স্মৃতির মিনারে জ্বেলে যাও জ্যোতি জোছনা
মিছবাহুল আলম রাসেল
১২ ডিসেম্বর ২০১৭
প্রতিদিন সোনালি সূর্য ফিরে
ফিরে সোনালি জোছনা শুধু
ওরা ফিরে না শুধু ওরা ফিরে না
চলে গেছে ওপারে সুন্দরে ভুবনে
- চৌধুরী গোলাম মাওলা
শহীদ শাফায়েত উল্ল্যাহ। আজো প্রতিদিন আমার স্বপ্নে এক চেতনার সেনানী। কেন যেন মন থেকে একটুও আড়াল করতে পারি না তাঁকে। বেদনায় বুক ভারী হয়ে ওঠে বোবা কান্নায়। প্রিয়জনকে আসলে কি কখনো ভুলে থাকা যায়? না, যায় না। তাই তো স্মৃতির মিনারে প্রতিদিন জ্বেলে যাও জ্যোতি জোছনা। আমিও উন্মুখ হয়ে থাকি সেই প্রিয় মুখাবয়বের দিকে। ছেলেবেলার সেই দুরন্তপনার অ্যালবাম বার বার ভেসে ওঠে স্মৃতি সাগরের ঢেউয়ে। দলবেঁধে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ভৌঁদোড়ে এক সাথে স্কুলে যাওয়া, ক্লাস শেষে খেলাধুলা। আনন্দ উল্লাসে এপাড়া ওপাড়া ছুটে বেড়ানোর সেইসব মুহূর্ত আজো মনে পড়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয় পাঠান্তে শহীদ শাফায়াত ভর্তি হলেন বড়দারোগারহাট দাখিল মাদরাসায়। আর আমি ভর্তি হই সীতাকুন্ড কামিল মাদরাসায়। শৈশবকাল থেকেই শাফায়াত সবার কাছে প্রিয় ছিলেন। মানবতাবাদী এক তরুণের নাম শহীদ শাফায়াত। তবে নীতির ক্ষেত্রে আপসহীন, সংগ্রামী। যেখানে সামাজিক বৈষম্য, অন্যায় অথবা জুলুম দেখতো সেখানেই তিনি শির উদ্বেলিত করতেন। তার সাহসী চরিত্র ঘুণেধরা এই সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখবেন এই প্রত্যাশা ছিল আমাদের সবার। দ্বীনি আন্দোলনের দায়িত্বশীলদের প্রাথমিক পছন্দে আসেন এবং খুবই দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাত্রসমাজের প্রিয় সংগঠন শহীদি কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে ২০০৫ সালে সাথী শপথ গ্রহণ করেন। নেতৃত্ব ও গুণাবলিসম্পন্ন এই ছাত্রনেতা অতিদ্রুত সকলের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব এবং বিচক্ষণতায় বড়দারোগারহাট উপশাখায় দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। ইসলামী আন্দোলনের আহবানকে ছাত্রসমাজের কাছে পৌঁছানোর অঙ্গীকার নিয়ে দিন রাত ছুটে বেড়াতেন। কর্মচঞ্চলতা ও কর্মমুখরতায় তিনি বাতিলের চক্ষুশূল হয়ে উঠল। শহীদ শাফায়াতকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে ইসলামবিদ্বেষী শক্তি। তারা শহীদ শাফায়াতকে তাদের পথের কাঁটা মনে করতো। কারণ তারা বুঝেতে পেরেছিল শহীদ শাফায়াতের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সেখানকার মাটি ও মানুষের হৃদয়কে জয় করে ফেলেছে।
দৃঢ় মনোবলসম্পন্ন সদালাপী ও সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন শহীদ শাফায়েত উল্ল্যাহ। মানুষকে সহজে আপন করে নেয়ার অস্বাভাবিক যোগ্যতা ছিল তাঁর। দ্বীনের দাওয়াতি কার্যক্রমে তরুণ ছাত্রসমাজের মাঝে নিজেকে একজন দায়ী হিসেবে উপস্থাপন করতো প্রতিনিয়ত।
“তার কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান করে, সৎ কাজ করে আর ঘোষণা দেয় আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।” (সূরা হা-মিম সাজদাহ আয়াত নং ৩৩)
শুধু ছাত্রসমাজ নয়, সাধারণ মানুষকে সংঘবদ্ধ করার গুণাবলিতে ছিলেন তিনি অতুলনীয়। সংগ্রামে, সঙ্কটে, প্রতিবাদে সবসময়ই সামনের সারিতে আনাগোনা ছিল। মিছিলে স্লোগানে উচ্চকিত সাবলীল ভরাট কণ্ঠস্বর। নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিয়ে পুরো মিছিলটি যেন মাতিয়ে রাখতেন একাই। এক অনাবিল চরিত্রের বজ্রকণ্ঠে বদলে যেত রাজপথের দৃশ্যপট। সীতাকুন্ডের রাজপথ অবাক বিস্ময়ে তাকাতো শাফায়েত উল্ল্যাহর দিকে। তাঁর সেই হাস্যোজ্জ্বল মুখটি আজও আমাদের স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে যায়। সুন্দর সুবিশাল হৃদয়ের অধিকারী মানুষটিকে যেন আল্লাহ তায়ালা সকল গুণে গুণাম্বিত করে শহীদি কাফেলার দায়ী হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর সুললিত কণ্ঠের সেই স্লোগানের সাক্ষী আজ নিজেই। “হয় বাতিলের উৎখাত করে সত্য প্রতিষ্ঠা করবো,
নচেৎ সেই চেষ্টার সংগ্রামে আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে।”
আমরা শহীদ শাফায়েত উল্ল্যাহ ভাইকে সেই স্লোগানে, সেই মিছিলে আজো খুঁজি।
রক্তে গড়া সংগঠন, রক্ত দিয়ে রাখবো
যত যাবে রক্ত, শিবির হবে শক্ত।
রক্তের বন্যায়, ভেসে যাবে অন্যায়।
কে তুলবে রাজপথ কাঁপিয়ে দ্বীপ্ত আওয়াজ! তিনি তো খোদার রাহে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে মহান রবের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বল না। এরাতো আসলে জীবিত, কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমরা বুঝতে পার না।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত নং ১৫৪)
শহীদ শাফায়েত উল্ল্যাহ শাহাদাতের তিন দিন আগে আমার সাথে লুকোচুরি খেলেছিলেন। রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। বাড়ির আঙিনায় গাছগাছালির আড়াল থেকে আমাকে ডাকেন। একবার নয় কয়েক বার ডেকে বলেন, কেমন আছেন ভাই? সেই ডাকটি ছিল শহীদ শাফায়েত উল্ল্যাহ ভাইয়ের শেষ ডাক। ভাবিনি কখনো আমাকে আর ডাকবে না। শাহাদাতের রাতে “ঈদুল আজহার তৃতীয় দিন” তাঁর আম্মা তাকে খেতে দিলেন। কিছু খাওয়ার পর ফোন এলো আমাদের শহীদুল ইসলাম ভাইকে আওয়ামী যুবলীগের হায়েনারা বেঁধে রেখে নির্যাতন করছে। তিনি খাবার শেষ না করেই হাত ধুয়ে মাকে বললেন, “আম্মা! দোয়া করবেন আমি শহীদুল ইসলাম ভাইকে হায়েনাদের কবল হতে উদ্ধার করতে যাচ্ছি।” আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গকারী এক সাহসী দিলে অফুরন্ত ভালোবাসা আরেক ভাইয়ের জন্য। তাই এক দুর্বিনীত সাহস এবং আল্লাহর প্রতি রাখা ঈমানী প্রত্যয়। বুক ভরা ভালোবাসা আর দ্বীনের জিম্মাদারি। নিজের জীবনের কথা না ভেবে ছুটে চললেন দ্বীনের সাথীকে রক্ষা করার জন্য। কয়েকজন কর্মী ভাইকে নিয়ে নুনাছড়া বাজারে “নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার” স্লোগান দিয়ে বাতিলের মোকাবেলায় ছুটে যান সবার আগে। কে জানত এই যাত্রা ছিল আর না ফেরার যাত্রা।
চিহ্নিত সন্ত্রাসী চক্রের পূর্ব-পরিকল্পিত নির্মম আঘাতে আহত হওয়ার পর তার সাথীরা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেই রাতে মহান রবের ডাকে চলে যান জান্নাতের পথে। হঠাৎ রাতে ফোন করলো তার প্রিয় দায়িত্বশীল জামসেদ ভাই। অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন- “আমাদের শাফায়েত উল্ল্যাহ ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন, তার পরিবারকে জানান।” আমার সাহস হলো না তার মায়ের সামনে দাঁড়াতে, কী জবাব দেবো তাঁর আম্মাকে? তিনি ছিলেন মায়ের একমাত্র পুত্র। আজও আমরা তাঁর মাকে জবাব দিতে পারিনি। কী ছিল তার ছেলের অপরাধ? কেন তাকে নির্মম আঘাতে হত্যা করা হলো? কেন আজ খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়? ফিরে কি আসবে না তার প্রিয় খোকাটি? সে কি দূর থেকে আর মা মা বলে ডাকবে না? আজও প্রিয় শহীদের মায়ের প্রশ্নগুলো নিভৃতে উচ্চারিত হয় আমাদের শ্রুতিতে।
১৭ জানুয়ারি ২০০৬ সাল। শহীদের প্রথম জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম লালদিঘীর মাঠে। দ্বিতীয় জানাজা হয় সীতাকুন্ড সরকারি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। তৃতীয় জানাজা হয় টেরিয়াল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। চতুর্থ জানাজা হয় নিজ বাড়ির আঙিনায়। হাজার হাজার শোকাহত সাথী প্রিয় ভাইটিকে এক নজর দেখার জন্য ছুটে আসে। রক্তমাখা সাদা কফিন অঝোর ধারার অশ্রুতে ভিজিয়ে দিল সবাই। শহীদের কফিন ঘেঁষে ঘিরে থাকা কাউকে সরানো যাচ্ছিল না। সবাই চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে, “আমরাও যাবো তার সাথে”। তখন কে থামাবে সাথীদের এ কান্নার রোল। কে দেবে তাদের সান্ত্বনা। সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে পাড়ি দিলেন জান্নাতের দিকে শহীদ শাফায়েত উল্ল্যাহ। অহর্নিশ বলছি, হে আমার রব শহীদ শাফায়েত উল্ল্যাহ ভাইয়ের সাথে আমাদেরকে জান্নাতে জায়গা করে দিও। আমিন।
আপনার মন্তব্য লিখুন