post

ইসলামী অর্থনীতি ও দারিদ্র্য বিমোচন

১১ জুলাই ২০১১

শিল্পী শাহীন আলম

Islam is the complete code of life. ইসলাম মানবজাতির জন্য পরিপূর্ণ একটি জীবনবিধান। মানবজাতির এমন কোন দিক বা পথ নেই যেখানে ইসলাম সুস্পষ্ট সমাধান দেয়নি। তেমনি দারিদ্র্য বিমোচনেও ইসলাম সুন্দরতম দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। শুধু পরকালীন শান্তি নয়, ইহকালীন জীবনেও সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন পরিচালনার কথা বলে ইসলাম। ইসলাম যেমন নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতের কথা বলে তেমনি অর্থনীতির কথাও বলে। সুদের ভয়াবহ পাপ ও ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানবসমাজকে রক্ষা করার জন্য ইসলামী অর্থনীতির প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীতে যতগুলো অর্থব্যবস্থা রচিত হয়েছে নীতিগতভাবে সেগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা, দ্বিতীয়ত, কমিউনিজম অর্থব্যবস্থা, তৃতীয়ত, ইসলামী অর্থব্যবস্থা। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তিই হবে নিজের উপার্জিত ধন-সম্পদের মালিক, তার উপার্জিত সম্পদে কারো কোনো অংশ থাকবে না, তার ওপর অন্য কারো অধিকারও স্বীকৃত হবে না। তার উপার্জিত সম্পদ সে যেভাবেই ইচ্ছা ব্যয়-ব্যবহার করতে পারবে; যে পরিমাণ ধন-সম্পদ ও উৎপাদন উপায় তার হাতে রয়েছে তা সে কুক্ষিগত করে রাখতে এবং নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়া অন্য কোনো কাজে তা ব্যয় করতে অস্বীকার করতে পারবে। আর কমিউনিজম অর্থব্যবস্থা পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত। কমিউনিজম অর্থব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হচ্ছে ধন-সম্পদের যাবতীয় উপায় উপাদান সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তিবর্গের সম্মিলিত মালিকানা ব্যক্তির ব্যক্তিগতভাবে তা দখল করা, নিজের ইচ্ছামত হস্তক্ষেপ করা এবং তাতে ব্যক্তিগতভাবে তার মুনাফা গ্রহণ করার কোনো অধিকার নেই। আর ব্যক্তিগণ সমাজের মিলিত স্বার্থের জন্য যে কোনো কাজ করবে, তারা তার পারিশ্রমিক পাবে মাত্র। তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের ব্যবস্থা সমাজের তরফ থেকে দেয়া হবে। আর ব্যক্তিগণ তার বিনিময়ে সমাজের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবে। অপরদিকে ইসলামী অর্থব্যবস্থা হচ্ছে প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তার ব্যক্তিগত ও স্বাভাবিক অধিকার পুরোপুরিই দিতে হবে। সেই সাথে ধন-সম্পদের বণ্টনের ক্ষেত্রেও ভারসাম্যও যথাযথভাবে তা রক্ষা করতে হবে। ইসলাম একদিকে ব্যক্তিকে ব্যক্তিগত মালিকানা অধিকার ও নিজের ধন-সম্পদে হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়, অপর দিকে এসব অধিকার ইখতিয়ারের ওপর অভ্যন্তরীণ দিক থেকে কতগুলো নৈতিক বিধি-নিষেধ আরোপ করে এবং বাহ্যিক দিক থেকে কতগুলো আইনের শাসন কায়েম করে। এর ফলে কোন এক স্থানেও ধন-সম্পদ ও উপায় উপাদান জমাট বাঁধতে ও স্থবির হয়ে থাকতে পারে না। এ জন্য ইসলাম গোটা অর্থব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ নতুন ধরনে ও নবতর পদ্ধতিতে গড়ে তুলেছে। তাই ইসলামী অর্থব্যবস্থার ভাবধারা, রীতিনীতি ও কর্মপদ্ধতির দিক দিয়ে পুঁজিবাদী ও কমিউনিজম এ উভয় অর্থব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বতন্ত্র। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় ইসলাম অনুসারীদেরকে অর্থ-সম্পদ উপার্জনের জন্য অবাধ উন্মুক্ত সুযোগ করে দেয়নি, বরং উপার্জনের উপায় ও পন্থার মধ্যে জাতীয় ও সামগ্রিক স্বার্থের দৃষ্টিতে জায়েজ-নাজায়েজ, বৈধ-অবৈধের পার্থক্য সূচিত হয়েছে। অর্থ উপার্জনের যেসব পন্থা ও উপায়ে এক ব্যক্তির লাভ অপর ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের ক্ষতি হয় তা সবই নাজায়েজ ঘোষণা করা হয়েছে। আর মুনাফা ও কল্যাণভোগীদের ওপর যেন ইনসাফপূর্ণ বণ্টন হয় তা সবই বৈধ ও সঙ্গত। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, ‘‘হে ঈমানদার লোকগণ! তোমরা পরস্পরে একে অপরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। সব ধরনের লেনদেন হবে পারস্পরিক সন্তোষ ও মর্জি অনুসারে। এবং তোমরা নিজেরা নিজেদেরকে হত্যা করো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতি অনুগ্রহশীল। যে কেউ স্বীয় কর্মসীমা লঙ্ঘন করে জুলুমসহকারে এরূপ কাজ করে তাকে আমি জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। (সূরা আন নিসা : ২৯-৩০) ইসলামী অর্থব্যবস্থা দারিদ্র্য বিমোচনে মাইলফলক ভূমিকা রেখেছে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় প্রচলিত ছিল বলে সে যুগে জাকাত নেয়ার মত কোন ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর, সম্পদশালীরা জাকাতের অর্থ নিয়ে ঘুরাফেরা করতেন কিন্তু জাকাতের অর্থ গ্রহণ করার মতো দরিদ্র কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। সর্বত্র ছিল সোহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ, একে অপরের সহযোগী। দারিদ্র্য বিমোচন, সম্পদের মালিকানা ও শ্রমিকের অধিকার সংক্রান্ত যুগোপযোগী নীতিমালা বিশ্বনবী প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। কৃষি, শিল্প, আন্তর্জাতিক ব্যবসা বাণিজ্য, রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয় ইত্যাদি সংক্রান্ত ইসলামের অর্থনৈতিক নীতিমালাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করেছেন। ইসলামী অর্থনীতি সম্পদে ব্যক্তি মালিকানার পাশাপাশি ব্যক্তির সম্পদের ওপর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইসলামী অর্থনীতি মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে তার নজির দুনিয়ার অন্য কোন অর্থব্যবস্থা বা অর্থনীতিতে নেই। ইসলামী অর্থনীতির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা তোমাদের আদল ও ইহসান করতে ও নিকট আত্মীয়দের অধিকার আদায়ের আদেশ দিচ্ছেন, এবং অশ্লীলতা, দুর্নীতি ও সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করেছেন।’ (সূরা নহল : ৯০) দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র যদি জাকাতভিত্তিক গড়ে ওঠে তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে দরিদ্রতা থাকতে পারে না। এ জন্য পবিত্র কুরআনে ৮০ বার জাকাতের কথা বলা হয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, হযরত মোহাম্মদ (সা) বলেছেন- ‘তোমাদের এক সঙ্গে আদেশ করা হয়েছে নামাজ কায়েম করা ও জাকাত প্রদান করার জন্য।’ আমাদের সমাজে আজ যারা দারিদ্র্যের ছায়ায় বসবাস করছে তারা অধিকাংশ মূলত দক্ষ, কিন্তু তাদের মূল অভাব হচ্ছে পুঁজি বা সম্পদের। বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য পুঁজি বা সম্পদের বিকল্প ডিজিটাল একটি পন্থা অবলম্বন করা হলে তাহলে দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য অনেকটা মাইলস্টোন ভূমিকা পালন করবে। যেমন উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যোগ্য লোকদের কর্মদক্ষতা, যোগ্যতা আর জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সম্পদশালীদের সম্পদ সুষ্ঠু ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ সৃষ্টি করা। তাহলে একদিকে যেমন যোগ্য লোকদের কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়, আরেক দিকে সম্পদশালীদের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার দারিদ্র্য বিমোচনে অনেকটা সহায়ক হবে। আর এর জন্য শর্ত হচ্ছে উভয় পক্ষের বিশ্বাস। ইসলামে জাকাত দেয়ার পাশাপাশি ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রতি সমভাবে অপব্যয় না করার জন্য বাধ্য করা হয়েছে। ইসলামী অর্থব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, দরিদ্র ও অভাবীদের প্রতি সুবিচার ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ মানবজাতিকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে জীবিকা নির্বাহ করার জন্য অনেক উপায় সঙ্গে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত সে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যে জাতি নিজেই তার ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট না হয়।’’ দারিদ্র্য যে একটি কঠিন অভিশাপ তা সর্বজনবিদিত। কোনো মানুষই চায় না দরিদ্র হয়ে দুনিয়ায় বাঁচতে। অপরিসীম দারিদ্র্যে নিমজ্জিত একজন মানুষ যতই নিম্নমানের পেশাই করুক না কেন তার এ পেশা দিয়েই অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে, দরিদ্রতার অবসান হোক, সর্বোপরি সামান্য হলেও জীবনমান উন্নত হোক। এ জন্য আমরা লক্ষ্য করি ইসলাম দরিদ্রতার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নিয়েছে এবং দরিদ্রতাকে মানবজাতির জন্য একটি কঠিন মসিবত বলে উল্লেখ করেছে। এ জন্য ভিক্ষাবৃত্তি ইসলামে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একজন দারিদ্র্যপীড়িত মানুষ ইচ্ছা করলেই পরিশ্রম আর কর্মদক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাত থেকে মুক্তি পেতে পারে। এ জন্য ইসলামে অলস লোকদের স্থান নেই, দরিদ্র ভেবে যদি বসে থাকে তাহলে তার দরিদ্রতা কখনো লাঘব হবে না বরং দরিদ্রতা দিন দিন আরও বাড়বে। এ জন্য বিশ্বনবী সবসময় আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, আমি দরিদ্র্য, অভাব ও লাঞ্ছনা থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই।’ (বুখারী) ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হলে রাষ্ট্রে দারিদ্র্য সীমার নিচে যারা বসবাস করে সবাই আর্থিক সচ্ছলতা ফিরে পাবে। মূলত রাষ্ট্রে ইসলামী অর্থব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই পারে দারিদ্যমুক্ত সমাজ ও ডিজিটাল দেশ গড়তে। রাসূল (সা) দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রেখে একটি স্বর্ণালি সমাজ তথা রাষ্ট্র বিশ্ববাসীকে উপহার দিয়েছেন, তা আজও বিশ্ববাসীর কাছে চিরস্মরণীয় ও আদর্শ হয়ে বেঁচে থাকবে।

লেখক : শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কুমিল্লা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির