post

তুমি রহমতে আলম জানে সারা দুনিয়া

আহসান হাবীব ইমরোজ

০২ অক্টোবর ২০২০

মানবজাতির আদি পিতা মুসলমানদের দৃষ্টিতে আদম, খ্রিস্টান-ইহুদিদের দৃষ্টিতে অ্যাডাম, হিন্দুদের দৃষ্টিতে মনু যেই হোন না কেন ইতিহাস বিশ্লেষণে বলা যায় তার আবির্ভাব আনুমানিক ১০ হাজার বছর আগে। ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত Population Reference Bureauএর মতে আদি থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা ১০,৮০০ কোটি প্রায়। বিগত ১০ হাজার বছরে জন্ম গ্রহণকারী এই ১০,৮০০ কোটি মানুষের ভিতর সর্বশ্রেষ্ঠ কে? নিশ্চয়ই এটি বিশ্বের সবচাইতে জটিল প্রশ্নগুলোর অন্যতম। যুক্তির নিরিখে এটি সমাধানের জন্য সাধারণভাবে প্রয়োজন সমস্ত মানুষের সামগ্রিক জীবনবৃত্তান্ত, তাদের সমসাময়িক পরিবেশ, কর্ম, কর্মের উদ্দেশ্য, তার প্রভাব ও স্থায়িত্ব সম্পর্কে জানা এবং সর্বোপরি এগুলো বিশ্লেষণের জন্য দরকার সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ একদল গবেষক ও যুগ যুগ সময়, যা এক কথায় প্রায় অসম্ভব। এ জন্যই বোধকরি আজ অবধি কোন মানুষ এই অসম্ভব গবেষণার উদ্যোগ নেননি। কিন্তু গত ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটিতে এক অনাড়ম্বর প্রকাশনা উৎসবের মধ্য দিয়ে উপস্থিত হাজার হাজার বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক তথা সে দেশের শ্রেষ্ঠ সুধীগণের কাছে তুলে ধরা হলো ৫৭২ পৃষ্ঠার একটি বৃহৎ বই, নাম The 100 : A Ranking of the Most Influential Persons in History (1978) মাইকেল এইচ হার্ট (Michael H. Hart (born, 1932) ১৯৩২) এর নেতৃত্বে বহুমুখী ক্ষেত্রের দক্ষ গবেষকদের একটি দল ১০ বৎসরব্যাপী অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই মূল্যবান গ্রন্থটি। বইটিতেও কোনো ব্যক্তির শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড ধরা হয়েছে তার কর্ম এবং মানবজাতির ওপর তার কর্মের প্রভাবের স্থায়িত্ব। অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে মর্যাদা ও প্রভাবের ক্রমানুসারে সজ্জিত বিশ্বের সেরা একশ জনের তালিকা সংবলিত এই বইটিতে; যেটি বিশ্বে এরকম প্রথম বই তাতে মুহাম্মাদ সা.-এর নাম রাখা হয় সবার উপরে। সুবহানআল্লাহ! অবশ্য মুহাম্মাদ সা.-এর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণাকারী, এটিই প্রথম গ্রন্থ নয় এ ব্যাপারে হাজারো মহা মনীষীর উক্তি প্রণিধানযোগ্য। বিখ্যাত মার্কিন পাদরি বেনজামিন বসওয়ার্থ স্মিথ বলেন, ‘মুহাম্মাদ সা.-এর সমসাময়িক লোকেরা এমনকি তার শত্রুরাও এক বাক্যে তার ধর্মনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, সাহসিকতা ও নম্রতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।’ অর্থাৎ মুহাম্মাদ সা. তাঁর পরিচিত মহল হোক শত্রু অথবা মিত্র সবার কাছে আমানতদারি ন্যায়পরায়ণ ও মুক্তিদাতা হিসেবে শুধু পরিচিত নন, প্রতিষ্ঠিতও ছিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘একটি মহাজাতি, মহাসা¤্রাজ্য ও একটি মহাধর্ম- এ তিনটির একত্র সমাবেশ জগতের ইতিহাসে এই প্রথম। যার তুলনা কোথাও নেই যা হযরত মুহাম্মাদ স্থাপন করেছেন।’ মুহাম্মাদ সা. ছিলেন মানবতার মুক্তিদূত এই বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য আমরা তাঁর জন্মের নিরেট প্রাকৃতিক বিষয়গুলোও পর্যালোচনা করতে পারি। তিনি মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন; যাকে উম্মুল কোরা অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নগরী বলা হয়। পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে লক্ষ্য করলে আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে তৎকালীন অনাবিষ্কৃৃত আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া এবং জনমানবহীন সাইবেরিয়া এলাকা বাদ দিলে, তৎকালীন জন-অধ্যুষিত পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু ছিল মক্কা। কাজেই মানবতার মুক্তিদূতের জন্মস্থান হিসেবে বাছাই করা হয়েছিল বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু মক্কা নগরীকে, যেখানে ছিল আল্লাহর ঘর, পৃথিবীর প্রথম স্থাপনা, কাবা। অপর দিকে দিন ও রাতের ঠিক মাঝখানে সুবহে সাদিকে তাঁর জন্ম হয়েছিল। ঈসা (আ) এর তিরোধানের প্রায় ছয়শত বছর পর রাসূলের সা. আবির্ভাব। তৎকালীন পৃথিবী যুদ্ধ, অনৈতিকতায় ছিল একেবারে পতনোন্মুখ। একজন বিশ্ব-ত্রাণকর্তার আবির্ভাব ছিল তখন সময়ের দাবি। অর্থাৎ বিশ্বমানবতার জন্মের তখনই ছিল উপযুক্ত সময়। হযরত ইবরাহিম (আ) ছিলেন ইরাকের অধিবাসী আর তাঁর স্ত্রী হাজেরা যিনি নির্বাসিত হয়ে এ মক্কা প্রান্তরে এসেছিলেন, তিনি ছিলেন মিসরের সন্তান। ইরাক ও মিসরের রক্তধারায় গঠিত হয় হযরত ইসমাইল। যার স্ত্রী সাঈদা ছিলেন আরবের অধিবাসিনী। তাহলে দেখা যায়, সুপ্রাচীন বিশ্বসভ্যতার তিন প্রধান কেন্দ্র ইরাক-মিসর-আরব রক্তধারায় মিশেলে জন্ম নেন বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মাদ সা.। মাইকেল এইচ হার্ট মুহাম্মাদ সা.কে বিশ্বের সর্বকালের এক নম্বর ব্যক্তি হিসেবে বাছাই করেছেন তার ইহ ও পারলৌকিক উভয় জগতে সমভাবে সর্বোচ্চ সফলতার জন্য। তার ভাষায়; "Supremely successful" in both the religious and secular realms.” তিনি ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সাফল্যের কথা বলেছেন। অপরদিকে আমরা যদি আমাদের সামগ্রিক জীবন পর্যালোচনা করি তাহলে অনেকগুলো স্তর পাবো ; ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গন। আবার ব্যক্তিগত জীবনেও রয়েছে নানাদিকের বিস্তৃতি যেমন; জ্ঞানগত, দৈহিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক দিক। একজন মানুষকে সর্বাঙ্গীণ সফল হতে হলে এই সার্বিক ক্ষেত্রেই হতে হবে। অনেকেই আছেন বাহিরে বিশাল নেতা কিন্তু পরিবারে জিরো! অনেকে ছিলেন জগতের স্টার কিন্তু এখন শুধু ছাই, ভষ্ম। এই প্রেক্ষাপটেই ভারতের এক হিন্দু অধ্যাপক, রামকৃষ্ণ রাও তার অনবদ্য বই ‘মুহাম্মদ দ্য প্রফেট অব ইসলামে’ মন্তব্য করেন : যদি উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব, উপায়-উপকরণের স্বল্পতা এবং বিস্ময়কর ফল মানব প্রতিভা যাচাইয়ের তিনটি মানদণ্ড হয় তাহলে আধুনিক ইতিহাসের কোন মানুষের সাথে হযরত মুহাম্মাদ সা.-এর তুলনা করার মতো ধৃষ্টতা কে দেখাতে পারে?’ ক) জ্ঞান ও আত্মোন্নয়নের সফল কারিগর ÒEveryone thinks of changing the world, but no one thinks of changing himself.” কে বলেছেন এই মহামূল্যবান কথাটি? তিনি সেই মানুষ, যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৪২ কামরাবিশিষ্ট এক সুরম্য-প্রাসাদে। যৌবনে তিনি ছিলেন একজন বিলাসী যুবক। পোশাকের জন্য প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেন। মারামারি করতেন, অনেক জঘন্য পাপকাজ এমনকি খুন-খারাবিও করতেন; একটা নোংরা পাপময় জীবন যাপন করতেন। পৈতৃকসূত্রেই এক বিশাল জমিদারিতে তার জন্ম। শুধুমাত্র নিজের ভাগেই তিনি পেয়েছিলেন প্রায় ৪,০০০ একর জমি এবং ৩৩০ জন ভূমিদাস। মাত্র দুই বছর বয়সে মা মারিয়াকে এবং ৯ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে যার শৈশব শুরু হয়। কিন্তু তিনিই পঞ্চাশ বছর বয়সেই রচনা করেন পৃথিবীর দু’টি অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অমরগাঁথা হয়ে থাকবে। যে উপন্যাস দুটো হলো ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ও ‘আন্না কারেনিনা’। পৃথিবীর অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ১৮২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এতক্ষণে নিশ্চয় চিচিংফাঁক সব কিছু পরিষ্কার, নয় কি? হ্যাঁ তিনি হচ্ছেন লিউ টলস্টয়। বিশ্ব সাহিত্যের গ্র্যান্ডমাস্টার। ভাবছেন বাড়িয়ে বলছি? একদম না । The Greatest Books of All Time, As Voted by 125 Famous Authors. এই শিরোনামে গুগলে সার্চ দিলে জানা যাবে বিশ্বের ১২৫ জন লেখকের জরিপে টলস্টয় শেকসপিয়ারের তুলনায় ১১.৬% পয়েন্টস বেশি পেয়ে সর্বকালের সেরা লেখক মনোনীত হয়েছেন। এই জরিপের বিস্তারিত ফলাফল দেওয়া আছে ; The Top Ten: Writers Pick Their Favorite Books নামক বইটিতে। এটি করতে এর লেখকরা বাছাইকৃত ৫৪৪টি বই জরিপ করেছেন; অতঃপর তাদের দৃষ্টিতে নির্বাচিত সর্বকালের সেরা ১০ লেখকদের পয়েন্টসও দিয়েছেন। TOP TEN AUTHORS BY POINTS EARNED Leo Tolstoy Í 327 William Shakespeare Í 293 James Joyce Í 194 Vladimir Nabokov Í 190 Fyodor Dostoevsky Í 177 William Faulkner Í 173 Charles Dickens Í 168 Anton Chekhov Í 165 Gustave Flaubert Í 163 Jane Austen Í 161 কিন্তু লিও টলস্টয়কে নিয়ে এত্তো কথা কেন বলছি? কারণ তার এই প্রবাদের তিনিই ছিলেন সর্বোত্তম উদাহরণ। জমিদারি দান করে গ্রামে একটি ছোট কুটিরে বাসা বাঁধলেন। নিজেই পানি তুলতেন, নিজেই নিজের জুতা পরিষ্কার করতেন। বাড়ি-ঘর-বাগান পরিষ্কার করতেন। সাধারণ মজদুরদের সাথে মিশে কাঠ কাটতেন, জমি চাষ করতেন। তাদের মতোই মোটা কাপড় পরতেন। নিজের বিছানাপত্র সাজাতেন, ঘরদোর ঝাড়– দিতেন এবং একটা সাধারণ ও আবরণহীন টেবিলে কাঠের বাসন থেকে কাঠের চামচ দিয়ে খাবার তুলে খেতেন। হ্যাঁ তার মুখেই মানায় এমন প্রবাদ; ÒEveryone thinks of changing the world, but no one thinks of changing himself.” নিজেকে ব্যাপক পরিবর্তন করার এই বিশ্বাস বা শক্তি তিনি কোথায় পেয়েছিলেন, কারণ তিনি যখন কাযান বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Kazan) ছাত্র তখন আরবি সাহিত্য নিয়ে অধ্যয়ন করেছিলেন। আর জীবনের শেষপ্রান্তে ইন্তেকালের সময়ও তার ওভারকোটের পকেটে যে বইটি পাওয়া যায় তার নাম হচ্ছে ÒThe Sayings of Muhammad (PBUH)” of Abdullah al-Suhraverdi printed in India in 1905. মুহাম্মাদ সা.-এর সরল সাদাসিধে জীবনই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছিলো লিউ টলস্টয়কে। অনেকেই ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন ৫০ বছর বয়সে খ্রিষ্টান হয়েই তিনি এত মহৎ হয়েছিলেন। কিন্তু আসল সত্য জানা যায় তার মহান উক্তিটি পড়লে। তিনি বলেছেন; ÒMuhammad has always been standing higher than the Christianity. He does not consider god as a human being and never makes himself equal to God. Muslims worship nothing except God and Muhammad is his Messenger. There is no any mystery and secret in it”Ñ Leo Tolstoy, The Prophet Muhammed's Words and Behaviour. আর এই টলস্টয়ের লেখা পড়েই আলোড়িত হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ১৯০৯-১০ পর্যন্ত সময়ে গান্ধী যখন লন্ডন এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় আসেন সে সময় অনেকটা ছাত্রের মতো সাতবার চিঠি যোগাযোগ করেছেন টলস্টয়ের সাথে। যা তরুণ গান্ধীর জীবন-যাপন ও ভবিষৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নির্ধারণে সহযোগিতা করেছিল। আবার এই গান্ধীর শিক্ষাই সংগ্রহ করেছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র তার ১৯৫৯ সালে ভারত সফরের সময়। নেলসন ম্যান্ডেলা এমনকি বারাক ওবামারও একই কথা । এ থেকে আমরা বুঝতে পারছি রাসূলের আদর্শ অর্থাৎ কুরআন হাদিস মানুষের ভিতর কী বিপুল পরিমাণ চিন্তা ও চরিত্রের পরিবর্তন আনতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যতিক্রম আছে সব জায়গায় এমনকি আমাদের দেশেও। ইদানীং ইসলাম ও মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে যেসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী খিস্তি-খেউর আওড়ান তাদের জ্ঞানের বহর দেখে যেন গাধাও লজ্জা পায়। হাল আমলে গাধাদের নিয়ে যেসব গবেষণা হচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে কিছু কিছ ক্ষেত্রে তাদেরও বেশ বুদ্ধিশুদ্ধি আছে; ভাবছি শেষতক চিহিহিহি রবে, ওরা প্রবল আপত্তি জানাতে পারে। আমার বিরুদ্ধে আন্দোলনেও নামতে পারে। কেন আমি এই সব বিবেকহীনদের গাধার সাথে তুলনা করলাম। এখানে এমন কিছু ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা করবো যাদের জ্ঞান, প্রতিভা ও যোগ্যতার বিচারে ঐসব গাধাধমরা (গাধার চাইতেও অধম) সেসব মনীষীর জুতা টানারও যোগ্য নয়। আব্দুল্লাহ মামুন আল সোহরাওয়ার্দী বিশ শতকের সূচনায় পাশ্চাত্যের বুকে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক মুসলিম যুবক ছিলেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে The Sayings of Muhammad (PBUH)” নামক বইটি প্রকাশ করেন। রাসূলের বাণী নিয়ে তার এ বইটি পাশ্চাত্যের বুকে প্রথম প্রকাশিত বই। এটি তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। এমনকি বইটি লিউ টলস্টয়ের মতো ব্যক্তিকেও প্রভাবিত করে। টলস্টয়ের কনিষ্ঠাকন্যা এবং পরবর্তীতে তার সেক্রেটারি আলেকস্জেন্ড্রা এক সাক্ষাৎকারে এই তথ্যের স্বীকৃতি দেন। আর টলস্টয়ের লেখনীতে প্রভাবিত হন ভারতের মহাত্মা গান্ধী। অতঃপর তার দ্বার প্রভাবিত হন আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, আমেরিকার মার্টিন লুথার কিং এমনকি বারাক ওবামা যাদের কমন পরিচয় তারা প্রত্যেকেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। এবার আসি সেই বিখ্যাত বই The Sayings of Muhammad (PBUH)”-এর লেখক আব্দুল্লাহ আল মামুন আল সোহরাওয়ার্দীর কথায়; তিনি একাধারে ছিলেন আল্লামা, ব্যারিস্টার, পিএইচডিসহ প্রায় ৭টি ডিগ্রির অধিকারী। তিনি আরবিতে বিএ অনার্স এবং এমএ। যারা ইংরেজি এবং দর্শন নিয়ে খুবই গদগদ তাদের বলছি স্যরি তিনি এ উভয় ক্ষেত্রেই এমএ এবং ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পিএইচডি। এবার দেখি কী আছে তার কুরসিনামায়? তার পিতা ওবায়েদুল্লাহ ওবায়েদ আল সোহরাওয়ার্দী যিনি বাগদাদের বিখ্যাত শাইখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীর অধস্তন পুরুষ, যিনি আব্দুল কাদের জিলানীর সঙ্গী ছিলেন। যার বংশধারা শুরু হয়েছে মূলত প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর সিদ্দিকী রা. হতে। সর্বাগ্রে তিনি টিপুসুলতানের সুযোগ্য নাতি প্রিন্স জালালুদ্দীনের সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর হুগলী মুহসীন কলেজের শিক্ষক ছিলেন যেখানে স্যার সৈয়দ আমীর আলী ছিলেন তার ছাত্র। অতঃপর ঢাকা মাদ্রাসার প্রথম সুপার হিসেবে জয়েন করেন। যেটি হাজী মুহাম্মদ মুহসীনের ফান্ডে প্রতিষ্ঠিত পরবর্তীতে এর নাম হয় কবি নজরুল সরকারি কলেজ। আর ১৮৭৭ সালে পিতার কর্মস্থল ঢাকা মাদ্রাসার সুপারের আবাসস্থলেই জন্ম হয় বড় ছেলে আব্দুল্লাহ মামুন সোহরাওয়ার্দীর। ছোট ছেলে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাসান সোহরাওয়ার্দী ১৮৮৪ সালে ঢাকায় জন্ম নেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ২য় মুসলিম এফআরসিএস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ভাইস-চ্যান্সেলর। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় মসজিদ ইস্ট লন্ডন মসজিদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং কার্যকরী কমিটির ২য় চেয়ারম্যান। তার একমাত্র কন্যা খুজাস্তা আখতার বানু ছিলেন ইন্ডিয়ার প্রথম মহিলা যিনি সিনিয়র ক্যামব্রিজ পাস করেন। তিনি ছিলেন কলকাতার জাস্টিস জাহিদ সোহরাওয়ার্দীর স্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মা। যিনি ছিলেন সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। আর কে না জানে এই সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকেই বাংলার কিংবদন্তিতুল্য রাজনীতিকরা শিষ্য হিসেবে দীক্ষা নিয়েছেন। বিশ শতকের সূচনায় ভারতের দিকপাল এইসব যুবক এমনকি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজে পর্যন্ত ছিলেন মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড এবং ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস এমনকি অ্যারাবিকের ছাত্র। এ থেকে এই সরল সত্যটিও প্রবলভাবে প্রকাশিত হয় যে, রাসূলের নির্দেশিত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে শুধু ইমাম বুখারী, ইবনে সিনা কিংবা জাবের ইবনে হাইয়ানদের জামানাতেই নয় বরং চলমান শতাব্দীতেও সময়ের স্রােতকে পাল্টে দেয়া যায়। বিশ্বনেতৃত্বের উদ্দাম ঘোড়ায় সওয়ার হওয়া যায়। উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি রাসূলের আদর্শ তথা কুরআন, হাদিস সম্পর্কে আমরা গভীর জ্ঞানার্জন করলে দুনিয়া-আখেরাতের সর্বোচ্চ সফলতা পাওয়া যাবে। আর এক্ষেত্রে রাসূল সা. হচ্ছেন সর্বোচ্চ মডেল। মুহাম্মাদ সা. সম্পর্কে আমরা কী জানি। তিনি দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেননি এথেন্সের অ্যাকাডেমি বা লাইসিয়ামে, পারস্য, ভারতে বা চীনে। তবু তিনি মানবজাতির সর্বোচ্চ শাশ্বত শিক্ষা ও সত্যের বাণী ঘোষণা করেছেন। নিরক্ষর ছিলেন তিনি। এবং নিজেই সেটি বিনয়ের সাথে ঘোষণা করতেন। কিন্তু এমন বাকপটুতা আর চমৎকার করে কথা বলতেন যা শুনে মানুষ কান্নায় ও উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়তো। আর তার প্রভাবেই শিক্ষা ও আত্মোন্নয়নের যে জোয়ার তৈরি হয়েছিল, যার তুলনা কেবল তিনিই। ফরাসি দার্শনিক শুধু নয় যাকে আধুনিক দর্শনশাস্ত্রের জনক বলা হয় সেই ডেকার্টে (René Descartes 1596–1650) বলেছেন ‘বিশ্বের সবচাইতে বিরল ও খাঁটি ধর্মপ্রচারক তিনিই।’ হিটলার তার মেইনক্যাম্প গ্রন্থে একই মত দিয়েছেন- ‘একজন মহান তাত্ত্বিক কদাচিৎ একজন মহান নেতা হতে পারেন।’ এই পৃথিবীতে কোন ব্যক্তির মাঝে যদি একাধারে তাত্ত্বিক, সংগঠক এবং নেতৃত্বের সম্মিলন হয় সেখানেই মহত্ত্ব নিহিত। ইসলামের নবীর মাঝে পৃথিবীর এই বিরল ও অনন্য সাধারণ গুণ পরিদৃষ্ট হয়েছে তার আপাদমস্তিষ্কে তার রক্তমাংসে। খ) যিনি ছিলেন শান্তির শ্রেষ্ঠ প্রতীক রাসূল সা. তার সারা দিনের শত ব্যস্ততার ভিতরও প্রতিদিন কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা আল্লাহর ইবাদতে কাটাতেন। তাই তিনি পেয়েছিলেন শান্তিময় জীবন। তার প্রচারিত আদর্শের নামও শান্তি। আমরা এখন কয়েকজন খ্যাতিমান মানুষের কষ্টের জীবন নিয়ে আলোচনা করবো। এক) পুরো নাম সুশান্ত সিং রাজপুত। এমনিতেই সুশান্ত শব্দটি শ্রুতিমধুর, সাথে ধর্মীয় ও রাজকীয় উপাধি মিলে এক কথায় বর্ণাঢ্য। মাত্র ৩৪ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে সে ১২টি ছবি এবং ৪টি টিভি-সিরিয়াল করে। সেগুলো থেকেই সে প্রায় ৬০ কোটি রুপি আয় করে। তার দৃশ্যমান তিনজন গার্লফ্রেন্ড ছিল। ছিল চাঁদে কেনা একটুকরো জমিও। কিন্তু ছিল না ছোট্ট একটি শব্দ শান্তি। বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে মুম্বাই পুলিশকে দেয়া ভাষ্যে তারই দুই চিকিৎসক জানিয়েছেন, সুশান্ত ‘বাইপোলার ডিজ-অর্ডারে’ ভুগছিলো। সঙ্গে ছিল অসম্ভব দুশ্চিন্তা-অনিদ্রাসহ একগুচ্ছ মানসিক অসুখ। তারা আরোও জানিয়েছে, সুশান্ত ওষুধ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো এবং বলতো তার সমস্যার সমাধান কোনো দিনই হবে না। ‘বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই’ চিকিৎসকদের এটিও জানিয়েছিলো সুশান্ত। শুধু সুশান্ত নয় গত ১০ বছরে ১২ জন বলিউড ফিল্মস্টার আত্মহত্যা করেন। ঢালিউডে কিছুটা কম হলেও হলিউডে নিজকে হত্যার হার আরও ভয়াবহ। এরও আগে মিডিয়া জগতের রাজপুত্র খ্যাত মাইকেল জ্যাকসন এবং তার শ্বশুর এলভিস প্রিসলি নিজেদের হত্যা করেন। দুই) আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (Ernest Miller Hemingway 1899 – 1961) সাগরের সাথে এক বৃদ্ধের সংগ্রামী বিজয়ের কাহিনী নিয়ে তার বিখ্যাত বই ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ লিখে পৃথিবীর শীর্ষ দুই পুরস্কার পুলিৎজার ও নোবেল প্রাইজ পান, কিন্তু মাত্র ৭ বছরের মাথায়ই আত্মহত্যা করে সবাইকে হতাশ করেন। তিন) জাপানের প্রথম নোবেল পাওয়া সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো একই বছরে জন্ম নেয়া ইয়াসোনারি কাওয়াবাতা (Kawabata Yasunari, 1899–1972) পুরস্কার প্রাপ্তির মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় আত্মহত্যা করেন। এই পৃথিবীর ২৯% স্থলভাগ বা বস্তুময় বাকি ৭১% পানি যা স্থির, এবং মনে করা হয় এই সাগরের পানি অনেকটাই মূল্যহীন। কিন্তু বিজ্ঞান আমাদের জানায় এই পানি ছাড়া জীবন অচল এবং আবহাওয়া একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তেমন শুধু খ্যাতির মোহ বা বস্তুগত জীবনই নয় তাদের শান্তি দিতে পারতো প্রার্থনা আর প্রার্থনা। আমরা রাসূলের জীবনে দেখি; এমনকি বদরযুদ্ধের সেই কঠিন মুহূর্তেও; যখন তিনগুণ বিশাল কাফের সৈন্যরা হামলে পড়েছে দুনিয়ার বুক থেকে তাদের চিরতরে মুছে দিতে। রাসূল সা. মুসলিমদের যুদ্ধের ময়দানে রেখেই আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় বসে গেলেন। আল্লাহপাক তাকে দিলেন চূড়ান্ত বিজয়। তাইতো মাইকেল এইচ হার্ট তার ১০ বছরব্যাপী গবেষণালব্ধ বই দ্য হান্ড্রেড এ বলেন, মুহাম্মাদই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ কারণ, তিনি জাগতিক ও পারলৌকিক উভয় জগতেই চূড়ান্তভাবে সফল হয়েছেন। রাসূল সা.-এর এই চূড়ান্ত সাফল্যের পিছনে অন্যতম কারণ হিসেবে পাওয়া যায় তার প্রার্থনার শক্তি। এমনকি বৈজ্ঞানিক থেকে রাজনীতিবিদ সবাই সাফল্যের জন্য এই প্রার্থনার শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর জীবৎকালের শেষভাগে মদিনা সমৃদ্ধ হয়েছিল। প্রত্যেক জায়গাতেই স্বর্ণ ও রৌপ্যরাজি পাওয়া যেত পর্যাপ্ত পরিমাণে। এই সমৃদ্ধির দিনেও আরবের এই অধিপতির পর্ণকুটিরে সপ্তাহের পর সপ্তাহ আগুন জ্বলেনি; এ সময় তাঁর খাদ্য ছিল দুটি জিনিস খেজুর ও পানি। তার পরিবার দিনের পর দিন না খেয়ে কাটিয়েছে। কারণ তাঁর ঘরে খাবার বলতে কিছু ছিল না। তিনি কোন কোমল বিছানায় রাত যাপন করেননি। দিনের ব্যস্ততার পরে রাতে খেজুরের মাদুরে শুতেন আর বেশির ভাগ রাতই কাটাতেন ইবাদাতে। তাঁর ¯্রষ্টার কাছে ইবাদাতকালে হঠাৎ তিনি অঝোরে কেঁদে উঠতেন আর বুকের ভিতর থেকে এমন আওয়াজ বের হতো যেন ডেকচির ভিতর পানি ফুটানো হচ্ছে। তাঁর জীবন সায়াহ্নে একমাত্র সম্পদ ছিল কয়েকটি মুদ্রা যার কিছু অংশ দিয়ে তাঁর দেনা শোধ করেছিলেন এবং বাকি অংশ তার দ্বারে আগত এক অভাবী লোককে দেয়া হয়েছিল। যে কাপড় পরিধানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তাতে ছিল অনেক জোড়াতালি। যে ঘরটি থেকে সারা বিশ্বে আলো ছড়িয়ে গেছে সে ঘরটিই ছিল সেদিন অন্ধকার। কারণ তাঁর ঘরের বাতিতে তেল ছিল না। কত শুদ্ধতম ব্যক্তি ছিলেন তিনি! তাঁর তুলনায় পৃথিবীতে আর কেউ আছে কি? গ) পরিবার তার জান্নাতের বাগান পরিবার হচ্ছে মানুষের জীবনে প্রথম রাষ্ট্র। আজকে আমাদের পরিবার মারাত্মক ঘুণেপোকার শিকার। পরিস্থিতি এই দেশেই এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, বাবা-ভাই কোন উপায় না পেয়ে মাদকাসক্ত ভাইকে খুন করে লাশ নালায় ফেলে দেয়। মা-খালা তন্ময় হয়ে ভারতীয় সিরিয়াল দেখছে এই ফাঁকে হামাগুড়ি দেয়া বাচ্চারা বাড়ির চৌহদ্দি পার হয়ে পুকুরে গিয়ে পড়েছে। অতঃপর ডুবুরি নামিয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। দামি মোটরসাইকেলের দাবিতে ঘরে আগুন দিয়ে পিতা-মাতাকে পুড়িয়ে মারছে। এর ঔষধ হিসেবে চালু হয়েছে ব্যাপক ও ব্যয়বহুল প্যারেন্টিং কোর্স। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্যারেন্টিং কোর্স কোনটি আমরা কি সেটি জানি? সেটি হচ্ছে রাসূল সা.-এর জীবন বা লাইফ অব প্রোফেট মুহাম্মাদ সা.। মানুষ-এর আরবি প্রতিশব্দ হচ্ছে ইনসান যা উনুস ধাতু থেকে উদ্ভূত। উনুস এর অর্থ : প্রেম-ভালোবাসা, কল্যাণ কামনা, সেবা। তাই মানব প্রেম, ভালোবাসা, সেবা ও কল্যাণই হচ্ছে ইনসানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর ইনসানে কামেল বা সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে মুহাম্মাদ সা. তার খালেক এবং সকল মাখলুকের জন্য প্রেম ও ভালোবাসার সাগর হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। আর তাই স্বয়ং রাহমানুর রাহিম তার হাবিবের পরিচয় দিয়েছেন এই বলে, “আমরা তোমাকে দুনিয়াবাসীদের জন্য রহমত হিসেবে পাঠিয়েছি।” (সূরা আম্বিয়া : ১০৭) বিশ্বপ্রেমিক রাসূলের দিকে তাকালে দিবালোকের মতোই স্পষ্ট হয়ে যায় আজকের মানুষের প্রেম-ভালোবাসা কতই না সঙ্কীর্ণ। আমরা পরিবার বিশেষত শিশুদের প্রতি রাসূল সা.-এর গভীর ভালোবাসার দিকটিই আজকে বিশেষভাবে আলোচনা করবো। তার পারিবারিক এবং বাইরের জীবনের মাঝে আশ্চর্যরকম সঙ্গতি ছিল। যেটি খুব কমই পাওয়া যায়। মক্কা বিজয়ের পর দশ লক্ষ বর্গমাইলেরও অধিক জমি তাঁর পদানত ছিল। আরবের অধিপতি হয়েও তিনি গৃহস্থালি কাজে স্ত্রীকে সহযোগিতা করতেন। নিজের জুতা ও কাপড় নিজেই সেলাই করতেন। তিনি নিজ হাতে ছাগদুগ্ধ দোহন করতেন, উননের চিমনি পরিষ্কার করতেন, আগুন জ্বালাতেন এবং অন্যান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত থাকতেন। ১. পিতা হিসাবে ভূমিকা হযরত নবী সা. সাতজন পুত্র-কন্যার অধিকারী হয়েছিলেন কিন্তু একমাত্র ফাতেমা ছাড়া আর বাকি সবাই তার জীবদ্দশাতেই ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ফাতেমাকে খুবই ¯েœহ করতেন। প্রায়ই বলতেন, ‘ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা’। কোন সফরে যাওয়া বা আসার পথে তিনি ফাতেমার সাথে দেখা করতেন। কখনও ফাতেমা এসে কাছে হাজির হলে হুজুর সা. উঠে দাঁড়িয়ে যেতেন, তার কপালে চুমু খেতেন। আসন থেকে সরে নিজের জায়গায় বসাতেন। হযরত আনাস রা. বলেন, “আমি হুজুর সা.-এর চাইতে অধিক আর কাকেও সন্তানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতে দেখিনি। পুত্র ইবরাহিম শহরের উপকণ্ঠে তিন চার মাইল দূরে লালিত-পালিত হচ্ছিলেন। হুজুর পায়ে হেঁটে সেখানে যেতেন। দাই-এর ঘরে গিয়ে শিশুকে কোলে তুলে নিতেন, তার মুখে চুমু খেতেন।” পুত্র হযরত ইবরাহিমের মৃত্যুর সময় হুজুর সা.-এর পবিত্র চোখ অশ্রুপ্লাবিত হয়ে উঠেছিল। কান্নাভেজা কণ্ঠেই বলেছিলেন, “চোখ অশ্রুবর্ষণ করছে, অন্তর শোকে অভিভূত কিন্তু মুখে তাই বলব আল্লাহ পাক যা করেন।” উম্মে কুলসুমের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি কাঁদতেন। নাতীদের তিনি সীমাহীন ¯েœহ করতেন। তাদের বুকে জড়িয়ে বলতেন, “এরা হচ্ছে জান্নাতের ফুল।” ফাতেমার ঘরে গিয়ে রাসূল সা. বলতেন, আদরের ধনেরা (হাসান-হোসেন) কোথায়? তারা সামনে এলেই আবেগাতিশয্যে তিনি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতেন। একবার মসজিদে খুতবা দেয়ার সময় হাসান-হোসেন লাল জামা পরে কম্পিত পায়ে নানার দিকে এগিয়ে এলেন, রাসূল সা. আর থাকতে পারলেন না খুতবা স্থগিত রেখে তাদের কোলে তুলে সামনে এনে বসিয়ে অতঃপর খুতবা শুরু করলেন। একবার হুজুর সা. হাসান-হোসেনকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছেন। পথে একজন রসিকতা করে বললেন আহা ! কী বাহনইনা পেয়েছে, হুজুর সা. জবাব দিলেন, ‘আরোহীরা কে তাওতো দেখবে।’ একবার শিশু হাসান শায়িত হুজুর সা.-এর পবিত্র পায়ের ওপর পা রেখে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, “উপরে উঠে এসো।” রাসূল সা. তাকে জড়িয়ে ধরে মুখণ্ডলে চুম্বন করলেন এবং বললেন, “হে আল্লাহ আমি একে মহব্বত করি, তুমিও একে মহব্বত করো।” সাহাবা আবু কাতাদা বলেন, ‘‘একদিন আমরা দেখলাম উমামা নামক এক নাতনীকে কাঁধে নিয়েই তিনি নামাজ পড়লেন।” ২. দায়িত্বশীল হিসাবে তাঁর ভূমিকা তিনি অন্যান্য শিশুদেরও খুবই ভালবাসতেন, তাদের কোলে তুলে নিতেন। চুমু খেতেন, সুন্দর নাম রাখতেন। মুখে খেজুর চিবিয়ে দিতেন। সফর থেকে ফেরার পরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের উটের আগপিছে বসাতেন। তাদের সাথে কৌতুক করতেন। ভারতের বিখ্যাত ব্রিটিশ মানবতাবাদী এ্যানি বেসান্ত লেখেন, “রাস্তা দিয়ে যখন মুহাম্মাদ যেতেন তখন ছেলেমেয়েরা দৌড়ে আসতো তাদের দুয়ার থেকে। জড়িয়ে ধরতো তাঁর হাটু তাঁর হাত।” রাসূল সা. নিজেও এতিম ছিলেন আর এতিমদেরকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। এবং বেহেশতেও তাদের দেখার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করছেন। ৩. শিশু অধিকার ও ইসলাম বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আবু সাঈদ মুহাম্মদ আব্দুল হাই-এর লেখায় আমরা পাই, ইসলাম শিশুদের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, শিশুরা হচ্ছে বেহেশতের সুন্দর পতঙ্গ। সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার ভালোবাসার টান প্রাকৃতিক বিধান। এ বিধানের কারণেই বিড়াল তার বাচ্চাকে সুরক্ষিত স্থানে মুখে করে নিয়ে যায়। মুরগি নিজে না খেয়ে তার বাচ্চাকে খেতে দেয়। জঙ্গলের পশু-পাখি নিজ নিজ বাচ্চাকে আক্রমণকারীদের থেকে সুরক্ষা করে থাকে। পানির মাছ আপন সন্তানকে পাহারা দিয়ে চলে। সৃষ্টি জগতের সেরা হচ্ছে মানুষ। খলিফার মর্যাদায় আসীন মানুষের স্ত্রী ও সন্তান কিরূপ হবে তার একটি চিত্র আমরা কুরআন মজিদে দেখতে পাই। সুসন্তান কামনায় আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার জন্য আল্লাহ আমাদের এভাবে বলতে শিক্ষা দিয়েছেন, “হে আমাদের রব! আমাদের এমন স্ত্রী ও সন্তান দান কর যারা হবে আমাদের জন্যে নয়ন প্রীতিকর।” এরূপ সন্তান সম্পর্কে রাসূল সা. বলেন, “সৎ সন্তান বেহেস্তের ফুল।” ৪. শিশু-প্রেমিক মুহাম্মাদ সা. রাসূলুল্লাহ সা. শিশুদের সীমাহীন ভালোবাসতেন, তাদের আগে সালাম দিতেন। বাইরে থেকে মদিনায় প্রবেশকালে শিশুদের দেখতে পেলে নিজের উট বসিয়ে তাঁর সামনে-পেছনে তাদের বসাতেন। তিনি শিশুদের কান্না মোটেই পছন্দ করতেন না। একবার তাঁর কানে হোসেনের কান্নার আওয়াজ এলো। এতে তিনি ব্যথিত হয়ে ফাতেমা রা.-কে ডেকে বললেন, “তুমি কি জান না, তার কান্না আমাকে কষ্ট দেয়?” কোন শিশুর কান্না শুনতে পেলে তিনি নামাজ সংক্ষিপ্ত করে নিতেন। তিনি বলতেন, “আমি শিশুর মাকে কষ্ট দেয়া পছন্দ করি না।” রাসূলুল্লাহ সা. হাসান ও হোসেনকে নিজের পিঠে চড়িয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলতেন যেন তারা ঘোড়ায় চড়ার আনন্দ অনুভব করে। নামাজে তিনি সিজদায় গেলে হাসান, হোসেন ও হযরত জয়নাবের কন্যা উমামা তাঁর পিঠে ও ঘাড়ে উঠে বসে থাকতেন। তিনি সিজদা দীর্ঘ করে নিতেন যাতে তাদের তাড়াতাড়ি নামতে না হয়। বিয়ের পর হযরত আয়েশা রা.-কে তাঁর অন্য সইদের সাথে কনে খেলা খেলতে উৎসাহিত করতেন। শিশুদের অবস্থানের কারণে আল্লাহ কোনো জাতির প্রতি শাস্তি ত্বরান্বিত করেন না। যেমন রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, “যদি দুধের শিশুরা, বুড়োরা এবং গৃহপালিত পশুরা না থাকত, তবে অচিরেই তোমাদের ওপর কঠিন শাস্তি নেমে আসত।” রাসূলের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই জনৈক মনীষী বলেন, “আমাদের সন্তানেরা আমাদের জীবনের চারাগাছ, আমাদের আশা-আকাক্সক্ষার ফল এবং আমাদের চোখের প্রশান্তি।” ঘ) সর্বোত্তম সমাজপ্রণেতা ময়দানে এমন অনেক কমরেড পাওয়া যায় অর্ধাঙ্গিনীর কাছে তার নিজের রেট খুবই কম। জগতে এমন অনেক দরবেশও আছেন স্ত্রী-সন্তানের কাছে তিনি ¤্রয়িমাণ। এদিক থেকে রাসূল সা. বিরলতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন । তার তুলনা কেবল তিনিই। আমরা লক্ষ্য করি, মুহাম্মাদ সা. এর জীবনের ২৫ থেকে ৪০ বয়সে বিবাহিত সময়কালে তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে ধনাঢ্য মহিলা খাদিজা রা. তার চেয়ে ১৫ বছরের ছোট স্বামীর প্রতি কী সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন। নবীর প্রতি শ্রদ্ধার গুরুত্বটি বুঝা যায়। কিন্তু নবী হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কারণ কী? তার মহৎ ও পূত-পবিত্র চরিত্র যা প্রকাশ পেয়েছে তার পারিবারিক, সামাজিক এবং ব্যবসায়িক কর্মক্ষেত্রে। বিখ্যাত লেখক ও গবেষক মোহাম্মদ আব্দুল করিম খান সংকলিত “বাংলায় বোখারী শরীফ হাদিসসমূহ” বইটির ঈমান অধ্যায়ে ২য় হাদিসটি যেটি বর্ণিত হয়েছে আয়েশা রা. থেকে তাতে বলা হয়েছে, প্রথম ওহি নাজিলের পর হযরত বুঝতে পারলেন তার উপর বড় কোন দায়িত্ব আসছে তাই তিনি বিচলিত হয়ে বলিলেন, “আমার ভয় হচ্ছে আমার জীবনে কুলাইবে কিনা, আমার শরীরে সহ্য হইবে কিনা?” তখন তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্না বিবি খাদিজা রা. রাসূল সা.কে সান্ত¡না দিয়ে বলিলেন, “খোদার কসম, কিছুতেই নয়, আল্লাহ আপনাকে কিছুতেই অপদস্থ করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করবেন- আপনাকে জয়যুক্ত করবেন। কেননা, মানবতার উৎকর্ষের মূল সাতটি গুণাবলি যথা; ১) আত্মীয় স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করিয়া আত্মীয়তার হক আদায় করা। ২) সত্যবাদিতা ৩) সকল ক্ষেত্রে বিশ্বাসী আমানতদার হওয়া ৪) এতিম, বিধবা, অন্ধ, খঞ্জ তথা অক্ষমদের খাওয়া, পরা ও থাকার বন্দোবস্ত করা ৫) বেকার সমস্যার সমাধান করে দেওয়া ৬) অতিথিপরায়ণতা ৭) প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্ষেত্রে দুস্থ জনগণের সাহায্যে জীবন উৎসর্গে প্রস্তুত থাকা- আপনার মধ্যে রহেছে।” খাদিজা রা. এরূপ সান্ত¡না দিয়ে রাসূল সা.কে সাথে নিয়ে বংশের মুরব্বি চাচাতো ভাই ওয়ারাকা বিন নওফেলের নিকট গেলেন। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘ইসলাম হচ্ছে তাই যা স্পেনকে সুসভ্য করেছে, মরক্কোতে আলোর মিশন নিয়ে গেছে এবং পৃথিবীতে সৌভ্রাতৃত্ববোধ দৃঢ়ভাবে প্রচার করেছে।’ বাস্তবিকভাবে সেই মহাপুরুষের ছোঁয়ায় যারা বড় হয়েছেন তাঁরাও ছিলেন সোনার মানুষ। খলিফা উমর, নবী জামাতা খলিফা আলী, খলিফা মনসুর, খলিফা মামুনের পুত্র আব্বাস এবং এ ছাড়া অনেক খলিফা ও শাসক ইসলামের বিচারালয়ে সাধারণ লোকের মতই হাজির হয়েছেন। আমরা জানি আজকের সভ্য শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে কেমন ব্যবহার করছে। অপর দিকে রাসূল সা. চিকন ঠোঁট ও কালো দেহের অধিকারী কাফ্রি দাস বিলালকে ইসলাম জগতের সবচেয়ে পবিত্রতম ঐতিহাসিক স্থান কাবার ছাদে আজান দেয়ার দায়িত্ব দেন। তার সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য সম্ভ্রান্ত কুরাইশদের তিনি আহ্বান করেন। অর্ধজাহানের খলিফা উমর রা. বিলালের রা. পরিচয় দিতেন এভাবে- ‘এইতো আমাদের শিক্ষক এবং নেতা আসছেন।’ ইসলামের গণতান্ত্রিক তাৎপর্য একইভাবে নারীকে পুরুষের দাসত্বের নাগপাশ থেকে মুক্তি দিয়েছে। স্কটিশ রাজপরিবারের সদস্য স্যার আর্চিব্যাল্ড হ্যামিল্টন বলেছেন, ইসলাম মানুষকে সহজাত নিষ্পাপ হওয়ার শিক্ষা দেয়। ইসলামের শিক্ষা নারী-পুরুষ এরা একই আত্মার অধিকারী। বুদ্ধিমত্তা, আধ্যাত্মিকতা এবং নৈতিকতা সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সামর্থ্যই উভয়ের সমান রয়েছে। ১৪ শত বৎসর আগে ইসলাম নারীকে দিয়েছে সম্পত্তির ওপর অধিকার। যদিও এর ১২ শত বৎসর পর ১৮৮১ সালে যে ইংল্যান্ড ইসলামের আইন অবলম্বন করে বিবাহিত মহিলাদের আইন নামে এটি প্রণয়ন করেছে। নবী সা. এমন পরমপুরুষ ছিলেন বলেই সাহাবারা তাঁকে জীবন দিয়ে ভালোবাসতেন। সুমাইয়া ছিলেন একজন নির্দোষ স্ত্রীলোক, যাকে বর্বরোচিতভাবে বর্শার আঘাতে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছিল। তাঁর স্বামী ইয়াসিরকে তার দুই পা দুই উটের সাথে বেঁধে সেগুলোকে দু দিকে পরিচালিত করা হয়েছিল। খাব্বাব বিন আরদকে জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর শুইয়ে দিয়ে তার বুকের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচারীরা তাদের পা চেপে ধরতো এতে তার চামড়ার নিচের চর্বি গলে যেত। ঠিক এমনিভাবে বিলালকে সারাদিন আগুনের মত গনগনে মরুভূমিতে পাথর চাপা দিয়ে শুইয়ে রাখা হতো। কিন্তু তবু তারা নবীর সঙ্গ ত্যাগ করতে রাজি হননি। তাইতো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা বলেছে, ‘মুহাম্মাদ হচ্ছেন সকল নবী ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের তুলনায় সবচেয়ে সফল ব্যক্তিত্ব।’ ঙ) রহমতে আলম, জানে তা সারা দুনিয়া একই সাথে নোবেল ও অস্কার বিজয়ী মানুষ পৃথিবীতে মাত্র ২ জন। একজন ববডিলান এবং অন্যজন মানবতাবাদী জর্জ বার্নার্ড শ’। সেই প্রাজ্ঞপুরুষ বার্নার্ড শ’ দৃঢ়তার সাথে বলেন, were to assume the dictatorship of the modern world he would succeed in solving its problems in a way that would bring in the much needed peace and happiness ‘অর্থাৎ আমি প্রগাঢ় প্রত্যয় পোষণ করি যে মুহাম্মাদ সা.-এর মত কোনো মানুষ যদি মানবমণ্ডলীকে পরিচালিত করার জন্য বিশ্বনেতৃত্বের আসনে সমাসীন হন। তাহলেই আজকের বিরাজিত জটিল বিশ্ব-সমস্যার সমাধান করে মানবমণ্ডলী যাতে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হতেন।’ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও পৃথিবী যত দ্রুত বুঝবে এই মহাসত্য তত দ্রুতই কল্যাণ ও শান্তির সীমাহীন ফল্গুধারায় তারা শামিল হতে পারবে। চ) সাফল্যই যার সিংহাসন ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জগতে সাফল্য অর্জন মহামানবদের জীবনেও এক আকাশচুম্বী বিষয়। ডেল কার্নেগির ‘দুশ্চিন্তাহীন নতুন জীবন’ বইটি পড়েননি এমন শিক্ষিত মানুষ বর্তমান জামানায় পাওয়া কঠিন। সেই প্রত্যয়দীপ্ত মানুষটিও আত্মহত্যা করেছিলেন বলে জোর গুজব আছে। ভারতের সবথেকে সেরা আন্তর্জাতিক মোটিভেশনাল বক্তা শিব খেরা তার বিখ্যাত বই ‘ইউ ক্যান উইন’ যা প্রায় ৩০ লক্ষ কপির অধিক বিক্রি হয়েছে। তিনি ২০০৪ সালে দক্ষিণ দিল্লিতে দাঁড়িয়ে গেলেন এমপি পদে। তারপর ফলাফল গো-হারা! পেলেন তৃতীয় স্থান। কিন্তু হায়! জামানত বাজেয়াপ্ত!! ভোট পেলেন মাত্র সাকুল্যে ১%! যেমন, আলেজেন্ডার দি গ্রেট। আড়াই হাজার বছরব্যাপী তার নাম পৃথিবীময়। তিনি মাত্র ২৫ বছর বয়সে রাজা হন। পরবর্তী ৮ বছরে ১১,০০০ মাইল অভিযান পরিচালনা করে ৩৫ লক্ষ মানুষের লাশের স্তূপ ঠেলে পৃথিবীর ৩টি মহাদেশের ৭০টি প্রধান শহর জয় করে, ২০ লক্ষ বর্গমাইল সা¤্রাজ্য স্থাপন করেন। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই যখন অজ্ঞাত কারণে ইন্তেকাল করেন তার সা¤্রাজ্য তাসের ঘরের মতোই হারিয়ে যায় এমনকি তার লাশটিও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। কেউ জানে না তার শেষ সমাধিটা আজ কোথায়। তার বংশ এমনকি কোন অনুসারী পর্যন্ত পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যায় না। চেঙ্গিস খাঁ পৃথিবীতে ছিল এক দাবানলের নাম। প্রায় ৪ কোটি মানুষের রক্তের গঙ্গা ও লাশের পাহাড় তৈরি করে ৯০ লক্ষ বর্গমাইলের সা¤্রাজ্য স্থাপন করেন। এরপর ১২২৭ সালে অজ্ঞাত কারণে মারা যান। গত ৮০০ বছরে তার লাশটি পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনুসারীতো দূরের কথা তার নামে কেউ নামও রাখে না। আর ওদিকে মুহাম্মাদ সা. যার ব্যাপারে বিস্ময়কর মন্তব্য করেছেন ব্রিটিশ রাজের গুরুত্বপূর্ণ সম্মানপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সেরা ক্রিকেটার বোসওয়ার্থ স্মিথ- ‘দেশের-প্রধান এমনকি চার্চেরও (উপাসনালয় বুঝিয়েছেন) প্রধান! তিনি একাধারে সিজার ও পোপ। পোপের হুংকার ছাড়াই তিনি ছিলেন পোপ এবং সিজারের বিরাট সেনাবাহিনী ও রাজত্ব ছাড়াই তিনি সিজার। যদি আজ পর্যন্ত কোন লোক দাবি করেন যে তিনি সঠিক এবং স্বর্গীয়ভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তিনিই হচ্ছেন মুহাম্মাদ। তাদের এ সকল সমর্থন ছাড়াই তিনি সকল ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু তিনি ক্ষমতা প্রদর্শনের তোয়াক্কা করতেন না।’ ছ) উপসংহার কার্ল মার্কস, হেগেল, মাও সেতুং পৃথিবীকে কাঁপিয়েছেন কতো নেতা। কিন্তু ভালোবেসে কয়জনে তাদের নামে নিজের বা সন্তানের নাম রাখে? অপরদিকে পৃথিবীর ১৬০ কোটি মুসলিমের ভিতর কমপক্ষে ৬০-৭০ কোটি জন তাদের নামের আগে তাদের প্রিয় নেতা মুহাম্মাদকে স্থাপন করেছে। নামটি পুরুষবাচক বিধায় নইলে বাকি অর্ধেক মুসলিম মহিলারাও এ বরকত থেকে বঞ্চিত হতো না। পৃথিবীর ২০ লক্ষাধিক মসজিদে প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত আজানে কমপক্ষে ২ কোটি বার এই মহামনীষীর নাম সু-উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত হয়। সারা পৃথিবী নানা টাইম জোনে বিভক্ত। তাই সারাদিনে এমন কোন মিনিট বা সেকেন্ড পাওয়া যাবে না যখন বুলন্দ আওয়াজে পৃথিবীর আকাশ-বাতাস মুহাম্মাদ সা.-এর নাম উচ্চারিত হচ্ছে না। বিশ্বনেতা সর্বোত্তম মানব মুহাম্মাদ সা. ও তার প্রচারিত আদর্শ ইসলামকে লিউ টলস্টয় চিনলেন, বার্নার্ড শ’ চিনলেন, চিনলেন মাইকেল এইচ হার্টসহ হাজারো অমুসলিম। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য যাদের নামের শুরুতেই তাদের পরম শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা ভালোবেসে মুহাম্মাদ নামটি জুড়ে দিলেন এবং সুন্দর একটি ইসলামী নাম রাখলেন। আমরা সেই মুসলিমরা সত্যিকার রূপে নিজেদের নবী ও তাঁর আদর্শকে চিনতে ও অনুসরণ করতে কেন পারছি না। এখনও সময় আছে, যদি আমরা সেটি পারি তবে এই সর্বাধুনিক কালেও আমরাই হতে পারি বিশ্বের নিয়ন্তা আর এ পৃথিবী হতে পারে মহাবিশ্বের ভিতর পরম-শান্তির এক স্বর্ণোদ্যান। হে পরম প্রভু, রাসূল সা. ও তাঁর প্রচারিত আদর্শ ইসলামকে চেনার এবং তাকে সঠিকভাবে অনুসরণ করার তৌফিক আমাদের দান করুন। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির