
যখনই অক্টোবর মাস কাছাকাছি এসে যায়, তখনই আমি ভয়াবহ আতঙ্কে অস্থির হয়ে উঠি। টেলিভিশনের লাইভ অনুষ্ঠানে সেদিন যা দেখেছিলাম, সে দৃশ্য দেখে আমার মনে হয়েছিল, আমাদের আড়াই হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস তৎকালীন আওয়ামী লীগ মুছে দিয়ে আমাদেরকে পাঁচ হাজার বছর পেছনে নিয়ে গিয়েছিল। আমি ব্যথিত হয়েছিলাম। নিজেকে বাকল পরিহিত বর্ষাধারী এক মানুষ মনে হয়েছিল। আমি কলম পেশার মানুষ। অর্ধনগ্ন বাকল পরিহিত মানুষ হিসেবে আমি নিজেকে কল্পনাও করতে পারি না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সেদিন ঢাকা শহরে সমবেত হয়েছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক মনুষ্য নামের অযোগ্য একদল ঘাতক শ্রেণী। শেখ হাসিনা তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারা যেন লগি-বৈঠা নিয়ে ঢাকা এসে পাঁচ হাজার বছর আগের সমাজে কী হয়েছিল সেটা এদেশের জনগণকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এবং তিনি তার মহানায়িকা হিসেবে সদম্ভে তা প্রশান্তচিত্তে অবলোকন করেছেন। তিনি সাহারা খাতুনের মতো অবিবাহিত কিংবা নিঃসন্তান নন। তিনি বিবাহিত ছিলেন। তার দাম্পত্য জীবন ছিল। এবং তার আদরের দু’টি সন্তান রয়েছে। এমনকি আদিম সমাজেও সন্তানের প্রতি পশুর মতো মানুষেরও অপরিসীম মমতা ও ভালোবাসা ছিল। নিজের সন্তানের বেড়ে ওঠা, সুরক্ষা, এর প্রতি মানুষের অন্তহীন নিবিড় স্নেহ মমতার প্রকাশ সে সমাজেও ছিল, বর্তমান সমাজেও আছে। ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর জোট সরকার রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের ক্ষমতা হস্তান্তর করে। পরদিন ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। তাতে এত মানুষের সমাগম হয়েছিল যে, মনে হয়েছিল, শেখ হাসিনার বর্বর, কুৎসিত আন্দোলনেও তিনি ভীত হয়ে পড়েননি। ২৮ অক্টোবর ২০০৬-এ ঢাকায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত এক শোডাউনের আয়োজন করে। তখন আওয়ামী লীগ অবস্থান নেয় তাদের অফিসকেন্দ্রিক বিবি এভিনিউতে। জামায়াত অবস্থান নেয় পুরানা পল্টন এলাকায়। বিএনপি অবস্থান নেয় নয়াপল্টনে তাদের অফিসকে কেন্দ্র করে। জামায়াতের অবস্থান কর্মসূচিতে দৈনিক বাংলা মোড় থেকে পুরানা পল্টন মোড় পর্যন্ত হাজার হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন। নেতারা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তারা চুপচাপ শুনছিলেন। বিএনপির কর্মসূচিতে ফকিরাপুল মোড় থেকে নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আমি তখন আর ফিল্ডে উপস্থিত থেকে রিপোর্ট লেখার কাজ করি না। ফলে ঘরে বসে টিভি চ্যানেলে সেদিনের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। টিভি চ্যানেলের ক্ষেত্রে যা হয়, আমরা সবসময় একটা চ্যানেল থেকে দ্রুত আর একটা চ্যানেলে ট্রান্সফার করি। কোনো একটা টিভি চ্যানেলে থেমে হঠাৎ চমকে গেলাম। কী জানি করছে। প্রায় সব চ্যানেলেই লাইভ দেখাচ্ছে। এই চ্যানেলে আটকে গেলাম, কারণ, দেখলাম, বিবি এভিনিউ থেকে কতগুলো লোক লগি-বৈঠা নিয়ে পুরানা পল্টনের দিকে ছুটে আসছে। কেন, কী প্রয়োজন সেটি আমার কাছে অবোধ্য ছিল। প্রত্যেকের হাতে লম্বা লাঠি অথবা এক্কেবারে নতুন তৈরি বৈঠা। একেবারে আদিমতম হাতিয়ার। টিভি ক্যামেরা স্থির ধরে আছে। প্রায় শ’ খানেক রক্তপিপাসু হায়েনা পল্টন মোড়ের দিকে এগিয়ে গেল। গিয়েই তারা একটি ছেলের ওপর পাঁচ হাজার বছর আগের বর্বর যুগের মতো লগি-বৈঠা নিয়ে অবিরাম আঘাত শুরু করলো। ছেলেটি মুহূর্তেই রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল। টিভি ক্যামেরা অন, লাইভ। আমি আতঙ্কে শিহরিত হয়ে পড়ছিলাম, এ কী? এবং কেন? আওয়ামী ঘাতকদের এই ছেলেটা কী ক্ষতি করেছে? মনে হচ্ছিল, আজ যদি সে আমার সন্তান হতো, তাহলে আমার ঘরে বসে কেমন লাগতো? শেখ হাসিনাও সেদিন নিশ্চয়ই টেলিভিশনের পর্দায় এ দৃশ্য দেখছিলেন। কিংবা যদি বাইরেও থেকে থাকেন, (থাকতেও পারেন) নিশ্চয়ই অতীব আনন্দে তার হাসি দীর্ঘতম হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী খুনিরা অকারণে এই ছেলেটাকে লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ধরাশায়ী করে ফেলেছিল। ছেলেটি উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলো এবং দাঁড়িয়েও পড়লো। হয়তো সে তখনও চিকিৎসা সাহায্য পেলে বেঁচে যেতে পারতো। কিন্তু দাঁড়ানো মাত্রই শেখ হাসিনার নির্দেশ পালনকারী পশুরা তাকে পুনরায় লগি-বৈঠা দিয়ে পেটাতে শুরু করলো এবং এরই একপর্যায়ে সে ধরাশায়ী হয়ে গেল। যখন সে ধরাশায়ী হলো, তখন শেখ হাসিনার আদৃত ড্রাকুলারা তার গায়ের উপর উঠে লাফাতে শুরু করলো। সে তখনও মৃত কি জীবিত জানি না। টেলিভিশন লাইভ চলছিল। টিভি ক্যামেরাম্যান ক্যামেরার হাল ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে চোখ ঢেকে হু হু করে কাঁদছিলেন। রিপোর্টার যখন কথা বলছিলেন, তখনও তার কণ্ঠস্বর ছিল অশ্রুভেজা। তিনি ক্যামেরা আর ধরতে পারছিলেন না। আমার শুধু মনে হতে লাগলো, এই নিরীহ তরুণটি যদি আমার সন্তান হতো, তাহলে কী হতো? এমনকি এই ছেলেটি যদি শেখ হাসিনার ছেলে জয় হতো, তাহলে তার প্রতিক্রিয়া কী হতো? কিন্তু দেখা গেল, এ ঘটনায় সামান্য আহত হননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ঘটনার জন্য জামায়াত-শিবিরকেই দায়ী করে পরদিন বিবৃতি দিয়ে বসলেন। সে কাহিনী বারবার লিখেছি। সেই বিবৃতিও ছিল নিষ্ঠুর, অমানবিক, পৈশাচিক। সেই ঘটনার পর কোনো মা এমন বিবৃতি দিতে পারেন, এ ছিল আমার কল্পনারও অতীত। তিনি বলেছিলেন, শিবিরের কর্মীরা আওয়ামী লীগ কর্মীদের উপর গুলি চালিয়েছিল। সে কারণেই আওয়ামী লীগ কর্মীরা ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে। দোষের কিছু হয়নি। অর্থাৎ নরহত্যা শেখ হাসিনার কাছে অতি তুচ্ছ ঘটনাই বটে। আমি নিশ্চিত যে, এই ছেলেটির মা-বাবাও সেদিন টেলিভিশনে বসে এই লাইভ ঘটনাটি দেখেছিলেন। আমার সন্তান যদি এইভাবে খুন হতো, তাহলে আমার কী প্রতিক্রিয়া হতো, আমি জানি। শেখ হাসিনার তা হতো না। কিন্তু এভাবে পিটিয়ে কেউ যদি রাজপথে তার সন্তানকে হত্যা করতো এবং তিনি যদি টেলিভিশনে তা দেখতেন, তাহলে তার কি মর্মবেদনা হতো? কিংবা আদৌ হতো কিনা সেটা আমার পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব। সেদিন এভাবেই শেখ হাসিনার নির্দেশে আওয়ামী হায়েনারা আটজনকে লাশ করেছিল। তারপর চড়াই-উতরাই অনেক গেছে। শেখ হাসিনা রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। ধারাটা প্রায় একই। হিংস্র ড্রাকুলার মতো রক্তপিপাসা। অবিরাম নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে আওয়ামী লীগাররা। আদালত তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। শেখ হাসিনার পরামর্শে রাষ্ট্রপতি আওয়ামী ড্রাকুলাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। সেটা করে তিনিও কি এক কলঙ্কিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হননি? তা নিয়ে কারো কোনো পরোয়া নেই। প্রতিদিন গড়পরতা ১২/১৪ জন খুন হচ্ছে। হাসিনা সমর্থকেরা নিজ দলের লোকদের খুন করছে, তিনি খুনিকে বুকে তুলে নিচ্ছেন। এ হলো বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি। ফেরাউনের আমল থেকে এ পর্যন্ত এমন পরিস্থিতির শিকার কম জনই হয়েছেন। বাংলাদেশে আমরা তেমন পরিস্থিতির শিকার। আওয়ামী লীগাররা খুন করবে। কোনো সমস্যা নাই। খুনের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তির সনদপত্র, এ এক চমৎকার অভিযাত্রা। কিন্তু মহান আল্লাহ তায়ালা এইসব জালেমকে কঠোর শাস্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, ন্যায় বিচারই শাশ্বত এবং ন্যায় বিচারেরই জয় হবে। সুতরাং শেখ হাসিনার ইতি অবশ্যম্ভাবী। লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট
আপনার মন্তব্য লিখুন