post

সামাজিক কাজ ও সামাজিক আন্দোলনের গুরুত্ব

ড. মোঃ আব্দুল বারী

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ভূমিকা

মানুষ মাত্রই সামাজিক জীব। সমাজ ব্যতীত মানুষ তার ব্যক্তি বা প্রতিভাকে ফুটিয়ে তুলতে পারে না। মানুষ সৃষ্টির সূচনা হতে সমাজবদ্ধতার বাইরে গিয়ে তারা কোনো আবহ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই মানুষকে সামাজিক জীব হিসেবে স্বভাবতই বসবাস করতে হয়। সামাজিক কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেকে যেমন পরিস্ফুটিত করতে পারে, তেমনি সমাজের মধ্যে একটি দীর্ঘ সময়ের প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে- যা যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে। মানুষ মুসলিম হিসেবে সামাজিক কাজ ও আন্দোলন করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। মুসলিম ব্যক্তির নিজস্ব বলতে কিছু থাকে না। কেননা, একজন মুসলিম দৈনন্দিন জীবনে যা কিছু করে তার উদ্দেশ্য থাকে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক। মুসলিম জীবনের এ অনুভূতি কুরআন ও সুন্নাহ তথা রাসূল (সা.)-এর জীবনী হতে অনুধাবন করা যায়। তাই সামাজিক কাজ করতে হলে সেই সামাজিক ব্যক্তিকে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের আদর্শ ও নীতির অনুসরণের মাধ্যমে প্রতিপালন করতে হবে। অনুসরণের জন্য সামাজিক কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের সামাজিক কাজ এবং তিনি এ কাজ কীভাবে বাস্তায়ন করেছেন, তা যথাযথভাবে জানতে হবে। আজকের সমাজে অধিকাংশ সামাজিক কর্মীদের প্রিয়নবির সামাজিক কাজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই; এমনকি রাসূলের কাজের চেয়ে অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানীদের সম্পর্কে অধিক (জ্ঞান) নলেজ রয়েছে, যা বাস্তবে লক্ষ্যণীয়। এ সকল সমাজকর্মীদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের আদর্শ জানার ব্যবস্থা করলে, তারা সেই আলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ন্যায় আদর্শ সামাজিক কাজ ও সামাজিক আন্দোলন তৈরি করতে সচেষ্ট হতো। এ বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রেখে আজকের নাতিদীর্ঘ আলোচনা উপস্থাপন করা হয়েছে। 

সামাজিক কর্মীর গুণাবলি

সামাজিক কাজ যারা করতে চায়, সে সকল উদ্যমী মানুষদের কিছু বৈশিষ্ট্য থাকা একান্তভাবে বাঞ্চনীয়। এ গুণাবলির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের নিকট সামাজিক কর্মীরা ভালোবাসা ও গ্রহণ যোগ্যতা লাভ করতে পারে। যথা-

সমাজ কর্মীর কাক্সিক্ষত অনুভূতি : মুসলিম সমাজ কর্মী যিনি সামাজিক কাজের উদ্যোগ নেবেন তাঁর নিজের জীবন সম্পর্কে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ অনুভূতি থাকতে হবে। তিনি রাসূল সাল্লাহু আলাইহিস সালামের কর্মচিন্তার মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন। এর বাইরে তাঁর অনুভূতি কাজ করলে সকলের দৃষ্টিতে যোগ্য সমাজকর্মী হলেও প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সমাজকর্মী হিসেবে পরিগণিত হতে পারবেন না। তা ছাড়া সে সমাজকর্মী ও তাঁর কর্ম সামাজিক ব্যবস্থাপনায়  টেকসই হওয়া সম্ভব হবে না। তাই সামাজিক কাজে নিয়োজিত কর্মী কাক্সিক্ষত গুণাবলিতে অভিষিক্ত হলে সে সমাজ, কর্মী এবং সামাজিক কাজ টেকসই হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

ইসলামের যথাযথ জ্ঞান : সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে কাজ বাস্তবায়ন করতে হলে তাঁকে ইসলামের পরিপূর্ণ জ্ঞান ও সামসাময়িক সময়ের বাস্তব ভিত্তিক জ্ঞান থাকতে হবে। নাহলে এ কাজ ইসলামের নীতি ও পদ্ধতি যথাযথভাবে প্রতিপালন ও প্রয়োগ করা সম্ভব হবে না। প্রশ্ন আসতে পারে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন সমাজকর্মী তৈরি করা অসম্ভব। তাহলে এর জবাব হাজির হবে আরও কঠিন উত্তর নিয়ে; আর তা হলো, মুসলিম সামাজিক মজবুতির কাজ করাও অসম্ভব হবে। কেননা, মুসলিম ব্যক্তিকে বুঝতে হবে তিনি সামাজিক কাজ করছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের দেখানো ও শেখানো পদ্ধতির মাধ্যমে। তিনি যদি তা না জানেন, তাহলে তাঁর শেখানো পথে কীভাবে মানুষকে আহ্বান করবেন? অন্যথায় তার কাজ যত সুন্দর বা বাহবা পাওয়ার মতো হোক, যদি রাসূলের (সা.) অনুমোদিত পথে বা রাস্তায় না হয়, তবে তা ভঙ্গুর হতে বাধ্য। তাই সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে অবশ্য অবশ্যই ইসলামের যথার্থ জ্ঞান থাকতে হবে। কেননা, ইসলামে সকল কাজ জ্ঞান আহরণের ওপর নির্ভরশীল। 

সর্বদা আল্লাহর স্মরণ : পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, সামাজিক কাজে যিনি নিজেকে নিযুক্ত করবেন, তিনি ইসলাম সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখবেন। সামাজিক কর্মী ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর হতে শুরু করে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত যতগুলো কাজ করবেন, সে কাজের প্রতিটি পরতে ইসলামের দিক নির্দেশনা সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। কোন কাজটি আগে করতে হবে এবং কোন কাজ ধারাবাহিকতা রক্ষা করে করতে হবে, সে সম্পর্কে তাকে সম্যক অবগত থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমাদের নবিজির ব্যবহারিক জীবনের কোন কোন দিক বা বিভাগ। যেমন : তিনি ঘুমাতে গেলে কী বলে ঘুমিয়ে পড়তেন ইত্যাদি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের ব্যবহারিক এমন ছোট ছোট আমলগুলো কি সমাজকর্মীর অনুভূতিতে সুস্পষ্টভাবে প্রথিত রয়েছে? তিনি যা বলে ঘুমিয়ে যেতেন তা কি তিনি বুঝে বলতেন? আমাদের সমাজের মুসলিম ব্যক্তিরা কম-বেশি সবাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের শেখানো দোয়া পড়ি। সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করার নিমিত্তে বলে থাকি। কিন্তু যে দোয়া বা বাক্য মুখে বলি, তা রাসূলের মতো হয় না। রাসূল যেভাবে বুঝে বলতেন তা হয় না। যেমন : আমরা যারা সাধারণ মানুষ বা সামাজিক কর্মী বা সমাজের জন্য কাজ করতে চাই, তারা প্রত্যেকে ঘুমানোর পূর্বে বলি, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেছেন)- “হে আল্লাহ! তোমার নাম নিয়ে মারা যাচ্ছি এবং (আশা রাখি) আবার জীবিত হব ” (আল-মুসান্নাফ ইবনু আবী শায়বা, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ.৩৮) 

সামাজিক কাজে নিয়োজিত মানুষগুলো কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম যে অনুভূতি নিয়ে এ কথাগুলো উচ্চারণ করতেন, সে অনুভূতি নিয়ে তা বলে? এ বিষয়টি লক্ষ্য করা অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে রাসূল (সা.) নিজ জীবনে বা সামাজিক জীবনে যেমন একটি টেকসই অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিলেন, আমরা তা করতে ব্যর্থ হব- এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। উক্ত উদাহরণটিতে আরও লক্ষ্য করা যায়, অনেক মানুষ ঘুমানোর পর আর কখনই জেগে উঠেননি। সে ঘুমের মধ্যেই নিজের অজান্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। তাই ঘুমকে মৃতে্যুর সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। 

সমাজকর্মী সকল কাজের প্রতিদান মহান রবের কাছে আশা করে মানব কল্যাণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন এবং এই কাজকে আল্লাহর আমানাত হিসেবে মনে রেখে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন। তাহলে কাজের মধ্যে নিজে যেমন তৃপ্তি অনুভব করবেন, তেমনি যারা এ কাজের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছেন তাঁরাও সে সমাজ কর্মীর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন। আইয়ামে জাহিলিয়া তথা আবরেব ঘোর অন্ধকার যুগে মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম এতিম, দুঃখী, অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে যেভাবে পিছিয়ে পড়া মানবগোষ্ঠীর ভালোবাসা অর্জন করেন; আবার ধনী মানুষদের ধন-সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ, প্রতিদ্বন্দ্বী গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ নিরসন করে ধণিক শ্রেণির মানুষের কাছে গ্রহণযাগ্যতা লাভ করেছিলেন। তাঁর অনুসরণের মাধ্যমে বর্তমান সময়ের সমাজকর্মীকে সামাজিক কাজের মাধ্যমে সমাজের ধনী-দরিদ্র সব মানুষের নিকটে তেমনি সুপরিচিতি লাভ করবেন। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম যেমন তৎকালীন ধনী-গরিব সকল শ্রেণির মানুষের কাছে সুপরিচিত ছিলেন, তেমনি তাঁর উম্মাতের সকল মানুষের কাছে সুপরিচিতি লাভ করাও সমাজকর্মীর জন্য একান্ত কাম্য।     

সামাজিক কাজ প্রতিপালনের পর সমাজকর্মী উপর্যুক্ত বাক্য পাঠ ও অনুধাবন করে ঘুমিয়ে যাবে। রাতের ঘুম পূর্ণ হলে সকালে জেগে আমাদের শিক্ষক ও আদর্শ বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম যে বাক্যটি উচ্চারণ করতেন, সমাজকর্মীও মহানবীর শেখানো কথাগুচ্ছ বলার চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু তাঁর জানা আছে কি, তিনি রাসূলের (সা.) শেখানো কথামালার মাধ্যমে কী উচ্চারণ করলেন? ঘুম হতে জেগে উঠে যা রাসূল (সা.) বলতেন, আমরা সকলে সে কথাই বলি। তিনি বলতেন, অর্থাৎ সমস্ত গুণগান আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে মৃত (ঘুম) হতে জীবিত করেছেন এবং তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। (আল-আদাব লিল বাইহাকীকী, পৃ. ২৮০) আমি জেগে উঠেছি বা জীবিত হয়েছি বলে আবার রাত আসার পূর্বে মালাকুল মাওতের (মৃত্যুর ফেরেশতা) সাথে সাক্ষাৎ হবে না বা দিনের মধ্যে আমরা মারা যাব না-এ কথা কেউ নিশ্চিত হয়ে যেতে পারি না। তাই একজন মুসলিম সমাজকর্মী এ কথা স্মরণে রাখলে সকাল হতে ঘুমানোর পূর্ব পর্যন্ত যতগুলো কাজ করবে, সে দিনের তার হিসাব ঐ দিনের মধ্যেই দেওয়ার মনমানসিকতা ও প্রস্তুতি নিয়েই কাজ করবে; এটাই হবে রাসূলের তরিকার একজন মুসলিম সামাজিক কর্মীর কাজ করার মূল প্রেরণা।   

শুধু আল্লাহর কাছে চাওয়া : সামাজিক কাজে সমাজকর্মী সর্বদা সফল হবে তা নয়। তিনি সব সময় ইখলাছের (একাগ্রতা) সাথে এবং সফল হওয়ার উদ্দেশ্যে কাজ করবেন। তিনি কাজ করবেন, তবে সফল হবেন কি না তা তাঁর উপর নির্ভর করবে না, তিনি সৎ উদ্দেশ্যে ও নৈতিকতার সাথে সামাজিক কাজে মনোনিবেশ করলেই হবে। কারণ, সমাজকর্মী নিজের জন্য কাজ করছেন না। তিনি যা করছেন তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য। সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ প্রাপ্ত হওয়ার মানসে সকল কাজ পরিচালনা করবেন। যেভাবে আল্লাহর শেখানো এ কালামে দেখা যায়- “হে আমাদের রব! ইহকাল তথা দুনিয়াতে কল্যাণ দান করুন এবং আখিরাতেও। আর জাহান্নামের শাস্তি হতে আমাদের বাঁচান।” (আল বাকারা-২০১)

এখানে মুসলিম বান্দা দুনিয়া ও আখিরাতে সমান গুরুত্ব দিয়ে চাওয়ার জন্য আল্লাহ শিখিয়েছেন। কিন্তু মানবকুলের স্্রষ্টা কিছু কিছু মানুষের ইচ্ছা বোঝেন, তাই তাদের বিষয়ে তিনি বলেছেন- “মানবমণ্ডলীর মধ্যে কেউ কেউ বলে, হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়া দান করো। তাদের জন্য আখিরাতে কোনো অংশ নেই।” (আল বাকারা-২০০)

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সমাজকর্মীদের মধ্যে অধিকাংশের চিন্তা ও ধ্যান থাকে দুনিয়ার সফলতা। কিন্তু আখিরাতের সফলতা যে মূল, সে সম্পর্কে তারা সঠিক ধারণা রাখে না বা তাদের সে বিষয়ে সঠিক ধারণা তৈরি হয়নি। তাই মহান আল্লাহ এ সম্পর্কে আরও বলেন- “বরং তারা পৃথিবীর জীবনকে প্রাধান্য দান করে, কিন্তু পারলৌকিক জীবনই উত্তম এবং চিরস্থায়ী।” (সূরাতুল আ‘লা : ১৬-১৭) 

সুতরাং আল্লাহর কাছে মূল সফলতার আশায় পৃথিবীর জীবনের সকল কাজ বাস্তবায়ন করাই হবে একজন মুসলিম সমাজকর্মীর উদ্দেশ্য।

আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দেওয়া : মানবগোষ্ঠীর সবাই আল্লাহর প্রতিনিধি। যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি এ কথাটির সাথে একমত পোষণ করেন। তাই যারা সমাজের কাজে নিয়োজিত থাকবেন, তারা নিজেদেরকে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মন-মননে বিশ্বাস রাখবেন। কেননা, আল্লাহ বলেন- “আর তিনি এমন, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ার প্রতিনিধি করেছেন এবং তোমাদের একের উপরে অপরকে মর্যাদা বেশি দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হলো, তিনি তোমাদের যা দান করেছেন তার মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করা। (হে নবী!) নিশ্চয় তোমার রব দ্রুত শাস্তিদাতা এবং নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল এবং রহিম।”

সমাজকর্মী যদি আল্লাহর প্রতিনিধি হতে না পারে, তবে সে প্রতিনিধি হবে আল্লাহ বিরোধী অন্য কারও তথা শয়তানের। সুতরাং একজন সামাজিক কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তি সমাজের সকল কর্মে, শয়নে-স্বপনে, ধ্যান ও জ্ঞানে এ (আল্লাহ প্রতিনিধি) চিন্তা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাবে না। 

সমাজকে প্রস্তুত করা : মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় অমুসলিম-মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এ বিষয়ে প্রস্তুত করতে হবে যে, তিনি আল্লাহর বিধান ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের নির্দেশিত পথের বাইরে কোনো কাজ করবেন না। সামাজিক কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিকে সমাজের সকল মানুষ না হলেও অধিকাংশ মানুষ মনে করবেন যে, আমাদের এ আল্লাহর প্রতিনিধি (সমাজকর্মী) কোনো অবিচার বা অনৈতিক কাজ করবেন না। তাহলে সে সমাজে খুব দ্রুত এ সমাজকর্মীর প্রভাব সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হবে ইনফরমেশন বা তথ্য বিচার করার যোগ্যতা। সমাজকর্মীর কাছে সমাজের পজেটিভ এবং নেগেটিভ বিষয়াদি সম্পর্কে বহু তথ্য আসবে। তিনি যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে নির্ভুল উপায়ে সমাধান করার প্রচেষ্টা চালাবেন। এ বিষয়ে তিনি আল্লাহর এ আয়াতের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ বলেছেন, “হে মুমিনগণ! যদি ফাসিক (পাপাচারী) তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে- যাতে অজ্ঞতার বশে তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি সাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হও।” (আল হুজরাত-৬) 

আজকের পৃথিবীতে এ কাজটি খুবই সহজ এবং গুরুত্বপূর্ণ। তাই সামাজিক কাজে নিয়োজিত প্রত্যয়ী মানুষকে আল্লাহর শেখানো বাণী কাজে লাগিয়ে সমাজ পরিচালনার যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে সামাজিক আন্দোলন অবশ্যই বেগবান হবে। 

মুসলিম নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন : মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে সামাজিক পরিবর্তন আনতে হলে পদ্ধতি ঠিক করে তা অনুসরণ করতে হবে। সামাজিক আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে বিশেষ কতিপয় গুণের অধিকারী হতে হবে। যেমন : আল্লাহ বলেন- “(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে উপলক্ষ্য করে আল্লাহ বলেন), আল্লাহর অনুগ্রহ (তোমার প্রতি) এই যে, তুমি তাদের (সাহাবীদের) প্রতি কোমল চিত্তের এবং তুমি যদি (তাদের প্রতি) কর্কশভাষী কঠোর হৃদয়ের হতে, তাহলে তোমার পক্ষ তাঁরা অবশ্যই ত্যাগ করত। অতএব, তুমি তাঁদেরকে ক্ষমা করো এবং তাঁদের জন্য ক্ষমা প্রার্থণা করো এবং কাজ সম্পর্কে তাঁদের সাথে পরামর্শ করো। যখন তুমি দৃঢ় সংকল্প করো (কর্মের/কাজের বিষয়ে),তখন আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভর করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর উপর নির্ভরকারী বান্দাদের ভালোবাসেন।”

আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন- “হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন, যাদের দেখলে আমাদের নয়ন জুড়ে যায় এবং আমাদেরকে মুত্তাকিদের জন্য আদর্শস্বরূপ করুন।”

উপরের আয়াত এবং রাসূল সা.-এর সমাজ পরিচালনার দিক নির্দেশনা হতে শিক্ষা নিয়ে সামাজিক কাজে নিয়োজিত কর্মী বা নেতৃবৃন্দকে নিম্নোক্ত গুণাবলির আলোকে সমাজ পরিচালিত করতে হবে। যথা : ক) সাধারণ মানুষদের ক্ষমা করতে শেখা। খ) আল্লাহর নিকট মুত্তাকি বা আল্লাহভিরু জনগোষ্ঠীর নেতৃত্ব চাওয়া। গ) সমাজের সকলের জন্য দোয়া করা।   

সামাজিক মানুষদেরকে সমাজ পরিবর্তনের জন্য আহ্বান : যারা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, এ ঘুণে ধরা সমাজকে পরিবর্তন করতে হবে, তাদেরকে সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে বোঝাতে হবে যে, সকল মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধি এবং সকলকে একদিন আল্লাহর কাছে তাদের কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। সেখানে সামাজিক কাজে নিয়োজিত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তাঁর কাজের জন্য যেমন আল্লাহর কাছে জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নেবেন, তেমনি সমাজের একজন সাধারণ মানুষও তার কর্মের জন্য জবাব দেবে। এ সম্পর্কে হাদীসে এসেছে-

“আব্দুল্লাহ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা সকলেই রাখাল, তোমরা সকলেই পরিচালনার দায়ে দায়ী বা জিজ্ঞাসিত হবে। আমির তথা সমাজের যিনি পরিচালক, তিনি সমাজের মানুষের বিষয়ে (আল্লাহর কাছে) জবাবদিহি করবেন। (পরিবারের) প্রধান ব্যক্তি তার পরিবারের রাখাল (পরিচালক), সে তার পরিবার সম্পর্কে (আল্লাহর কাছে) জিজ্ঞাসিত হবে। (পরিবারের) মহিলা তার স্বামী এবং সন্তানদের রাখাল, সে তাদের  বিষয়ে (আল্লাহর কাছে) জিজ্ঞাসিত হবে। কৃতদাস তার মনিবের মালের দেখাশোনা করার রাখাল, তাকে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসা হতে হবে। সাবধান! সাবধান! তোমরা সকলেই রাখাল, সুতরাং তোমরা সকলেই (নিজ নিজ কর্মের জন্য) জিজ্ঞাসিত হবে।” (বুখারী, হা. নং-২৫৫৪, তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ১৫০, আস-সুলতানিয়্যাহ, ১৩১১ হি/১৮৯৩ খ্রি.) 

সুতরাং সমাজের সকল মানুষকে রাসূলের (সা.) এ হাদিসের আলোকে প্রস্তুতি নিয়ে সামাজিক পরিবর্তনের আহ্বান জানাতে হবে। তাহলে সামাজিক পরিবর্তন ঘটবে। আর সমাজ পরিবর্তন হলে সেটা স্থিতিশীল হওয়ার বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করা যাবে।

সামাজিক কাজের মৌলিক মাধ্যম হবে শিক্ষা : সামাজিক সকল কাজের মধ্যে শিক্ষাকে একটি সামাজিক পরিবর্তনের মৌলিক মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সমাজে শত সহস্র কাজ করলেও মানুষের মনঃজগতের সঠিক পরিবর্তন সূচিত হতে পারে শিক্ষার মাধ্যমে। মানব সমাজ সুস্থ ও দেশ গঠনের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া শুধু সামাজিক উন্নয়ন বা সমাজের বাহ্যিক কাঠামোর পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজকে স্থিতিশীল করতে বা রাখতে পারে না। যদিও-বা কখনো সে সমাজ বিনির্মাণ করা যায়, তাহলে তা স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। ইতিহাসে নানা সময়ে নানা অঞ্চলে এর প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়। সমাজে মৌলিক শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরির মাধমে সমাজের মানুষকে প্রস্তুত করতে পারলে; সামাজিক কাজের মাধ্যমে সূচিত সামাজিক পরিবর্তন ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। একটি বাড়ির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ কীভাবে পরিবর্তন হয় তা উদাহরণ হিসেবে এখানে তুলে ধরা হলো :

আমাদের সমাজের একটি বাড়িতে বাবা-মায়ের দুটি ছেলে রয়েছে। বাবা-মা পরামর্শ করে, দুই ছেলের এক ছেলেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পদ্ধতি মেনে শিক্ষা দিলেন এবং অন্য ছেলেকে প্রচলিত শিক্ষা তথা ব্রিটিশ শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষিত করার প্রচেষ্টা শেষ করলেন। আমরা এ দুই ছেলের মন ও বাহ্যিক অবস্থান এক রকমের আশা করলেও তা পাওয়া সম্ভব হবে? পাঠক মহলে এ বিষয়ে প্রশ্ন রেখে বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আহ্বান করলাম। ঠিক তেমনিভাবে সামাজিক কাজ ও আন্দোলন করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ না করলে সামাজিক কাজ ও আন্দোলন কর্ম বৃদ্ধি করবে; কাক্সিক্ষত ফল লাভ করা সম্ভব হবে না।

সামাজিক কাজে বাধা, ঝগড়া সৃষ্টি : সৃষ্টির সূচনা লঘ্ন হতে সমাজে সত্য-মিথ্যা, হক-বাতিল, নৈতিক-অনৈতিক, আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্ব চলমান। সামাজিক কাজ করতে গেলে এ বাধা আসবে। কখনো একক আবার কখনো সম্মিলিতভাবে। তাই সেক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ আদর্শ পুরুষ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সা.) নীতি ও পথ অনুসরণ এবং পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের পথ অনুসরণ করাই হবে সঠিক ও বুদ্ধিদৃপ্ত কাজ। আলোচনা বোধগম্য হওয়ার জন্য এখানে শুধু আমাদের শেষ নবীর অভিজ্ঞতা পরিবেশন করা হয়েছে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম মক্কায় শুধু এক রকমের বৈরী পরিবেশে কাজ করলেও মদীনায় বৈরী পরিবেশ ছিল নানামুখী। অন্যদিকে মদীনায় তিনি শুধু ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ গঠনের নয়; সেখানে তিনি রাষ্ট্র বিনির্মাণের কাজও করতে থাকেন। কিন্তু মদীনায় রাষ্ট্র গঠনের কাজ শুরু করলে বহিঃশত্রু, অভ্যন্তরীণ ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিক, মুনাফিক নানাবিধ বিরোধী গোষ্ঠীর দ্বারা তাঁর কাজে বাধাপ্রাপ্ত হতে থাকেন। তিনি যেহেতু আল্লাহর মনোনীত ব্যক্তি ছিলেন, তাই তিনি সকল বিষয়ে মহান আল্লাহর দ্বারা সরাসরি পরিচালিত হতেন। আজকের সময়ে কোনো ব্যক্তি ও সংগঠন যদি এ মহান দায়িত্ব নিয়ে সামাজিক কাজ শুরু করেন, আশা করা যায় যে আল্লাহ তাদেরকে তাঁর অদৃশ্য শক্তির মাধ্যমে সাহায্য প্রদান করবেন। মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহর (সা.) মক্কা ও মদীনার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবস্থান সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূলের ওপর যেসব আয়াত নাজিল করেছেন (ওহীয়ে মাতলু ও গায়েরে মাতলু) তা তুলে ধরলে এবং সে অনুসারে সমাজে প্রয়োগের প্রচেষ্টা চালালে সে সকল বাধা দূর হবে এবং সেই সমাজ আবারো প্রতিষ্ঠিত হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। অমুসলিমরা মুহাম্মাদ (সা.)সহ সকল নবীর সাথে তর্ক বা ঝগড়া করতে এলে কীভাবে তাদের কথার জবাব দিতে হবে, সে বিষয়ে আল্লাহ তালায়া যে সকল নির্দেশনা প্রদান করেছেন, তা সামাজিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের জানতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত কতিপয় আয়াত তুলে ধরা হলো : “নবী হে! তুমি তোমার রবের পথের দিকে আহ্বান করো হিকমাহ ও উত্তম নসিহার মাধ্যমে। তাদের সাথে তর্ক (আলোচনা) করো সুন্দরভাবে। নিশ্চয় তোমার রব ভালো করেই জানেন কে তাঁর পথ ছেড়ে বিপথগামী এবং কে সৎ পথে আছে।” আন-নাহল : ১২৫

“এবং যারা নিজ জীবনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তুমি তাদের পক্ষে বিতর্ক করো না। নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বাসঘাতক পাপীকে ভালোবাসেন না।” আন-নিসা-১০৭

“সাবধান! তোমরাই ঐ লোক, যারা ওদের পক্ষ হতে পার্থিব জীবন সম্বন্ধে বিতর্ক করছ। কিন্তু কিয়ামত দিবসে তাদের পক্ষ হতে কে আল্লাহর সাথে বিতর্ক করবে এবং কে তাদের উকিল হবে?” আন-নিসা-১০৯   

“তারা নিজেরা তো তা থেকে বিরত থাকে, অধিকন্তু অন্য লোকদেরকেও তারা বিরত রাখতে চায়। তারা নিজেদেরকেই ধ্বংস করছে, অথচ তা তারা অনুভব করতে পারে না। তাদের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে- যারা তোমার কথা মনোযোগ সহকারে শোনে, অথচ গ্রহণ করে না। তোমার কথা তারা যাতে ভালোভাবে বুঝতে না পাওে, সেজন্য তাদের অন্তরের ওপর আবরণ রেখে দিয়েছি এবং তাদের কানে বধিরতা স্থাপন করেছি। তারা যদি সমস্ত নিদর্শনও দেখে, তবুও তারা ঈমান আনবে না। এমনকি যখন তারা তোমার কাছে আসে, তখন তারা তোমার সাথে অর্থহীন বির্ক শুরু করে। আর তাদের কাফির (অবিশ্বাসী) লোকেরা (সব কথা শোনার পর) বলে, এটা প্রাচীনকালের লোকদের কিচ্ছা-কাহিনি ছাড়া আর কিছু নয়।” আনআম-২৫ 

“হে নবী! তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করো না, যারা আল্লাহর নিদর্শন সম্পর্কে বিতর্ক করে? কীভাবে তাদেরকে বিপথগামী করা হচ্ছে?” আল-মুমিন/গাফির-৬৯  

“আর আমার নিদর্শন সম্পর্কে যারা বিতর্ক করে তারা যেন জানতে পারে যে, তাদের কোনো নিষ্কৃতি নেই। বস্তুত তোমাদেরকে যা কিছু দেওয়া হয়েছে তা পার্থিব জীবনের ভোগ। কিন্তু আল্লাহর কাছে যা আছে তা উত্তম ও স্থায়ী। এটা তাদের জন্য, যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের রবের ওপর নির্ভর করে।” আশ্-শুরা-৩৫-৩৬

ওপরের আয়াতগুলোর অর্থ ও তাফসির পাঠ করে অনুমিত হয় যে, সামাজিক কাজে যারা আত্মনিয়োগ করবেন, তাঁরা সমাজের সাধারণ ও তর্কপ্রিয় মানুষদের সাথে তর্কে না জড়িয়ে নিবিষ্ট মনে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের মুক্তির জন্য সামাজিক কাজ করে যাবেন। 

সামাজিক আন্দোলন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার : বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক কাজ ও আন্দোলন করতে হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে নিয়ামক হিসেবে গ্রহণ করে সামাজিক কাজ ও আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। কেননা, সমগ্র পৃথিবীতে যেকোনো আহ্বান এত দ্রুত, খুব সহজে এবং অল্প সময়ে ছড়িয়ে দেওয়া এ যোগাযোগ মাধ্যমেই সম্ভব। রাসূল (সা.) বিদায় হজ্জের ভাষণে তাঁর আদর্শ প্রচারকে উৎসাহিত করার জন্য বলেছেন, 

“আমার নিকট হতে একটি আয়াত হলেও প্রচার করো।” (আল-জামেয়’ আল-মুসনাদ আস-সহীহ, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৩৩) একটি আয়াত বা বাণী হলেও রাসূল (সা.) প্রচার করতে বলেছেন। তাই সামাজিক মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যান্য আত্মিক গুণাবলি প্রচারের পাশাপাশি সামাজিক কাজ ও আন্দোলন শুরু করলে আল্লাহর এ ধরায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রিয় সমাজ বা খিলাফতের প্রতিষ্ঠা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তা ছাড়া সামাজিক আন্দোলনকারীরা মুমিন হলে এবং ন্যায়নিষ্ঠার সাথে কাজ করলে তাদের প্রচার, প্রসার এবং বিজয় সুনিশ্চিত। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,

“তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে এবং সৎ কাজ করে, আল্লাহ তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যে, তিনি তাঁদেরকে অবশ্যই প্রতিনিধিত্ব দান করবেন, যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাঁদের পূর্ববর্তীদেরকে। তিনি অবশ্যই তাঁদের জন্য দ্বীনকে সুদৃঢ় করবেন, যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদাত করবে, আমার সাথে কোনো শরিক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারা তো ফাসিক বা সত্যত্যাগী। (সুরাতুন-নুর : ৫৫)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় দেখা যায় যে, রাসূলের (সা.) উম্মাতের (মুসলিম জাতির) মধ্যে কিয়ামাত পর্যন্ত একটি দল সদা সত্যের ওপর থাকবে এবং সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কাজ করবে। কিয়ামাত দিবস পর্যন্ত তাঁদের বিরোধীরা তাঁদের কোনোই ক্ষতি করতে পারবে না। আবার বলা হয়েছে যে, এই দলটিই দাজ্জালের সাথে যুদ্ধ করবে। অন্যত্র বলা হয়েছে যে ঈসা (আ.) অবতরণ পর্যন্ত এই লোকগুলোই কাফির শক্তির ওপর জয়যুক্ত হবে।

তাই বলা যায় যে, ইসলামী জীবনের যতগুলো দিক ও বিভাগ রয়েছে তন্মদ্ধে ব্যক্তি, পরিবারের পরেই সমাজের অবস্থান। ইসলামি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের দেখানো আদর্শের অনুকরণ ও অনুসরণ করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রথমে নিজেকে ইসলামের জন্য উপযোগী করে তৈরি করতে হবে। ব্যক্তি যখন পরিপূর্ণভাবে গঠিত হয়ে যাবে, তখন ব্যক্তির মাধ্যমে পরিবার ইসলামের আলোকে গঠিত হবে। কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে পরিবার সংগঠিত হলে সমাজের মধ্যে তার প্রভাব পরিস্ফুটিত হবে। এভাবে যারা সামাজিক কাজের মাধ্যমে আন্দোলন সৃষ্টি করতে চায়, তাদের সামাজিক কাজ হবে ন্যায়নিষ্ঠার সাথে; আল্লাহ যাকে আমলে সালেহ বলেছেন। আমলে সালেহের মাধ্যমে সামাজিক কাজ শুরু করলে দুর্বার সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠবে। সামাজিক ভালো কর্ম এবং আল্লাহর সাহায্য নিয়ে সামাজিক আন্দোলন সৃষ্টি হলে আল্লাহর এ ধরায় তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। ইনশাঅল্লাহ। আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে (আল্লাহর) সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে রয়েছেন।”

লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির