post

জুলুম

নিপীড়নই ইসলামী আন্দোলন বিজয়ের মাইলফলক

২৬ নভেম্বর ২০১১
মিয়া মুজাহিদুল ইসলাম দ্বীন প্রতিষ্ঠার মহান কাজ বা ইকামতে দ্বীনের এ আন্দোলনকে ফরজ করা হয়েছে। সকল নবী রাসূল ও সাহাবায়ে কেরামগণ এ কাজে সফল হয়েছিলেন। এ সফলতার অর্থ বিজয় নয়, বরং সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন। কাউকে কাউকে আল্লাহ বিজয় দান করেছেন আর কাউকে বিজয় না দিয়েই সর্বোচ্চ মর্যাদায় সম্মানিত করেছেন। ইকামতে দ্বীনের আন্দোলনের চূড়ান্ত সফলতাই হলো সর্বোচ্চ ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, বিজয় নয়। সাহাবায়ে কেরাম (রা) ও সকল নবী রাসূলই এই ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। হজরত খুবাইব ইবনে আদি (রা) ইসলামের একজন শ্রেষ্ঠ শহীদ। আল্লাহর একজন প্রিয় ব্যক্তি। নির্যাতনের সর্বপ্রকার ভয়াবহতা, নির্মমতা সহ্য করে যিনি ঈমানের ওপর দৃঢ় ছিলেন। মক্কার কুরাইশ নেতারা এই সাহাবীকে বন্দী করে তানঈম নামক স্থানে নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করে। কুরাইশ নেতারা হজরত খুবাইবের নির্যাতনের এবং ফাঁসির দৃশ্য দেখানোর জন্য মক্কার যুবকদেরকে আহবান করেছিল। হজরত সাইদ ইবনে আমের আল জুমাহি ছিলেন মক্কার সেই সব কুরাইশ যুবকদের অন্যতম। খুবাইব ইবনে আদি (রা) এর শাহাদাতের দৃশ্য ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও হৃদয়স্পর্শী। তার হাত-পা শিকলে বেঁধে ফাঁসির মঞ্চের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় মক্কার নারী-পুরুষ ধাক্কা দিয়ে দিয়ে মঞ্চে নিয়ে যেতে থাকে। কুরাইশ নেতারা ও উপস্থিত দর্শকেরা হাততালি দিয়ে এই নির্মমতাকে উৎসাহ দিচ্ছিল। সাইদ ইবনে আমের আল জুমাহি একটি উঁচু টিলায় দাঁড়িয়ে এ নির্মম দৃশ্য দেখছিল। শাহাদাতের এ নিমর্মতা পড়লে ও শুনলে কলম ও মন ২৮ অক্টোবর ’০৬ দিকে ঝুঁকে যায়। ২৮ অক্টোবর ০৬ পল্টন মোড়ে শহীদ জসিম উদ্দীনের শাহাদাতের মর্মস্পর্শী নৃশংসতাকে আওয়ামী ক্যাডাররা এমনিভাবে করতালি দিয়ে উৎসাহিত করেছিল। আল্লাহ এই দিনের সব শহীদকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুক। ইতোমধ্যে খুবাইব (রা)-কে ফাঁসির মঞ্চে উপস্থিত করেছে। কাফেররা খুনের নেশায় উন্মাদ। চতুর্দিকে তুমুল হর্ষধ্বনি দিয়ে হিংস্র ও বর্বররা উল্লাসে ফেটে পড়ল। খুবাইব (রা) আল্লাহর সান্নিধ্যের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। হজরত সাইদ ইবনে আমের আল জুমাহি শুনলেন যে খুবাইব (রা)-এর কণ্ঠ থেকে শান্তি ও তেজোদীপ্ত আওয়াজ ‘তোমরা অনুমতি দিলে ফাঁসির পূর্বে আমি দু’রাকাত নফল নামাজ পড়তে চাই।’ কী সুন্দর চিত্তাকর্ষক, স্থির এবং স্বল্প পরিসরের দুই রাকাত নামাজ। হজরত সাঈদ দেখলেন নামাজ শেষ করেই খুবাইব (রা) উপস্থিত লোকদের উদ্দেশে বললেন- ‘আল্লাহর শপথ! আমি মৃত্যুর ভয়ে নামাজ দীর্ঘায়িত করছি, তোমরা এ ধারণা করবে বলে মনে না হলে আমি আমার নামাজ আরো দীর্ঘ করে পড়তাম।’ খুবাইব (রা) এই দীপ্ত ঘোষণার পরই মক্কার কাফিররা তার ওপর সেই পৈশাচিক ও অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে দিলো। মানুষতো দূরের কথা, একটি নিরেট পশুকেও জীবিত অবস্থায় তার দেহ থেকে প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একের পর এক কেটে বিচ্ছিন্ন করার মতো নিমর্মতা প্রদর্শন করতে পারে না। অথচ তৎকালীন মানুষরূপী জালেমেরা জীবিত অবস্থায়ই খুবাইব (রা) এর শরীর থেকে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কেটে বিচ্ছিন্ন করতে থাকে। আর রাসূল (সা)-এর বিরুদ্ধে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে। হজরত খুবাইবে (রা) এর শরীর থেকে তখন ভীষণভাবে রক্তপাত হচ্ছিল। শত পৈশাচিক নির্যাতন নিপীড়ন সত্ত্বেও আল্লাহর নির্ভীক সৈনিক খুবাইব (রা) বলিষ্ঠ ঈমানী চেতনায় অনড় এবং অটল। ‘মুনাফিকি জীবন থেকে শহীদি মৃত্যু আমার কাছে অনেক উত্তম।’ এভাবে নির্মম পৈশাচিক কায়দায় খুবাইব (রা) শাহাদাতের পাক পেয়ালা পান করেন। খুবাইব (রা) এর শাহাদাতের নির্মম দৃশ্য যুবক সাঈদের অন্তরে অত্যন্ত গভীরভাবে রেখাপাত করে। সে ঘুমন্ত অবস্থায়, স্বপ্নে, জাগ্রত অবস্থায় এবং কল্পনার চোখে তাকে দেখতে থাকে। সে যেন দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে ধীর ও প্রশান্তচিত্তে ফাঁসির সামনে খুবাইব (রা) দু’রাকায়াত নামাজ আদায় করছেন। আসমান থেকে কোনো বিকট ধ্বনি কিংবা প্রকাণ্ড পাথর তার ওপর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। এভাবে হযরত সাঈদ ইবনে আমের আল যুমহির হৃদয় তাওহিদের প্রতি ঝুঁকে পড়ল। রাসূল (সা) এর প্রতি তিনি আসক্ত হলেন এবং ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে তিনি রাসূল (সা) এর একজন কর্তব্যনিষ্ঠ সৈনিক হয়েছিলেন। হযরত খুবাইব (রা) এর নির্মম শাহাদাতের ঘটনা যেমন ইসলামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি হজরত সাঈদ (রা)-এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাও অনন্য। বর্তমান আওয়ামী সরকারও ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীল কর্মীদের ওপর এহেনও বর্বর আচরণ চালাচ্ছে। আধুনিক বিশ্ব যখন মানবাধিকারের শ্লোগানে মুখর, তখন এই সরকার বর্বর ও পাশবিকতায় মেতে উঠেছে। কিভাবে একজন মানুষ আরেক জন মানুষকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে নির্যাতন চালাতে পারে। মানুষের শরীর তো টাংস্টান তার নয় যে তাতে উপর্যুপরি বৈদ্যুতিক প্রবাহ পরিচালনা করতে হবে। রক্ত-মাংস দিয়ে গড়া শরীর কত শক্ত হতে পারে, যে ইলেকট্রিক প্লাস দিয়ে তা বাঁকানোর চেষ্টা করতে হবে! আওয়ামী বর্বরতা কত নিষ্ঠুর, কত পাষাণ। একজন মানুষ দেখতে, বয়সে, সুঠামো যুবক থাকবে কিন্তুু সে পুরুষত্বহীনতায় ঢুকরে ঢুকরে কাঁদবে, এ দৃশ্যই আওয়ামীদের জন্য আনন্দের! যখন জাতীয় নেতৃবৃন্দ, যারা দেশ ও জাতির কল্যাণ, জাতীয় নিরাপত্তা গণ-অধিকার রক্ষা আর ইসলামকে বুকে ধারণ করার অপরাধে নির্মম নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরে মানুষের সামনে অসহায়ভাবে দাঁড়ায়, তখন মনে হয় আসলে নেতৃবৃন্দ অসহায় নয় বরং অসহায় গোটা জাতি। অসহায় মানবাধিকার। নির্যাতন, বর্বরতা পৈশাচিকতা, আর নিষ্ঠুরতা দেখে বারবার মনে হয় এটাই কি আওয়ামী লীগের বর্বরতা নাকি এর নামই বর্বর আওয়ামী লীগ? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে গিয়েই কি এই বর্বরতা, নাকি ইসলামের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণা? আওয়ামী লীগ আপাদমস্তকই বর্বর। বর্বরতাই তাদের কাজ। এ প্রজন্মের জন্য ২৮ অক্টোবরই শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। নমরুদ, ফেরাউনের মতো দাম্ভিক শাসকের জুলুমেরও শেষ হয়েছে। আওয়ামী সরকার তার গোটা শক্তি ও কৌশল ব্যবহার করেই ইসলামী আন্দোলনকে নির্মূল করতে চায়। আমীরে জামায়াতসহ নেতৃবৃন্দকে কারাগারে যে কষ্ট দিচ্ছে অচিরেই তার প্রতিফল ভোগ করতে হবে। গুয়ান্তানামাবো বা আবু গারিব বন্দিশিবিরে নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা শুনে মানুষ আঁতকে উঠত। ইসলামী ছাত্রশিবিরের শত শত নেতাকর্মীর ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে বা চালাচ্ছে তার প্রত্যেকটি বিবরণ পৃথক পৃথকভাবে বর্ণিত হলে শরীর শিউরে উঠবে। একজন কর্মীকে গ্রেফতারের শুরু থেকে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে কারাগার পর্যন্ত এক একজন খুবাইব (রা) কে দেখে অসংখ্য সাঈদ (রা)-এর জন্ম হচ্ছে। নিষ্ঠুর নির্যাতনে ক্ষত-বিক্ষত দেহ নিয়ে একজন খুবাইব (রা) হয়ত মৃত্যু যন্ত্রণা বরণ করছে ঠিকই, কিন্তু নির্যাতনের ভয়াবহতা যারাই প্রত্যক্ষ করছে যত নিষ্ঠুর, পাষাণ মন হোক না কেন, ঈমানের দৃঢ়তা আর সাহসিকতা দেখে তারা যুবক সাঈদ ইবনে আমের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ইসলামী ইতিহাসের এ এক চমৎকার ধারাবাহিকতা। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তার দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার তৌফিক দান করুন। ইসলামী আন্দোলনের পথ কখনোই কুসুমা-স্তীর্র্ণ নয়। শাহাদাত এর সর্বোচ্চ সাফল্য। এ পথের কর্মীদেরকে তাই তাওহিদের বলে বলীয়ান হতে হবে। দুনিয়ার এই খণ্ডকালীন জীবনের মায়া আর রঙিন স্বপ্নে নিজেকে নিমজ্জিত না করে বরং মহান প্রভুর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। সর্বোচ্চ পরীক্ষার জন্য নিজেকে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহর মাগফিরাতের বান্দা হওয়ার জন্য পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পাওয়াও একটা সাফল্য। নিজের প্রস্তুতির পাশাপাশি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ “আমাকে এমন কোন কঠিন পরীক্ষায় নিয়ো না যে পরীক্ষায় পাশ করার ক্ষমতা আমার নাই।” বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রত্যক জনশক্তিকে চরম ধৈর্য ও সাহসিকতার মধ্য দিয়ে ময়দানে মোকাবেলা করতে হবে। রাত্র যত গভীর হয় সুবেহ সাদিক তত নিকটে আসে। এতে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। জুলুমের অবসান হবেই ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তো শুধু দেখতে চান, তার দ্বীনের ক্ষেত্রে আমরা সাচ্চা কি না? হজরত ইবরাহিম (আ)-কে এমনিভাবে চরম পরীক্ষা নিয়েছিলেন। আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলেই বিজয় সুনিশ্চিত। তাই সকল জনশক্তিকে ধৈর্য ও সাহসিকতার মাধ্যমে আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। ব্যক্তিগত আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমিন। লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় ক্রীড়া সম্পাদক বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির