্যই নির্ধারিত। কুতুবের এই কথা শুনার পর যুবতী বলল, খান এত প্রশস্ত যে, এতে দু’জনই থাকা যায়। যুবতী ঘরে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। আল্লাহর ভয়ে ভীত সাইয়েদের মন যুবতীর দিকে একটুও টলেনি। তিনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি কি আমার দর্শনে সত্যবাদী, না এটা মনের কল্পনা, তা বাস্তবে পরীক্ষা হবে। একজন খ্রিস্টানকে মুসলমানদের মাঝে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার করতে দেখে সাইয়েদের মাঝে ঈমানী চেতনা জাগ্রত হলো। তিনি কাপ্তানের কাছে গেলেন। জাহাজে আরোহী সকল মুসলমানের জুমার নামায আদায়ের সুযোগদানের জন্য আবেদন করলেন। কাপ্তান সম্মত হলেন। সাইয়েদ জুমার পূর্বে চমৎকার খুতবা দিলেন এবং নামাযে ইমামতি করলেন। আরোহীরা বিমোহিত চিত্তে তাকিয়ে রইলো। যুগোশ্লাভিয়ার জনৈকা খ্রিস্টান মহিলা কুরআন তিলাওয়াত শুনে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলেন।
আমেরিকায় দুই বছর সাইয়েদ দুই বছর আমেরিকায় অবস্থান করেন। সেখানে অজস্র অনৈতিক ও অশালীন ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের নগ্নতা দেখে ভাবলেন, তারা প্রবৃত্তির দাস হয়ে কতই না অধঃপতিত জীবন যাপন করছে! হাসপাতালে মহিলা রোগীকেও যৌন অত্যাচারের শিকার হতে দেখলেন। সমমৈথুনে লিপ্ত হচ্ছে নর-নারী। তাঁরও পদস্খলন ঘটাতে চেষ্টার কমতি ছিল না। আল্লাহর অসীম রহমতে তিনি ইসলামের ওপর অবিচল থাকতে পেরেছেন। তিনি আমেরিকা থাকাকালে ১৯৪৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইখওয়ানের মুর্শিদে আ’ম ইমাম হাসানুল বান্না আততায়ীর গুলিতে শাহাদাতবরণ করলে আমেরিকায় পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক উল্লাস প্রকাশ করা হয়। এতে তিনি দারুণভাবে ব্যথিত হয়ে ইখওয়ানের প্রতি অনুরক্ত হন।
ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাইয়েদ আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পরই তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি গভীরভাবে যাচাই করতে শুরু করেন। তিনি ব্রাদারহুডের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সাথে একমত হয়ে ১৯৫৩ সালে ঐ দলের সদস্য হন। তিনি তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করে ইখওয়ানের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। লেখনী, বক্তৃতা, নেতৃত্ব সকল ক্ষেত্রেই তিনি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। ১৯৫৩ সালে তিনি দামিশ্ক সফর করেন এবং সেখানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে বক্তৃতা দেন। সাইয়েদ কুতুব দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। আশ্চর্যের বিষয়, তিনি লিখিত কোনো নোট ছাড়াই তথ্যবহুল দীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেন। এরপর তিনি আরেক কনফারেন্সে বায়তুল মোকাদ্দাস যান। সেখান থেকে জর্দান সফর করেন। আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময়ের সময় তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক গঠনমূলক চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সাইয়েদের ভূমিকায় ইখওয়ানের মুর্শিদ-ই-আম ওস্তাদ ড. হাসান হুদাইবি মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত করেন।
গ্রেফতার ও নির্যাতন বিশ্ববিখ্যাত মহান এই ব্যক্তির উপর বর্ণনাতীত নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। ১৯৫৪ সালে সাইয়েদ কুতুবকে ইখওয়ান পরিচালিত সাময়িকী-ইখওয়ানুল মুসলিমিন-এর সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। তার সম্পাদনা দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাস পরেই কর্নেল নাসের সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। কারণ ঐ বছর মিসর সরকার ও ব্রিটিশের মাঝে কৃত চুক্তির কঠোর সমালোচনা করে উক্ত পত্রিকা। পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ার পর নাসের সরকার ইখওয়ান কর্মীদের ওপর কঠোর নির্যাতন শুরু করে এবং এক বানোয়াট হত্যা-ষড়যন্ত্র মামলার অভিযোগ এনে দলটিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং দলের নেতাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করা হয় সাইয়েদ কুতুবকেও। গ্রেফতারের সময় সাইয়েদ কুতুব ভীষণভাবে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। সামরিক অফিসার তাকে ঐ অবস্থায় গ্রেফতার করে এবং হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। এ অবস্থায় তাঁকে কোনো গাড়িতে না চড়িয়ে জেল পর্যন্ত হেঁটে যেতে বাধ্য করা হয়। অত্যধিক অসুস্থতার কারণে চলতে গিয়ে তিনি বার বার বেহুঁশ হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি উচ্চারণ করতেন, “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ”। জেলে প্রবেশ করার সাথে সাথে হিংস্র জেল কর্মচারীরা তাকে নির্মমভাবে মারপিট করতে থাকে এবং দু’ঘণ্টা ধরে এ অত্যাচার চলতে থাকে। পুলিশ লাথি, ঘুষি মেরে একদিক থেকে অন্য দিকে নিয়ে যেত। এতেই শেষ নয়, বর্বর জালেমরা তাঁর ওপর একটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দেয়। কুকুরটি তাঁর পা কামড়ে ধরে জেলের আঙিনায় টেনে নিয়ে বেড়াতে থাকে। এর পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি নির্জন কক্ষে। সেখানে তাঁকে একটানা সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এমনও হয়েছে যে, একাধারে চার দিন তাঁকে একই চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে, কোন খাবার-পানীয় দেয়া হয়নি। তাঁর সামনেই অন্যরা উল্লাস করে পানি পান করতো অথচ তাঁকে এক গ্লাস পানিও দেওয়া হতো না। হায়রে নিষ্ঠুরতা! রক্তাক্ত বেদনায় জর্জরিত শরীর এসব শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করার মতো ছিল না। কিন্তু ঈমানের বলে বলীয়ান পাহাড়ের মতো অবিচল মর্দে মুজাহিদ এসব অমানুষিক অত্যাচার অকাতরে সহ্য করেন। কয়েদখানার এক সাথী সাইয়েদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, হাসপাতালের নিকট দিয়ে তিনি ধীর কদমে এগুচ্ছিলেন। তাঁর প্রশস্ত কপাল থেকে অন্তরের দ্যুতি স্পষ্ট ঝিলিক মারছিল। চোখের চমক থেকে ঝরে পড়ছিল নূরের ধারা। তিনি এমনভাবে টেনে টেনে মাটির উপর পা ফেলেছিলেন, যেন তা শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। পায়ের অস্বাভাবিক ফুলা জল্লাদের নিষ্ঠুরতার জন্য যেন আর্তনাদ করছিল। সাইয়েদ কুতুব ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ‘তাররা’ কারাগারে ছিলেন। ১৯৬৪ সালে ইরাকের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট আবদুস সালাম আরিফ কায়রো সফর করেন। ইরাকি আলেমদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইরাকি প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরের সাথে বৈঠককালে সাইয়েদ কুতুবকে মুক্তি প্রদানের অনুরোধ জানান। তাঁর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সাইয়েদ কুতুবকে মুক্তি প্রদান করা হয়। কর্নেল নাসের তাঁকে মুক্তি দিয়ে অত্যন্ত কড়া নজরদারিতে তারই বাসভবনে অন্তরীণাবদ্ধ করেন।
ষড়যন্ত্রের নতুন অধ্যায় ১৯৬৫ সালের ২৭ আগস্ট মস্কো থেকে নাসের দেশে ফিরে এলে শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। পুনরায় গ্রেফতার করা হলো সাইয়েদ কুতুবকেও। শুধু তাকেই নয়, তার ভাই মুহম্মদ কুতুব, ভগ্নি হামিদা কুতুব ও আমিনা কুতুবসহ বিশ হাজারেরও বেশিসংখ্যক লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। এদের মধ্যে প্রায় সাত শ’ ছিলেন মহিলা। ইখওয়ানের প্রতি যেসব অভিযোগ আরোপ করা হয় তার প্রথমটি ছিল, ইখওয়ান একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিল- যার নেতা ছিলেন সাইয়েদ কুতুব। এরা প্রেসিডেন্ট নাসেরের হত্যা পরিকল্পনা, বিশেষ ট্রেনগুলোর ধ্বংসের প্রশিক্ষণ দিত এবং অভিযুক্তদের জন্য আর্থিক সাহায্য এবং অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করতো। দ্বিতীয় অভিযোগ আনা হয় ‘মায়ালেম ফিত ত্বরিক’ পুস্তক লেখার জন্য। ইখওয়ানের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছিল তা ছিল বাহানামাত্র। আসল ব্যাপারটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইখওয়ান নেতা-কর্মীদের বিচার শুরু হলো বিশেষ সামরিক আদালতে। ট্রাইব্যুনালের বিচারক জামাল নাসেরের সাথে দীর্ঘ আলোচনা করে ১৯৬৬ সালের ২১ আগস্ট রায় ঘোষণা করেন। অভিযুক্ত ৪৩ জন নেতাকর্মীর মধ্যে সাতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এরা হচ্ছেন সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ ইউসুফ, আব্দুল ফাত্তাহ ইসমাঈল, শবরী আরাফাহ, আহমদ আবদুল মজিদ, আব্দুল আজিজ ও আলী উসমাভী।
সাইয়েদের ফাঁসি ২৮ আগস্ট ১৯৬৬। রাতে সাইয়েদ কুতুব ও তার দুই সাথীকে ফাঁসির সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। ২৯ আগস্ট ভোর রাত। সমগ্র জাহানের আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ যখন জায়নামাযে তাহাজ্জুতে মগ্ন, ঠিক তখন সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর দুই সঙ্গীকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হলো। ইতোমধ্যেই ফাঁসির সকল আয়োজন শেষ করে ফেলেছে কারা কর্তৃপক্ষ। সাইয়েদ অত্যন্ত আনন্দিত। নির্ভীকচিত্তে বীরদর্পে তিনি পা বাড়াচ্ছেন, মুখে তাঁর রাজ্যজয়ের হাসি। তাঁর ফাঁসিমঞ্চে যাবার প্রাক্কালে দৃপ্ত পদচারণার অবিশ্বাস্য দৃশ্যাবলি যে সকল সাংবাদিক ও কারা কর্মকর্তাগণ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন, তারা পরবর্তীতে সেসকল ঘটনাবলির বর্ণনা দিয়েছেন। ফাঁসির পূর্ব রাতে সাইয়িদকে কালিমা পড়ানোর জন্য জেলের ইমামকে পাঠানো হলো। জেলের ইমাম এসে সাইয়িদকে কালিমার তালকিন দেয়ার চেষ্টা করে। এমন সময় তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আপনি কি জন্য এখানে এসেছেন? ইমাম বললেন, “আমি আপনাকে কালিমা পড়াতে এসেছি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে আসামীকে কালিমা পড়ানো আমার দায়িত্ব। সাইয়িদ বললেন, “এই দায়িত্ব আপনাকে কে দিয়েছে?” ইমাম বললেন, “সরকার দিয়েছে।” সাইয়িদ বললেন, এর বিনিময়ে কি আপনি বেতন পান? ইমাম বললেন, “হ্যাঁ! আমি সরকার থেকে বেতন-ভাতা পাই। তখন সাইয়িদ কুতুব (র) সেই ইমামকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি জানেন কি কারণে আমাকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে ?” ইমাম বললেন, “বেশি কিছু জানি না।” সাইয়িদ বললেন, “আপনি আমাকে যেই কালিমা পড়াতে এসেছেন, সেই কালিমার ব্যাখ্যা লেখার কারণেই তো আমাকে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। কি আশ্চর্য! যেই কালিমা পড়ানোর কারণে আপনি বেতন-ভাতা পান সেই কালিমার ব্যাখ্যা মুসলিম উম্মাহকে জানানোর অপরাধেই আমাকেই ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, আপনার কালিমার বুঝ আর আমার কালিমার বুঝ এক নয়। অতএব আপনার কোন প্রয়োজন নেই।” সুবহে সাদিকের আলো ঝলমল ধরিত্রী যেন আজ গভীর বেদনাপ্লুত। সাইয়েদ কুতুব হাসতে হাসতে ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন। চারদিকে ভেসে উঠল ফজরের আযান। এমনি এক পবিত্র পরিবেশে কার্যকর করা হলো ইতিহাসের ঘৃণ্যতম আয়োজন, সাইয়েদ কুতুব ও তাঁর সঙ্গীদের ফাঁসি। সারাবিশ্বের অগণিত মানুষকে কাঁদিয়ে সাইয়েদ কুতুব পৌঁছে গেলেন তার পরম প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে।
আরবি সাহিত্যের অমর সাহিত্যিক আরবি সাহিত্যের একজন ছাত্র হিসেবে সাইয়েদ কুতুবকে (রহ) আরবি সাহিত্যের পরতে পরতে অপাঙক্তেয় দেখেছি। অনেক মুসলিম নামধারী নাস্তিক-আধানাস্তিক সাহিত্যিকদের লেখা আরবি সাহিত্যের সিলেবাসভুক্ত হলেও কুতুব (রহ) বরাবরই থেকেছেন অধরাপ্রায়। অসংখ্য অশালীন কাব্যের রচয়িতা কবি-সাহিত্যিকদের জীবনী পড়ানো হলেও আরবি সাহিত্যে এম.এ পাস করা একজন শিক্ষার্থী তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ বছরে শুধুমাত্র এম.এ ক্লাসে সাইয়েদের লিখা প্রখ্যাত তাফসির “ফি যিলাযিল কুরআন” এর মাত্র দুটি সূরা সিলেবাসভুক্ত। তবুও সাহিত্যিক হিসেবে নয় যেন একজন তাফসিরকারক হিসেবেই তাকে খণ্ডিতরূপে পরিচিত করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর সাহিত্যকর্ম যে এত বেশি সমৃদ্ধ, তাকে নিয়ে একটু পড়াশোনা করলেই জানা যাবে। সাইয়েদ কুতুব ছিলেন মিসরের প্রখ্যাত আলেম ও সাহিত্যিকদের অন্যতম। তিনি জীবনের প্রথম ধাপে একজন বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক এবং সাহিত্য সমালোচক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ছোটদের জন্যে আকর্ষণীয় ভাষায় নবীদের কাহিনী লিখার মাধ্যমে তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা হয়। পরবর্তীকালে ‘আশওয়াক’ (কাঁটা) নামে ইসলামী ভাবধারাপুষ্ট একটি উপন্যাস রচনা করেন। পরে একই ধরনের আরও দু’টি উপন্যাস রচনা করেন। একটি ‘তিফলে মিনাল ক্বরইয়াহ’ (গ্রামের ছেলে) ও অন্যটি ‘মাদিনাতুল মাসহুর’ (যাদুর শহর)। নিম্নে তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম উল্লেখ করা হলো: মুশাহিদুল ক্বিয়ামাহ ফিল কুরআন (কুরআনের আঁকা কেয়ামতের দৃশ্য); পবিত্র কুরআন গবেষণা করতে গিয়ে কুরআনের পরতে পরতে তিনি যে অপার সৌন্দর্যের আঁধার খুঁজে পেয়েছেন, তা তিনি কাগজের পাতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। এ সম্পর্কে তার বই- আত্-তাসবিরুল ফান্নি ফিল কুরআন (কুরআনের আলঙ্কারিক চিত্র), এছাড়াও - আল আদালাতুল ইজতিমাঈয়া ফিল ইসলাম (ইসলামের সামাজিক সুবিচার), “মা’রিকাতুল ইসলাম ওয়া আলরা’স মালিয়্যাহ” (ইসলাম ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব), “আসসালামুল আলামী ও আল ইসলাম” (বিশ্বশান্তি ও ইসলাম), দারাসাতিল ইসলাম (ইসলামী রচনাবলী), ইসলামী সমাজের চিত্র, আশাতিল মাজহুল (কবিতগুচ্ছ), কুতুব ওয়া শাখসিয়াত (গ্রন্থাবলি ও ব্যক্তিত্ব), জীবনে কবির আসল কাজ, ১৯৩৯ সালে ড. ত্বহা হুসাইনের একটি বইয়ের সমালোচনামূলক গ্রন্থ- ভবিষ্যৎ সংস্কৃতি, আমেরিকায় তিনি যে অশালীন ও বল্গাহারা সমাজব্যবস্থা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা সংবলিত লেখা- আমি যে আমেরিকা দেখেছি (The America I have seen), তার পরিবার গোটা পৃথিবীর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের জন্য প্রেরণার এক অত্যুজ্জ্ব¡ল বাতিঘর। বাবা না থাকায় তিনি বাসায় ফিরে তার ভাই-বোনদের নিয়ে বসে যেতেন জ্ঞানচর্চায়। চার ভাই বোনের চিন্তাধারা: সাইয়েদ কুতুব, মুহাম্মদ কুতুব, আমিনা কুতুব ও হামিদা কুতুব, সমসাময়িক সময়ের খোদাদ্রোহী শাসকগোষ্ঠীর মগজ এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল যে বইটি রচনার জন্য এবং যার কারণে তাকে শেষতক ফাঁসির দড়ি গলায় পরতে হয়েছিল সেটি হলো- ইসলামী সমাজ বিপ্লবের ধারা, (মা'আলিম ফিত তারিক্ব) (Milestone). সাহিত্য সমালোচনায় তাঁর অমর গ্রন্থ- আন্-নাক্বদুল আদাবি উসুলিহি ওয়া মানাহিযিহি (সাহিত্য সমালোচনার মূলনীতি ও পদ্ধতি)
তাঁর সাহিত্য রচনায় তিনি ছিলেন রেশম-কোমল, অনুভূতিতে ছিলেন অত্যন্ত প্রখর, এবং প্রচণ্ড আবেগময়। সাহিত্য সমালোচকগণ তাকে রোম্যান্টিক ধারার সাহিত্যিক বলে দাবি করেছেন। আরব বিশ্বের খ্যাতনামা সাহিত্যসমালোচক মুহাম্মাদ মানদুর তাকে রোম্যান্টিক ধারার লেখকদের পীঠস্থান “এ্যাপোলো” সাহিত্যসংঘের একজন নিয়মিত সদস্য বলে উল্লেখ করেছেন। তবে গদ্য সাহিত্যে তিনি ছিলেন আব্বাস মাহমুদ আল-আক্কাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী। সাইয়েদ কুতুব দারুল উলুম ইউনিভার্সিটির (কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়) ছাত্র হলেও, এবং ইমাম হাসান আল-বান্নার সহপাঠী হয়েও এই সময় তার মধ্যে ইসলামী ভাবধারা প্রকাশ পায়নি। লন্ডন প্রবাসী প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, সুলেখক ও সুবক্তা ড. আব্দুস সালাম আজাদী বলেছেন- “তার লেখা ‘উসুল আল নাকদ আল আদাবি’ বইটা আমরা মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। এতে দেখতে পেয়েছি সাইয়েদ আরব বিশ্বের জন্য সাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছেন। তিনি সাহিত্য সমালোচনাকে প্লেটো ও আধুনিক অন্যান্য দর্শনের নিগড় থেকে বের করে মানুষের এক অনাস্বাদিত ভুবনে নিয়ে আসতে চেয়েছেন। ইসলামী সাহিত্যের একটা নতুন দিগন্তের সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর ‘ফিত তারিখ ফিকরাহ ওয়া মিনহাজ’ বা ইতিহাস থেকেই দর্শন ও পদ্ধতি বইতে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামী সাহিত্য বলতে কী বুঝায় তিনি তা বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এককথায়, তিনি ছিলেন আধুনিক আরবি সাহিত্যের এক অন্যতম দিকপাল, যার যাদুস্পর্শে এ সাহিত্য হয়েছিল অধিকতর সমৃদ্ধ।
জীবনের শেষলগ্নে এসে সাইয়েদের চিন্তাধারায় কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মুহাম্মাদ আলমাহদি আলবাদরি বলেন- “১৯৬৫ সালে আমি যখন সাইয়েদের সাথে জেলের কুঠুরিতে, তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার আগেকার বিশ্বাস থেকে ফিরে এসেছি। আমি যা বিশ্বাস করি তা মাআলিম ফিততারিক, যিলালের শেষের খণ্ডগুলো, যিলালের দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম ভলিউমগুলোয়, ‘খাসাইসুত তাসাওউর আল ইসলামী ওয়া মুকাওয়িমাতুহ’ বা ‘ইসলামী দর্শনের বৈশিষ্ট্য ও তার মৌলিক উপাদান’ এবং ‘ইসলাম ওয়া মুশকিলাতুল হাদারাহ’ বা ‘ইসলাম ও সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ গ্রন্থগুলোতে বর্ণনা করেছি’। তখন আমি তাঁকে বললাম : তাহলে আপনি ইমাম শাফেয়ীর মত হলেন। প্রতিটি মাসআলায় তাঁর প্রায়ই দুইটা অভিমত থাকে। একটা বর্তমানের, আরেকটা আগের। তিনি বললেন: ‘হ্যাঁ, তাই বলতে পারো, আমি চেঞ্জ করেছি, যেমন ইমাম শাফেয়ী চেঞ্জ করতেন। তবে ইমাম শাফেয়ি চেঞ্জ করেছেন শাখা প্রশাখা গত মাসআলা মাসাইলে, কিন্তু আমি চেঞ্জ করেছি উসুলে, বা মৌলিক নীতিমালায়”। (ইবনুল কারয়াহ : ২/৬২)
মুসলিম উম্মাহর এহেন ক্রান্তিলগ্নে আজ অসংখ্য সাইয়েদ কুতুবের প্রয়োজন, যারা বাতিলের অজস্র ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে উম্মাহর জন্য লড়ে যাবে আমরণ।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
আপনার মন্তব্য লিখুন