post

কারাগারের দিনগুলো কারাস্মৃতি

১০ জুলাই ২০১১

মুহাম্মদ আতাউর রহমান সরকার

গত সংখ্যার পর

সেলের গেট ১ ঘণ্টার জন্য খুলে রাখার সময়টাকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। পাঠাগার থেকে বই সংগ্রহ, ২৬ সেলে ঘুরতে আসা কয়েদি-হাজতিদের মাঝে নামাজের দাওয়াতি কাজ এবং নিজেদের মাঝে ব্যক্তিগত পর্যায়ের যোগাযোগের কাজটি শেষ করব। সবাই মিলে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম ট্যাংকের শরবত এবং ফল-ফলাদি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০-১৫ জনের মাঝে বিতরণ করব। সিদ্ধান্তের আলোকে কাজ শুরু হলো। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া ফলাফল আসল প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। কারাগারের পাঠাগারে রয়েছে অনেক আদর্শিক বই, রয়েছে তাফসির। পুরাতন কয়েদিদের কাছে জানতে পারলাম জরুরি অবস্থার সময় জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে থাকাবস্থায় মসজিদ সংস্কার, সমৃদ্ধ পাঠাগার হয়েছে। মসজিদ সংস্কারে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর অবদান বেশি। ২৪ ঘণ্টা আটক থাকাবস্থায় আমাদের রুমের গেটের সামনে ক্যারাম বোর্ড খেলাসহ আড্ডাবাজদের আড্ডা চলত প্রতিনিয়ত। যার কারণে আমাদের কষ্ট হতো। তাদের জ্বালায় ছিলাম অতিষ্ঠ। কিন্তু কিছুই করার নেই। ইতোমধ্যে আমরা কারাগারে পরিচিত মুখ। ৩০ মে থেকে শুরু করে ২৫ জুন পর্যন্ত কারাগারে গ্রেফতার হয়ে আসে আমাদের শতাধিক ভাই। ২০-২৫ দিন কাজ করার কারণে পুরাতন হাজতি হিসেবে সবার সাথে আমরা ছিলাম পরিচিত। এখন সমস্যা নেই বেশি একটা। এমতাবস্থায় একদিন সুবেদারের সাথে সাক্ষাৎ করে ক্যারাম বোর্ড খেলার স্থান পরিবর্তনের জন্য তাকে অনুরোধ করি। আমাদের অনুরোধে তিনি খেলার স্থান পরিবর্তনের নির্দেশ দিলেন। ১টার পর দুপুরের খাবার গ্রহণ, সালাতুজ যোহর জামায়াতের সাথে আদায়কালীন সময়ে সাক্ষাতের স্লিপ আসত। প্রতিদিন ১-২ জন ভাইয়ের আত্মীয়স্বজন আসত। সাক্ষাৎ শেষে ৩টা পর্যন্ত কেউ বিশ্রাম নিত কেউ বা পড়ালেখা করত। ৩টা থেকে মাগরিব পর্যন্ত সালাতুল আসর, কন্টাক্ট, অন্যান্য কয়েদি- হাজতিদের সাথে মতবিনিময় ও ব্যায়াম ছিল নিত্যদিনের রুটিন। মাগরিবের আগেই সেলের নির্ধারিত রুমে প্রবেশ করতে হতো। আমরা প্রায়ই নফল রোজা রাখতাম। আমাদের ভাইদের ওপর সরকার যখন ব্যাপক দমন নিপীড়ন চালাচ্ছিল, তখন নফল রোজা রেখে ভাইদের জন্য দোয়া করা ছিল আমাদের প্রতিদিনের কাজ। যেদিন রোজা থাকতাম সেদিন আসরের পর থেকেই ইফতারের প্রস্তুতি চলত। মাগরিবের নামাজ শেষে দারসের কর্মসূচি ছিল। পালাক্রমে আমরা দারস দিতাম। দারস শেষে রাতের খাবার গ্রহণ এরপর সালাতুল এশা শেষে রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়া ছিল আমাদের নিত্যদিনের রুটিন, কেননা রাত ২টার আগে আবার জাগতে হবে। সুন্দরই কাটছিল সময়টি। হঠাৎ একদিন খবর এল আমীরে জামায়াতসহ জামায়াতের অধিকাংশ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। শুনে সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ল, কে কাকে থামাবে? টিভি, রেডিও না থাকায় অন্যের দেয়া খবর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অন্য দিকে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় হাজতি-কয়েদিরা যার যার সেলে, ওয়ার্ডে আটক থাকায় কারো কাছ থেকে কিছু জানা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় কী কারণে, কী মামলায় সরকার আমাদের প্রিয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেছে জানার জন্য সঙ্গী-সাথীরা পেরেশান হয়ে পড়ে। শুনলাম রাতেই তাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হবে। সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সমপদমর্যাদায় যারা গ্রেফতার হন তাদেরকে রাখা হয় ভিআইপি সেলে। আমাদের ২৬ সেলের পাশেই ২৭ সেল। ২৭ সেলটি ভিআইপি সেল নামে পরিচিত। কারাগারে যাওয়ার পর জানতে পারি জরুরি অবস্থার সময় আমীরে জামায়াত, সেক্রেটারি জেনারেল, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মু. তাহের ভাইকে এই সেলেই রাখা হয়েছিল। প্রতিদিন হাঁটাহাঁটির সময় এ সেলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন ২৭ সেলে ছিলেন সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী আ: সালাম পিন্টু, নাছিরউদ্দিন পিন্টু ও একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। কিছুদিন পর গ্রেফতার হয়ে সেখানে আসেন বিএনপি নেতা শমসের মবিন চৌধুরী। ভিআইপিরা সারাদিন রুম থেকে বের হতে পারতেন না। সন্ধ্যার পরে তারা বের হতেন। হঠাৎ একদিন আ: সালাম পিন্টু সাহেবের সাথে বিকেলে দেখা। তিনি আমাদের সেলের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে ছিলেন। আমরা কয়েকজন সাক্ষাৎ করতে গেলাম। আমি আমার ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক এবং পারিবারিক পরিচয় তার সামনে পেশ করলে তিনি আমাদেরকে আলিঙ্গন করে বললেন, ‘ধৈর্য ধর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ তিনি তার মন্ত্রী থাকা অবস্থার স্মৃতিচারণ করে বললেন, নিজামী সাহেব খুব ভালো মানুষ, তাঁর সাথে আমি কাজ করেছি। আমরা তার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলাম। তিনি সমস্যা হলে তাকে জানাতে বললেন। এরপর থেকে তিনি প্রায়ই আমাদের খোঁজ-খবর নিতে আসতেন, বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতেন। এরই মাঝে আমীরে জামায়াত গ্রেফতার হয়ে ২৭ সেলে আসবেন। পিন্টু সাহেব, মবিন সাহেব থাকায় কিছু সহযোগিতা হবে ভেবে আশ্বস্ত হলাম। আমীরে জামায়াতকে কখন নিয়ে আসা হবে, কিভাবে যোগাযোগ করব এ নিয়ে পেরেশানি বেড়ে গেল। সারারাত ইবাদাত বন্দেগি করে আল্লাহর কাছে নেতৃবৃন্দের জন্য, ইসলামী আন্দোলনের জন্য বিশেষ মুনাজাতের মাধ্যমে কাটিয়ে দিলাম একটা বিনিদ্র রজনী। সকালে গেট খুলে দেয়ার সাথে সাথে ছুটে গেলাম ২৭ সেলের সামনে, খবর নিলাম নতুন কেউ এসেছে কি না। জানতে পারলাম রাতে কেউ আসেনি, জামায়াত নেতৃবৃন্দকে বিকেলে নিয়ে আসা হবে। সারাদিন কারা প্রশাসনকে বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে দেখলাম। লেপ, তোশক, খাট, ব্যবহার্য জিনিসপত্র আনতে দেখলাম। কিছুক্ষণ পরপর জেলার, সুবেদার, ডেপুটি জেলারদেরকে ২৭ সেলে এসে কাজের তদারকি করতে দেখলাম। জামায়াত নেতৃবৃন্দ গ্রেফতারের পর কারাগারে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়, সৃষ্টি হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারাগারের কয়েদি-হাজতিরা ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন.....

সেলের গেট ১ ঘন্টার জন্য খুলে রাখার সময়টাকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। পাঠাগার থেকে বই সংগ্রহ, ২৬ সেলে ঘুরতে আসা কয়েদি-হাজতিদের মাঝে নামাজের দাওয়াতি কাজ এবং নিজেদের মাঝে ব্যক্তিগত পর্যায়ের যোগাযোগের কাজটি শেষ করব। সবাই মিলে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম ট্যাংকের শরবত এবং ফল-ফলাদি প্রতিদিন কমপক্ষে ১০/১৫ জনের মাঝে বিতরণ করব। সিদ্ধান্তের আলোকে কাজ শুরু হল। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া ফলাফল আসল প্রত্যাশার চেয়ে বেশী। কারাগারের পাঠাগারে  রয়েছে অনেক আদর্শিক বই, রয়েছে তাফসির। পুরাতন কয়েদিদের কাছে জানতে পারলাম জরুরী অবস্থার সময় জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কারাগারে থাকাবস্থায় মসজিদ সংস্কার, সমৃদ্ধ পাঠাগার হয়েছে। মসজিদ সংস্কারে বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর অবদান বেশি। ২৪ ঘন্টা আটক থাকাবস্থায় আমাদের রুমের গেইটের সামনে ক্যারাম বোর্ড খেলাসহ আড্ডাবাজদের আড্ডা চলত প্রতিনিয়ত। যার কারণে আমাদের কষ্ট হতো। তাদের জ্বালায় ছিলাম অতিষ্ঠ। কিন্তু কিছুই করার নেই। ইতোমধ্যে আমরা কারাগারে পরিচিত মুখ। ৩০ মে থেকে শুরু করে ২৫ জুন পর্যন্ত কারাগারে গ্রেফতার হয়ে আসে আমাদের শতাধিক ভাই। ২০/২৫ দিন কাজ করার কারণে পুরাতন হাজতি হিসেবে সবার সাথে আমরা ছিলাম পরিচিত। এখন সমস্যা নাই বেশী একটা। এমতাবস্থায় একদিন সুবেদারের সাথে সাক্ষাত করে ক্যারাম বোর্ড খেলার স্থান পরিবর্তনের জন্য তাকে অনুরোধ করি। আমাদের অনুরোধে তিনি খেলার স্থান পরিবর্তনের নির্দেশ দিলেন। ১টার পরে দুপুরের খাবার গ্রহণ, সালাতুল যোহর জামায়াতের সাথে আদায়কালীন সময়ে সাক্ষাতের স্লিপ আসত। প্রতিদিন ১/২ জন ভাইয়ের আত্মীয় স্বজন আসত। সাক্ষাৎ শেষে ৩টা পর্যন্ত কেউ বিশ্রাম নিত কেউ বা পড়ালেখা করত। ৩টা থেকে মাগরিব পর্যন্ত সালাতুল আছর, কন্টাক্ট, অন্যান্য কয়েদী হাজতীদের সাথে মতবিনিময় ও ব্যায়াম ছিল নিত্যদিনের রুটিন। মাগরিবের পূর্বেই সেলের নির্ধারিত রুমে প্রবেশ করতে হতো। আমরা প্রায়ই নফল রোজা রাখতাম। আমাদের ভাইদের উপর সরকার যখন ব্যাপক দমন নিপীড়ন চালাচ্ছিল, তখন নফল রোজা রেখে ভাইদের জন্য দো’য়া করা ছিল আমাদের প্রতিদিনের কাজ। যেদিন রোজা থাকতাম সেদিন আছরের পর থেকেই ইফতারের প্রস্তুতি চলত। মাগরিবের নামাজ শেষে দারসের কর্মসূচি ছিল। পালাক্রমে আমরা দারস দিতাম। দারস শেষে রাতের খাবার গ্রহণ এরপর সালাতুল এশা শেষে রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়া ছিল আমাদের নিত্যদিনের রুটিন কেননা রাত ২টার আগে আবার জাগতে হবে। সুন্দরই কাটছিল সময়টি। হঠাৎ একদিন খবর আসল আমীরে জামায়াতসহ জামায়াতের অধিকাংশ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। শুনে সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, কে কাকে থামাবে? টিভি, রেডিও না থাকায় অন্যের দেয়া খবর বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অন্যদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় হাজতি কয়েদিরা যার যার সেলে, ওয়ার্ডে আটক থাকায় কারো কাছ থেকে কিছু জানা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় কি কারণে, কি মামলায় সরকার আমাদের প্রিয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেছে জানার জন্য সঙ্গী-সাথীরা পেরেশান হয়ে পড়ে। শুনলাম রাতেই তাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হবে। সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ সম পদমর্যাদায় যারা গ্রেফতার হন তাদেরকে রাখা হয় ভি.আই.পি সেলে। আমাদের ২৬ সেলের পাশেই ২৭ সেল। ২৭ সেলটি ভি.আই.পি সেল নামে পরিচিত। কারাগারে যাওয়ার পর জানতে পারি জরুরী অবস্থার সময় আমীরে জামায়াত, সেক্রেটারী জেনারেল, ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মু. তাহের ভাইকে এই সেলেই রাখা হয়েছিল। প্রতিদিন হাঁটাহাঁটির সময় এ সেলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন ২৭ সেলে ছিল সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী আঃ সালাম পিন্টু, নাছিরউদ্দিন পিন্টু ও একজন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা। কিছুদিন পর গ্রেফতার হয়ে সেখানে আসেন বিএনপি নেতা শমসের মবিন চৌধুরী। ভি.আই.পিরা সারাদিন রুম থেকে বের হতে পারতেন না। সন্ধ্যার পরে তারা বের হতেন। হঠাৎ একদিন আঃ সালাম পিন্টু সাহেবের সাথে বিকালে দেখা। তিনি আমাদের সেলের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে ছিলেন। আমরা কয়েকজন সাক্ষাৎ করতে গেলাম। আমি আামার ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক এবং পারিবারিক পরিচয় তাঁর সামনে পেশ করলে তিনি আমাদেরকে আলিঙ্গন করে বললেন, “ধৈর্য্য ধর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে”। তিনি তার মন্ত্রী থাকা অবস্থার স্মৃতিচারণ করে বললেন, নিজামী সাহেব খুব ভাল মানুষ, তাঁর সাথে আামি কাজ করেছি। আমরা তার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলাম। তিনি সমস্যা হলে তাকে জানাতে বললেন। এরপর থেকে তিনি প্রায়ই আমাদের খোঁজ-খবর নিতে আসতেন, বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতেন। এরই মাঝে আমীরে জামায়াত গ্রেফতার হয়ে ২৭ সেলে আসবেন। পিন্টু সাহেব, মবিন সাহেব থাকায় কিছু সহযোগিতা হবে ভেবে আশ্বস্ত হলাম। আমীরে জামায়াতকে কখন নিয়ে আসা হবে, কিভাবে যোগাযোগ করব এ নিয়ে পেরেশানি বেড়ে গেল। সারারাত ইবাদাত বন্দেগী করে আল্লাহর কাছে নেতৃবৃন্দের জন্য, ইসলামী আন্দোলনের জন্য বিশেষ মোনাজাতের মাধ্যমে কাটিয়ে দিলাম একটা বিনিদ্র রজনী। সকালে গেট খুলে দেয়ার সাথে সাথে ছুটে গেলাম ২৭ সেলের সামনে, খবর নিলাম নতুন কেউ এসেছে কিনা। জানতে পারলাম রাতে কেউ আসেনি, জামায়াত নেতৃবৃন্দকে বিকেলে নিয়ে আসা হবে। সারাদিন কারা প্রশাসনকে বিভিন্ন প্রস্তুতি নিতে দেখলাম। লেপ, তোষক, খাট, ব্যবহার্য জিনিসপত্র আনতে দেখলাম। কিছুক্ষণ পরপর জেলার, সুবেদার, ডেপুটি জেলারদেরকে ২৭ সেলে এসে কাজের তদারকী করতে দেখলাম। জামায়াত নেতৃবৃন্দ গ্রেফতারের পর  কারাগারে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়, সৃষ্টি হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারাগারের কয়েদী হাজতিরা ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের গ্রেফতারে খুশি হয়েছেন এমন লোকের সংখ্যা ছিল নগন্য। কষ্ট পাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি। কষ্ট পাওয়া মানুষের বক্তব্য ছিল এ রকম “সরকার দেশ ও ইসলাম বিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা মনে করে বলে দেশপ্রেমিক জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেছে। যারা একদিকে দ্বীনদারী পরহেজগারীতে অধিকতর অগ্রসর, অপরদিকে দুনিয়ার ব্যবস্থাপনা চালানোর জন্য সঠিক দুনিয়াদার থেকে অধিকতর যোগ্যতা সম্পন্ন আল্লাহ ভীরু, বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান মানুষ”। দুই দিন যাবৎ অপেক্ষার পালা শেষ হল। রাত ৮ টার দিকে আমীরে জামায়াতসহ নেতৃবৃন্দকে ২৭ সেলে নিয়ে আসা হল। লকাব তালাবদ্ধ অবস্থায় জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা আমাদের। নেতৃবৃন্দকে একনজর দেখবার জন্য জানালার পাশে পালাক্রমে বিভিন্ন ভাইদেরকে দাঁড় করে রেখেছিলাম। কিন্তু যখন সালাতুল এশার জামাত আদায়ে আমরা ব্যস্ত এমতাবস্থায় নেতৃবৃন্দকে আমাদের  সেলের পেছনে ৯০ সেলের পাশ দিয়ে ২৭ সেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নামাজ শেষে মিয়া সাবের কাছে খবরটা জানতে পেরে কষ্টই পেলাম। নেতৃবৃন্দ কারাগারে আসায় সারাটা রাত ঘুমাতে পারিনি। নামাজ পড়ে, তেলাওয়াতে সময়টা কাটিয়ে দিলাম। রাত যেন কাটেনা। সকালের অপেক্ষায় থাকলাম। সকাল হয়েছে কিন্তু পূর্বের মত আমাদের লকাবের দরজা খোলা হচ্ছেনা। ভোরে গোসল করার জন্য আমাদেরকে অন্যস্থানে নিয়ে যাওয়া নিয়মিত রুটিন ওয়ার্ক ছিল। সেদিন সেটাও বন্ধ। আমাদের বুঝার বাকী রইলনা নেতৃবৃন্দকে পাশের সেলে রাখাতে সতর্কতা মূলক আবার আগের মত শাস্তি শুরু হয়েছে। কারাগারে অনেকদিন থাকায় কারাবিধি সম্পর্কে আমরা ছিলাম সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল। অনেক কষ্টের পর মাত্র ৫/৬ দিন পাওয়া আমাদের ন্যায্য অধিকার যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ২৪ ঘন্টা সেলে তালাবদ্ধ থাকার দিন যেন শুরু হচ্ছে। করণীয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলাম। আমাদের গ্র“পে থাকা মুরব্বী এ যুগের আল্লাহর দ্বীনের বীর মুজাহিদ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদীর এক ঐতিহাসিক উক্তি আমাদের শোনালেন- “সত্য পথের প্রকৃত দাবী হচ্ছে আমাদের মধ্যে যেন বিরোধীতাকে স্বাগত জানানোর অনুরাগ সৃষ্টি হয়। সত্য পথেই হোক আর ভ্রান্ত পথেই হোক, আল্লাহ তায়ালার নীতি হচ্ছে, যে ব্যক্তি যে পথই অবলম্বন করে সে পথেই তার অগ্নি পরীক্ষা হয়। হক পথের তো বৈশিষ্টই হল প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এ পথ অগ্নি পরীক্ষায় পরিপূর্ণ।” মরহুম সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী (র) এর ঐতিহাসিক এ উক্তিটি আমাদের মনে হতাশার মাঝে আশার আলো জাগিয়ে তোলে। সবাই মিলে নতুন যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেই। ভোরে গোসল বন্ধ, গেইটের তালা খোলা হচ্ছেনা। আমাদের সেলের সেবায় নিয়োজিত ফালতুকে জিজ্ঞেস করলাম আমাদের ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নতুন কোন সিদ্ধান্ত আছে কিনা। তিনি কষ্টের সাথেই জানালেন, “নিজামী, সাঈদী ও মুজাহিদ সাহেব কারাগারে আসায় শিবির-জামায়াতের লোকদেরকে আজ থেকে আবার শাস্তি ভোগ করতে হবে”। সাথে সাথে আবার বললেন- “কারাগারের আইন আড়াই দিন থাকে, চিন্তা করবেননা আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে”। পরিস্থিতি যাই হোক মানিয়ে নেয়ার যোগ্যতা ইতোমধ্যে আমদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অতএব নতুন রুটিন করে আবার আমাদেরকে চলতে হবে। নেতৃবৃন্দ কেমন আছেন, খাবার সহ সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে কিনা জানার জন্য ঐ সেলের দায়িত্বে থাকা একজন ভাইকে ডেকে নিয়ে আসলাম। তাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলাম। আল্লাহর দ্বীনের কর্মীদেরকে সহযোগিতা করলে আল্লাহ তার প্রতি খুশি হবেন। জামায়াত নেতৃবৃন্দ খুব ভাল মানুষ, সাবেক মন্ত্রী ও এম.পি। তাদের সেবা করলে দুনিয়া ও আখিরাতে লাভ হবে। এমন অনেক কথা বলে ২৭ সেলের দায়িত্বে থাকা ফালতুকে ম্যানেজ করলাম। তিনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করলেন এবং বললেন “নেতৃবৃন্দের সেবায় কোন গ্যাপ হবেনা, আপনাদের সাথে তাদের যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেব”। ঐ ভাইটিকে কিছু আম, টমেটো, কলা দিয়ে আমীরে জামায়াতসহ নেতৃবৃন্দের কাছে পৌঁছানোর অনুরোধ করি। ঐ ভাইটি এগুলো নিয়ে চলে গেলেন। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমাদের প্রাণপ্রিয় আমীরে জামায়াতের সেবা করার সুযোগ পাব এবং আল্লাহ একজনকে সহযোগিতা করার জন্য আমাদের ব্যবস্থা করেছেন এ ভেবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। আমাদের অনুরোধ রাখলেন ঐ ভাইটি। তিনি জামায়াতের সেক্রেটারী জেনারেলের সালাম জানিয়ে বিকালে এসে বললেন আমাদের কয়জন ভাই কারাগারে আছে সহসা জানাতে বলেছেন মুজাহিদ সাহেব। সাথে এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে এসে বললেন- “নিজামী সাহেব আপনাদের জন্য পাঠিয়েছেন”। আমীরে জামায়াত ছাত্রশিবিরের কর্মীদেরকে সন্তানের মত ভালবাসেন বিধায় কারাগারে এসে ও আমাদের খবর নিতে ভুলেন নাই। আমীরে জামায়াতের পাঠানো বিস্কুট পেয়ে সবার চোখে পানি চলে আসল। আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে দো’আ করলাম, “ইয়া রাব্বুল আলামীন, আমীরে জামায়াতসহ নেতৃবৃন্দের সব বিষয় তোমার উপর ছেড়ে দিয়েছি, তুমিই তাদের সবচেয়ে বড় হেফাজতকারী।  আমরা কেবল তোমার সন্তুষ্টি ও ভালবাসা চাই। যতক্ষণ প্রাণ আছে তোমার সন্তুষ্টির পথে আমাদেরকে অবিচল রাখ। তুমি আমাদের ধৈর্য্য ও সাহস দাও। যেন তোমার পথে চলতে গিয়ে যে কোন বিপদের মোকাবেলা করতে পারি”। নতুন করে আমাদেরকে ২৪ ঘন্টা সেলে আটকিয়ে রাখা শুরু হল। শুরু হল পানির সংকট। আমীরে জামায়াত গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁর মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে প্রতিদিন কারাগারে আমাদের ভাইয়েরা গ্রেফতার হয়ে আসতে শুরু করল। নতুন ভাইদের দেখাশুনা করার জন্য কারাগারে থাকা পুরাতন ভাইদের মাঝে দায়িত্ব ভাগ করে দিলাম। আমরা যেহেতু ২৪ ঘন্টা আবদ্ধ এমতাবস্থায় কারাগারের বিপদের প্রথম সাথী তৌহিদ ভাই, আমদানী সেলের ফালতু টাইগার, ২৭ সেলের ফালতু শাহীনসহ বিভিন্ন ভাইদের এ ক্ষেত্রে বেশি কাজে লাগালাম। কাউকে অনুরোধ করে, কাউকে সিগারেট দিয়ে  ম্যানেজ করে নতুন ভাইদের কাছে সকালের নাস্তা, দুপুরের আলু ভর্তা (যা আমরা সুন্দর ভাবে নিজেরাই বানাতাম), ক্যান্টিন থেকে ক্রয় করা সবজি, তরকারি ইত্যাদি পাঠানোর ব্যবস্থা করি। আমাদের জিনিসপত্র পৌঁছাতে গিয়ে মিয়া সাবদের রোষানলে পড়তে হয় কয়েকজনকে, জরিমানা গুণতে হয় দু’জনকে। অনেক ঝুকিপূর্ণ হওয়া স্বত্তেও কিছু ভাই নতুন ভাইদেরকে আমাদের সেলে নিয়ে আসা অথবা অন্য ভাইদের সাথে থাকার ব্যবস্থা করে আমদানীর যন্ত্রনাদায়ক আযাব থেকে তাদেরকে মুক্তির কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেন। আমি ঐ সকল ভাইদের প্রতি কৃতজ্ঞ। অনেককে বলতে শুনেছি “অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি সহ নানা অপকর্ম করে ৫/১০ বছরের সাজা হয়েছে এবার কুরআনের সৈনিকদের সেবা করে আরো দুই বছর সাজা হলেও এ ভাল কাজ থেকে পিছপা হবনা”... (চলবে)

লেখক : কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

[email protected]

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির