٩ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ(৯) ١ فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ(১০)
সরল অনুবাদ
৯) হে লোকসকল, যারা ঈমান এনেছো, জুমার দিন যখন নামাজের জন্য তোমাদের ডাকা হয় তখন আল্লাহর জিকিরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও। এটাই তোমাদের জন্য বেশি ভালো যদি তোমরা অনুধাবন করতে।
১০) তারপর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে। (সূরা জুমআ : ৯-১০)
সূরা ও আয়াত সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত বিবরণ
সূরার নাম : জুমআ, পারা নম্বর : ২৮, কুরআনুল কারিমে সূরাটির অবস্থান : ৬২, সূরায় মোট রুকু সংখ্যা : ২, আমাদের আলোচ্য আয়াতগুলো যে রুকুতে : ২য়, সূরায় মোট আয়াত সংখ্যা : ১১, আলোচ্য আয়াত নম্বর : ৯-১০, অবতীর্ণের সময় : হিজরতের পরে (মাদানি), পূর্ববর্তী সূরা : সূরা সফ (৬১ নম্বর), পরবর্তী সূরা : সূরা মুনাফিকুন (৬৩ নম্বর)
নামকরণ
কুরআনুল কারিমের সূরাসমূহের নামকরণের একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। এটা এখনকার প্রবন্ধ-নিবন্ধের শিরোনামের মতো নয়। সাধারণত প্রবন্ধে-নিবন্ধে আলোচ্য বিষয়কে শিরোনাম করা হয়। কুরআন মাজিদে তা করা হয়নি। গবেষকদের মতে, কুরআন মাজিদের সূরা নামকরণ হয়েছে তৎকালীন আরবি রীতি অনুসারে। ঐ সময় আরবে কাব্য ও কাসিদার ব্যাপক চর্চা ছিল, কাসিদার নামকরণ হতো কাসিদার বিশেষ কোনো শব্দ-শব্দবন্ধ দ্বারা, যে শব্দটি শোনামাত্র গোটা কাসিদা মনে পড়ে যায়।
সারকথা কুরআন মাজিদের সূরার নামকরণ হয়েছে ঐ সূরার বিশেষ কোনো অংশ দ্বারা, যে অংশটি উচ্চারণ করামাত্র সূরাটি স্মৃতিতে উপস্থিত হয়ে যায়। যেমন ধরুন, ‘সূরাতুল মায়িদাহ’। এই নামকরণের অর্থ এই নয় যে, গোটা সূরায় মায়িদাহ বা দস্তরখান সম্পর্কে আলোচনা হবে; বরং অর্থ হচ্ছে, এটি ঐ সূরা, যাতে মায়িদাহ সংক্রান্ত বিখ্যাত ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। হতে পারে সেটি সূরার ক্ষুদ্র একটি অংশ, কিন্তু এর দ্বারা সূরাটিকে চিনে নেওয়া যায়। তেমনি, সূরা আলে ইমরান। এই নামকরণের অর্থ এই নয় যে, গোটা সূরায় ইমরান পরিবার সম্পর্কে আলোচনা হবে; বরং অর্থ হচ্ছে, এই সূরায় ইমরান-পরিবারের ঘটনা আছে। তেমনি সূরাতুল বাকারা নামে নামকরণের অর্থ এই নয় যে, গোটা সূরায় বাকারা সংক্রান্ত বিধি-বিধান বর্ণিত হবে; বরং অর্থ হচ্ছে, এটি ঐ সূরা, যাতে বাকারা সংক্রান্ত ঘটনাটি আছে। ঠিক তেমনি সূরায়ে লুকমান অর্থ, এটি সেই সূরা, যাতে লুকমান হাকিমের কিছু উপদেশ বর্ণিত হয়েছে।
কুরআন মাজিদের ১১৪টি সূরার মধ্যে প্রত্যেকটির জন্য একটি নাম নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই নামকরণের ব্যাপারে কয়েকটি বিশেষ নীতি অনুসরণ করা হয়েছে:
- কিছু নাম আছে কুরআন ও হাদিস ভিত্তিক।
- কিছু নাম রয়েছে আলেমদের ইজতিহাদ প্রসূত।
- কোনো কোনো সূরার নাম রাখা হয়েছে এর প্রথম শব্দ দ্বারা।
- কোনো সূরায় আলোচিত বিশেষ কোনো কথা কিংবা তাতে উল্লিখিত বিশেষ কোনো শব্দ নিয়ে তা-ই নাম হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
- কোনো কোনো সূরার নামকরণ করা হয়েছে তার অভ্যন্তরীণ ভাবধারা ও বিষয়বস্তুকে সম্মুখে রেখে।
- কয়েকটি সূরার নাম রাখা হয়েছে কোনো একটি বিশেষ ঘটনার প্রতি খেয়াল রেখে। (বুখারি : আধুনিক-৪৬২২, ৪৬২৩, ৪৬২৬; ইফা-৪৬২৭, ৪৬২৮, ৪৬৩১)
আলোচ্য সূরা জুমআর নামকরণ
সূরা জুমআর নামকরণ শব্দভিত্তিক। ৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ জুমার দিন করণীয় সম্পর্কে বলেছেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ
“হে ঐ সব লোক, যারা ঈমান এনেছো, জুমার দিন যখন নামাজের জন্য তোমাদের ডাকা হয় তখন আল্লাহর জিকিরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও।”
এ আয়াতাংশ থেকে নাম গ্রহণ করা হয়েছে। এ সূরার মধ্যে যদিও জুমার নামাজের আহকাম বা বিধি-বিধানও বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু জুমআ সামগ্রিকভাবে এর বিষয়বস্তুর শিরোনাম নয়। বরং অন্যান্য সূরার নামের মতো এটিও এ সূরার প্রতীকী বা পরিচয়মূলক নাম।
নাজিলের সময়কাল
প্রথম রুকুর আয়াতসমূহ ৭ হিজরিতে সম্ভবত খায়বার বিজয়ের সময় অথবা তার নিকটবর্তী সময়ে নাজিল হয়েছে। বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ এবং ইবনে জারির হযরত আবু হুরাইরা বর্ণিত একটি হাদিস উদ্ধৃত করেছেন যে, আমরা নবী সা.-এর খেদমতে বসে থাকা অবস্থায় এ আয়াতটি নাজিল হয়। হযরত আবু হুরাইরা সম্পর্কে এ বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, তিনি হুদায়বিয়ার সন্ধির পরে এবং খায়বার বিজয়ের পূর্বে ঈমান এনেছিলেন।
দ্বিতীয় রুকুর আয়াতগুলো হিজরতের পরে অল্পদিনের মধ্যে নাজিল হয়েছিল। কেননা নবী সা. মদিনা পৌঁছার পর পঞ্চম দিনেই জুমার নামাজ কায়েম করেছিলেন। এই রুকুর শেষ আয়াতটিতে যে ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, আয়াতটি জুমার নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা হওয়ার পর এমন এক সময়ে নাজিল হয়ে থাকবে যখন মানুষ দ্বীনি উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত সমাবেশের আদব-কায়দা ও নিয়ম-কানুন সম্পর্কে তখনও পুরো প্রশিক্ষণ লাভ করেনি।
প্রথম রুকুর বিষয়বস্তু
১. বিশ^নবী সা.-এর পরিচয়।
২. নবীকে হেয়প্রতিপন্ন করার জবাব।
৩. মহান আল্লাহ তার জ্ঞান দ্বারা উপমা প্রদানের অনন্যতা।
৪. ইহুদিদের সর্বশেষ পরাজয় সংক্রান্ত আলোচনা।
দ্বিতীয় রুকুর বিষয়বস্তু
১. জুমার নামাজ সংক্রান্ত।
২. উপার্জনের নির্দেশনা।
৩. উপার্জন নিয়ে ইহুদিদের ধ্যান-ধারণার অবসান।
আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা
৯ নম্বর আয়াত
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ۚ ذَٰلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ
“হে ঐ সব লোক, যারা ঈমান এনেছো, জুমার দিন যখন নামাজের জন্য তোমাদের ডাকা হয় তখন আল্লাহর জিকিরের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ছেড়ে দাও। এটাই তোমাদের জন্য বেশি ভালো যদি তোমাদের জ্ঞান থাকে।”
এ আয়াতে তিনটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতো। প্রথমটি হলো, এতে নামাজের জন্য ঘোষণা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
দ্বিতীয়টি হলো, এমন একটি নামাজের জন্য ঘোষণা দেওয়ার কথা আছে যা বিশেষভাবে শুধু জুমার দিনেই পড়তে হবে।
তৃতীয়টি হলো এই দু’টি জিনিসের কথা এভাবে বলা হয়নি যে, তোমরা নামাজের জন্য ঘোষণা করো এবং জুমার দিনে একটি বিশেষ নামাজ পড়।
জুমা নামাজ ফরজ হওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও হযরত আবু মাসউদ আনসারির বর্ণনা থেকে জানা যায়, হিজরাতের কিছুকাল পূর্বে পবিত্র মক্কাতেই নবী সা.-এর ওপর জুমার ফরজ হওয়ার বিধান নাজিল হয়। কিন্তু সে সময় তিনি এ নির্দেশের ওপর আমল করতে পারতেন না। কারণ মক্কায় সামষ্টিক কোনো ইবাদাত করা সম্ভব ছিল না। তাই যেসব লোক নবী সা.-এর আগে মদিনায় হিজরত করেছিলেন তিনি তাদের নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন যে, তারা যেন সেখানে জুমার নামাজ কায়েম করে। অতএব প্রথম দিকে হিজরাতকারীদের নেতা হযরত মুস’আব ইবনে উমায়ের ১২ জন লোক নিয়ে মদিনায় সর্বপ্রথম জুমার নামাজ আদায় করেন।
(তাবারানি, দারু কুতনি)।
হযরত কাব ইবনে মালেক এবং ইবনে সিরিনের বর্ণনা মতে এরও পূর্বে আনসারগণ আপনা থেকেই (রাসূলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশ পৌঁছার পূর্বে) সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তারা সবাই মিলে সপ্তাহে একদিন সামষ্টিকভাবে ইবাদাত করবেন। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা ইহুদিদের সাবত এবং খ্রিস্টানদের রোববার বাদ দিয়ে জুমার দিনকে মনোনীত করেছিলেন এবং বনি বায়দা এলাকায় হযরত আসআদ ইবনে যুরারা প্রথম জুমার নামাজ পড়েছিলেন। এতে ৪০ ব্যক্তি শরিক হয়েছিল (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে মাজা, ইবনে হিব্বান)।
এ থেকে জানা যায় ইসলামী জনতার আবেগ অনুভূতি তখন এমন একটি দিন থাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছিল যেদিন অধিক সংখ্যক মুসলমান একত্র হয়ে সামষ্টিকভাবে ইবাদাত করবে। তা শনিবার ও রোববার থেকে আলাদা কোনো দিন হওয়াটিও ইসলামী রুচি ও মেজাজ-প্রকৃতিরই দাবি ছিল। যাতে মুসলমানদের জাতীয় প্রতীক ইহুদি ও খ্রিস্টানদের জাতীয় প্রতীক থেকে আলাদা থাকে। এটা সাহাবা কিরামের ইসলামী মানসিকতার একটি বিস্ময়কর কীর্তি। অনেক সময় নির্দেশ আসার পূর্বে তাদের এই রুচি ও মেজাজ-প্রকৃতিই বলে দিতো যে, ইসলামের মেজাজ ও প্রকৃতি অমুক জিনিসের দাবি করছে।
হিজরত করার পর রাসূলুল্লাহ সা. সর্বপ্রথম যে কাজগুলো করেন জুমার নামাজ কায়েম করা তার অন্যতম। পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হিজরত করে সোমবার দিন তিনি কুবায় উপনীত হন, চারদিন সেখানে অবস্থান করেন এবং পঞ্চম দিন জুমার দিনে সেখান থেকে মদিনার দিকে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে বনি সালেম ইবনে আওফের এলাকায় জুমার নামাজের সময় হয়। সেখানেই তিনি প্রথম জুমার নামাজ পড়েন। (ইবনে হিশাম)।
জুমার খুতবাহ জরুরি
মুফাসসিরগণও সর্বসম্মতভাবে এ শব্দটিকে গুরুত্ব আরোপ করা অর্থে গ্রহণ করেছেন তাদের মতে سعى অর্থ হলো, আজান শোনার পর মানুষ অবিলম্বে মসজিদে পৌঁছার চিন্তা করতে থাকবে। ব্যাপারটা শুধু এতটুকু নয়, বরং নামাজের জন্য দৌড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে হাদিসে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: নামাজ শুরু হলে ধীরে সুস্থে ও স্থিরচিত্তে গাম্ভীর্যের সাথে নামাজে শরিক হওয়ার জন্য অগ্রসর হও, দৌড়িয়ে শরিক হয়ো না। এভাবে অগ্রসর হয়ে যতটা নামাজ পাবে তাতে শরিক হবে এবং যতটা ছুটে যাবে তা পরে পূরণ করে নেবে। (সিহাহ সিত্তাহ) হযরত আবু কাদাতা আনসারি রা. বলেন: একবার আমরা নবী সা.-এর সাথে নামাজ পড়ছিলাম। হঠাৎ আমরা লোকজনের দৌড়াদৌড়ি করে চলার শব্দ শুনতে পেলাম। নামাজ শেষ করে নবী সা. ঐ লোকগুলোকে জিজ্ঞেস করলেন, এসব কিসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম? তারা বলল: নামাজে শরিক হওয়ার জন্য আমরা দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে আসছিলাম। তিনি বললেন, এরূপ করবে না। যখনই নামাজে আসবে শান্তভাবে ও স্থিরচিত্তে আসবে। এভাবে ইমামের সাথে যতটা নামাজ পাওয়া যাবে পড়বে। আর যে অংশ ছুটে যাবে তা পরে পড়ে নেবে। (বুখারি, মুসলিম)।
কেনা-বেচা বন্ধ রাখার জরুরিয়াত
‘কেনা-বেচা পরিত্যাগ করো’ কথাটার অর্থ শুধু কেনা-বেচাই পরিত্যাগ করা নয়, বরং নামাজের জন্য যাওয়ার চিন্তার ব্যবস্থা ছাড়া অন্য আর সব ব্যস্ততা পরিত্যাগ করা। বিশেষভাবে বেচা-কেনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে শুধু এজন্য যে, জুমার দিন ব্যবসায় বাণিজ্য খুব জমে উঠতো। এই দিন আশপাশের জনপদের লোকজন একস্থানে সমবেত হতো। ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্যদ্রব্য নিয়ে সেখানে পৌঁছত। লোকজনও তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা কেবল কেনা-বেচা পর্যন্তই সীমিত নয়, অন্যান্য সব ব্যস্ততাও এর অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু আল্লাহ তায়ালা পরিষ্কাভাবে ঐসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তাই ফিকহবিদগণ এ ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, জুমার আজানের পর কেনা-বেচা এবং অন্য সবরকমের কাজ কারবার হারাম।
১০ নম্বর আয়াত,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِنْ فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“তারপর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।”
জুমার পর ভূপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়া বা রিজিকের অনুসন্ধানে তৎপর হয়ে ওঠা দ্বারা এ কাজ করার অনুমতি বুঝায়। যেহেতু জুমার আজান শোনার পর সব কাজকর্ম পরিত্যাগ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তাই বলা হয়েছে, নামাজ শেষ হওয়ার পর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার এবং যে কাজ-কর্ম করতে চাও তা করার অনুমতি তোমাদের জন্য আছে।
আল্লাহর অনুগ্রহের অন্যতম বিষয় হলো হালাল রুজি। একজন মুসলিমকে হালাল উপার্জনের বিষয়ে সবসময় তৎপর হতে হয়। হালাল উপার্জন নিয়ে বেশ কিছু বিষয় আছে, যা অত্যন্ত জরুরি।
হালাল উপার্জন একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান
ইসলাম মানুষের জন্য হালাল ও হারামের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিরূপণ করেই শেষ করেনি, বরং হালাল উপার্জনে রয়েছে এর সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ফরজ ইবাদতসমূহ আদায়ের পর এ মহৎ কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে। উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও বৈধ উপায় অবলম্বন করা ব্যবসায়ীসহ সকল মানুষের উপর ইসলামের একটি অলঙ্ঘনীয় বিধান। যারা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না তাদের ব্যাপারে নবী করিম সা. সতর্কবাণী করেছেন। তিনি বলেন-
يَأْتي على النّاسِ زَمانٌ، لا يُبالِي المَرْءُ ما أخَذَ منه، أمِنَ الحَلالِ أمْ مِنَ الحَرامِ.
“মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোনো উৎস থেকে সম্পদ আহরণ করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করবে না।” (বুখারি ; তাওহিদ-২০৫৯)
হালাল উপার্জন দোয়া কবুলের পূর্বশর্ত
عن أبي هريرة:] أَيُّها النّاسُ، إنَّ اللَّهَ طَيِّبٌ لا يَقْبَلُ إلَّا طَيِّبًا، وإنَّ اللَّهَ أمَرَ المُؤْمِنِينَ بما أمَرَ به المُرْسَلِينَ، فقالَ: } يا أيُّها الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّباتِ واعْمَلُوا صالِحًا، إنِّي بما تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ{[المؤمنون:٥١] وقالَ: } يا أيُّها الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِن طَيِّباتِ ما رَزَقْناكُمْ{[البقرة:١٧٢]، ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أشْعَثَ أغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إلى السَّماءِ، يا رَبِّ، يا رَبِّ، ومَطْعَمُهُ حَرامٌ، ومَشْرَبُهُ حَرامٌ، ومَلْبَسُهُ حَرامٌ، وغُذِيَ بالحَرامِ، فأنّى يُسْتَجابُ لذلكَ؟
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র। তিনি শুধু পবিত্র বস্তুই গ্রহণ করেন। তিনি মুমিনদের সেই আদেশই দিয়েছেন, যে আদেশ তিনি দিয়েছিলেন রাসূলগণকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বস্তুসামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুজি হিসেবে দান করেছি। অতঃপর রাসূল সা. এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলি-ধূসরিত ক্লান্ত-শ্রান্ত বদনে আকাশের দিকে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে প্রার্থনা করে ডাকছে: হে আমার প্রভু! হে আমার প্রভু! অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারা সে পুষ্টি অর্জন করে। তার প্রার্থনা কিভাবে কবুল হবে?”
(মুসলিম : তাওহিদ-১০১৫)
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে-
تلَيْتُ هذه الآيةَ عند رسولِ اللهِ صلّى اللَّهُ عليه وسلَّم}يا أَيُّها النّاسُ كُلُوا مِمّا فِي الْأَرْضِ حَلالًا طَيِّبًا} فقام سعدُ بنُ أبي وقّاصٍ فقال يا رسولَ اللهِ ادعُ اللهَ أن يجعَلَني مستجابَ الدَّعوةِ فقال رسولُ اللهِ صلّى اللَّهُ عليه وسلَّم يا سعدُ أطِبْ مَطْعمَك تكنْ مستجابَ الدَّعوةِ
“রাসূল সা.-এর নিকট একদা এ আয়াতটি তিলাওয়াত করা হলো। হে মানবম-লী! পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তুসামগ্রী ভক্ষণ কর। তখন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রা. দাঁড়িয়ে বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যেন আমার দোয়া কবুল হয়। রাসূল সা. বললেন: হে সা‘দ, তোমার পানাহারকে হালাল কর, তবেই তোমার দোয়া কবুল হবে।
(তাবারানি, মুজামুল আওসাত, খ--৬, পৃষ্ঠা-৩১০)
অবৈধ উপায়ে সম্পদ উপার্জনকারীর জন্য জাহান্নাম অবধারিত
ইবনে আব্বাস রা. বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা. বলেছেন-
كلُّ جَسَدٍ نبتَ مِنْ سُحْتٍ فالنارُ أولى بِهِ
“আর যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে ওঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম।” (তাবরানি)
কাব ইবনে উজরাহ রা. রাসূলে কারীম সা. থেকে বর্ণনা করেন-
্রلَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ جَسَدٌ غُذِّيَ بِحَرَامٍ
“যে শরীর হারাম পেয়ে হৃষ্ট পুষ্ট হয়েছে, তা জান্নাতে যাবে না।”
(মুসনাদ আবি ইয়ালা, খ--১, পৃষ্ঠা-৮৪)
দুনিয়ার জীবনের কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য পুরস্কার ও শাস্তি উভয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। যারা তাঁর অনুগত বান্দা তারাই পুরস্কারপ্রাপ্ত হবে। যেহেতু অবৈধ উপায়ে উপার্জনকারী ব্যক্তি তার অবাধ্য ও দুশমন তাই তাদের জন্যও শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। অতএব এ পন্থা অবলম্বনকারী ব্যক্তি জাহান্নামি।
দারসের শিক্ষা
১. মহান আল্লাহর নির্দেশ পাওয়া মাত্র তাঁর ডাকে নির্দ্বিধায় সাড়া দিতে হবে।
২. এই নির্দেশ পাওয়া মাত্র দুনিয়ার সকল কাজ বন্ধ করতে হবে।
৩. উপার্জন করার কাজটিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ এবং সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
৪. উপার্জন হালাল হওয়া জরুরি।
তথ্য সংগ্রহ
১. তাফসির:
- তাফহীমুল কুরআন, সাইয়েদ আবুল আ’লা মুওদূদী (রহ.)।
- তাফসির ফি যিলালিল কুরআন, সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহ.)।
- তাফসির ইবনে কাসির, হাফেজ আল্লামা ইমামুদ্দিন ইবনু কাসির (রহ)।
২. অনুবাদ:
- শব্দার্থে আল কুরআনুল মাজিদ, মতিউর রহমান খান।
- সহজ বাংলায় আল কুরআনের অনুবাদ, অধ্যাপক গোলাম আযম।
- কুরআনুল কারিম, প্রফেসর ড. মুজীবুর রহমান।
৩. হাদিসগ্রন্থ:
- বুখারি : আধুনিক প্রকাশনী, তাওহিদ প্রকাশনী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন।
৪. দারসুল কুরআন সঙ্কলন, এ. কে. এম. নাজির আহমদ।
৫. ওয়েবসাইট সহযোগিতা:
- http://www.tafheembangla.com/
-
https://www.tafheem.net/
-
http://www.quranmazid.com/
-
http://ihadis.com/
-
https://www.hadithbd.com/
-
https://www.pathagar.com/
লেখক : গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ
আপনার মন্তব্য লিখুন