post

দেশে জঙ্গিবাদ ও বাস্তবতা আমাদের করণীয়

মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

০১ মে ২০১৭
জঙ্গি ইস্যুটি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। কেউ কেউ বলছেন দেশে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিসংগঠন আইএসআই বীজ বুনেছে। যে কারণে একের পর এক অঘটন ঘটছে। আবার সরকার পক্ষ বলছে দেশে আইএসআই নেই; তবে তার আদলে নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ জঙ্গি ইস্যুটি সরকারের সৃষ্টি বলেও মন্তব্য করছেন। আমজনতার মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের ঠিক আগ মুহূর্তে, জঙ্গিবিরোধী অভিযান আইওয়াশ মাত্র। কারণ আওয়ামী সরকার এই অভিযানের মাধ্যমে জনগণের সামনে ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে চেয়েছে। গত মার্চ মাসের শেষার্ধে সপ্তাহব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বহুসংখ্যক হতাহতের ঘটনায় সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত। কারণ যারা জঙ্গি বলে পরিচিত তারা কেউ জীবিত গ্রেফতার হচ্ছে না। নেহাত গ্রেফতার হলেও তাদের সম্পর্কে সরকারের তরফ থেকে তেমন কোনো তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করছে না। জঙ্গি বলে যারা নিহত হচ্ছে, তাদের পরিচয় পত্র-পত্রিকায় যতটুকু বিবরণ পাওয়া যায় তাতে তাদের অতীত বলে না যে, তারা এমন সাঙ্ঘাতিক কিছুর সাথে জড়িত ছিল। অনেকের স্বজনরা দাবি করেছেন যে, তাদের প্রিয়জনদেরকে কে বা কারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডিও করা হয়েছে! তাছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে গুম খুনের ঘটনা প্রতিদিন খবরের শিরোনাম হচ্ছে। তবে কারা এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটাচ্ছে এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে কোনো সদুত্তর মিলছে না। রাষ্ট্রের শাসক দলের ছত্রছায়ায় সরকারদলীয় সমর্থক সংগঠন বিরোধী সংগঠনের নেতাকর্মীদের হত্যা এবং সরকারদলীয় অন্তঃকোন্দলে হতাহতের ঘটনা ঘটছে হরদম। অনেকে এহেন কার্মকান্ডকেও জঙ্গিপনা বলে অভিহিত করছেন। এ ধরনের ঘটনা সংঘটনের পর প্রকৃত দোষীদের অনুসন্ধান না করে সরকার বিরোধী দলসমূহের ওপর হরহামেশা দোষ চাপিয়ে দিচ্ছে। এমন দোষাদোষীর কারণে আসল সত্যটি ধামাচাপা রয়েই যাচ্ছে। তাই প্রকৃত সত্য উপস্থাপনের লক্ষ্যে নিজের উপলব্ধি থেকে আজকের দু’ কলম লিখা। জঙ্গি শব্দটি অতি পরিচিত। জঙ্গ শব্দটি ফার্সি শব্দ। উর্দু ও ফার্সিতে শব্দটি লড়াই বা যুদ্ধ অর্থে ব্যবহৃত হয়। জঙ্গ মানে যুদ্ধ আর জঙ্গি মানে যোদ্ধা, লড়াকু। ইংরেজিতে ‘মিলিট্যান্ট’। ফার্সি ও উর্দুতে এটি পজেটিভ শব্দ। নিজেদের অধিকার আদায়ের নিমিত্তে যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় বা যারা অবিচার-অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তবে গোটা দুনিয়াতে এরা নিজেদেরকে মুক্তিকামী দাবি করলেও সরকারিভাবে তাদেরকে জঙ্গি হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। যেমন কাশ্মিরের জনগণ স্বাধীন ভূখন্ড অর্জনের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রেখেছে, যদিওবা তারা ভারত সরকারে চোখে ‘আতঙ্কবাদী’। আবার বাংলাদেশী জনগণ পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছিল পাকিস্তান স্বৈরশাসকের দৃষ্টিতে দেশদ্রোহী। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানরা তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করছে। মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিতে এরা জঙ্গি। এ ধরনের একটি পজেটিভ শব্দ আমাদের দেশে নেগেটিভ সেন্সে ব্যবহৃত হয়। এখানে জঙ্গি মানে যারা আকস্মিকভাবে কারো উপর হামলে পড়ে। জনজীবনকে বিষিয়ে তোলে, উগ্রতার মাধ্যমে এক ভয়াল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যারা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। যাদেরকে সবাই বিপজ্জনক বলে মনে করে। এদের মধ্যে কোন গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ হাসিলের নিমিত্তে লড়াই করে আবার কোন গোষ্ঠী পর্দার অন্তরালের কোন দেশী-বিদেশী অপশক্তির হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের দেশে হয়েছেও তাই। সম্প্রতি জঙ্গি বা মিলিট্যান্ট শব্দটির অপব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সারা দুনিয়াতে মুসলমানদের পেছনে এই শব্দটি জুড়ে দিয়ে ইসলামভীতি ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মুসলমানদেরকে সংঘটিত সকল অঘটনের মূল হিসেবে চিত্রায়িত করা এবং দাড়ি, টুপি, পাগড়ি ও হিজাব ধারীদেরকে আতঙ্ক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের জঙ্গি বা আত্মঘাতী দলের সদস্য বলে অভিহিত করা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের নিকট জেহাদি বা উসকানিমূলক বই পাওয়ার দাবি করা হচ্ছে। এটি মুসলমানদের নামে জঙ্গি তকমা লাগানোর ষড়যন্ত্রের অংশবিশেষ বলে মনে হয়। কারণ আমাদের দেশে সরকারিভাবে যে জঙ্গি পরিচয়ের ধারণা জাতির সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে তা যদি সত্যিই হয়েও থাকে তাহলে এর সাথে ইসলাম ও মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম কারো উপর জবরদস্তি মূলকভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার জিনিস নয়, যা রাসূল (সা) তাঁর জীবদ্দশায় তিনি করেননি। ইসলাম হলো শাশ্বত জীবনবিধানের নাম। কুরআনের ভাষায় ‘ইন্নাদ দ্বীনা ইনদাল্লাহিল ইসলাম’ নিশ্চয় ইসলাম আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত ধর্ম। ইসলাম মানুষের প্রকৃতজাত ধর্ম। অসি নয়, মসিতেই ইসলামের বিজয় হয়েছে। রাসূল (সা) কখনো কোন যুদ্ধে নিজে থেকে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করেননি, যতক্ষণ না নিজে আক্রান্ত হন। মানুষকে ইসলামাইজ করেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ফিতনা (অর্থ প্রলোভন, দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ, শিরক, ধর্মীয় নির্যাতন ইত্যাদি) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর। (সূরা বাকারা : ১৯১) অকারণে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হওয়া ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। আমাদের দেশে যারা প্রতিনিয়ত সামাজিক অনাচার সৃষ্টি করে যাচ্ছে তাদেরকে প্রচলিত দেশীয় অর্থে প্রকৃত ফেতনাবাজ বা জঙ্গি বললে অত্যুক্তি হবে না। সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান অত্যন্ত সুস্পষ্ট। হত্যাকারীর স্থান হবে জাহান্নামে উল্লেখ করে কুরআনে বলা হয়েছে, “কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে স্থায়ী হবে।” (সূরা নিসা : ৯৩) বিনা কারণে মানুষ হত্যার কোনো সুযোগ নেই “নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা ব্যতীত কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল।” (সূরা মায়িদা : ৩২) অশান্তি সৃষ্টি করতে নিষেধ করে আল্লাহ তায়ালা কুরআনে নির্দেশ দিয়েছেন, “দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।” (সূরা আরাফ : ৫৬) যারা পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে বেড়ায় তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে লা’নত এবং মন্দ আবাসের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে। (সূরা রা’দ : ২৫) রাসূল (সা) রক্তপাত সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, “কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফায়সালা হবে তা হলো, রক্তপাত বা হত্যা সম্পর্কিত।” (বুখারি : ৬৩৫৭) একদল জঙ্গি, উগ্রপন্থী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তখন তৈরি হয় যখন রাষ্ট্র বা কোনো বিশেষ শক্তি স্বীয় উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে তাদের নেপথ্যে শক্তি হিসেবে কাজ করে। রাষ্ট্রীয় মদদে যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তারা সরকার পক্ষের উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেই সুবাদে তাদের অবৈধ কর্মকান্ডকেও রাষ্ট্র বৈধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তখন রাষ্ট্রের অবস্থা এতখানি ভঙ্গুর হয় যে, তাদের সংঘটিত অপরাধ কোনো আইন আদালতের কাছেও অবৈধ বলে বিবেচিত হয় না। যাদের জন্য সাত খুন মাফ। যেহেতু তারা সরকারি লোক। গণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক উভয় রাষ্ট্রে উগ্রবাদের জন্ম হয়। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকরা যখন তাদের মত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে না, সুশাসন থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের মত প্রকাশ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়। যখন অহেতুক সাধারণ মানুষের ওপর দমন-পীড়ন চলে তখন দেশের স্বাধীনচেতা মানুষের একটি অংশও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে, নানা উগ্র-কীর্তি কান্ডের মাধ্যমেও তাদের মত প্রকাশ করতে চেষ্টা করতে পারে। ক’বছর ধরে দেশে জঙ্গি তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাধারণত আলেম-ওলামা ও যুবসমাজের একাংশ এমন কাজে জড়িত বলে খবরে প্রকাশ হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে কারা জঙ্গি? সরকারের তরফ থেকে তাদের ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য জাতির সামনে খোলাসা করছে না। কারণ জঙ্গি হিসেবে যাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে তাদের অধিকাংশ ব্যক্তিকে হত্যা করা হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্য মতে কথিত জঙ্গিরা অত্যন্ত বিপজ্জনক, তাদের সাথে গোলা বারুদ ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকার কারণে তাদের জীবিত গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। বিষয়টি যদি সত্যিও হয়ে থাকে তা হবে দেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। তবে প্রশ্ন উঠেছে সারা বছর জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনের কথা সরকারপ্রধানসহ সরকারের তরফ থেকে বলা হলেও ঠিক প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের প্রাক্কালে জঙ্গি দমনের বিষয়টি জোরালো হয়ে ওঠার হেতু কী? আর কেনইবা একের পর এক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান মিলছে? দেশের গোয়েন্দা বাহিনী কি এসব বিষয়ে একেবারেই বেখবর? নাকি এই ইস্যুটি বিরোধী দলের আন্দোলন দমনের জন্য ট্রাম্পকার্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে? এসব কারণে জঙ্গি ইস্যুটি নিয়ে সমগ্র দেশবাসী ধোঁয়াশার মধ্যে রয়ে গেছে। আমার মতে, বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমপ্রধান দেশ। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রয়েছে। দেশটিতে অদূর ভবিষ্যতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এই সমূহ সম্ভাবনাকে ধূলিসাৎ করতেই পরিবেশ ঘোলাটে করে চলমান জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের আমদানি করতে কোনো মহলের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। এছাড়াও সরকারি দলের একটি গোষ্ঠী সাংঘাতিক জঙ্গিপনা ও মানবতাবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত। যাদের অপতৎপরতায় জনজীবন বিষিয়ে উঠেছে। প্রতিপক্ষকে হত্যা, গুম ও আক্রমণের পাশাপাশি নিজের দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম ও আক্রমণ করে মারাত্মকভাবে সামাজিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে। এদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো আইন প্রয়োগ হতে লক্ষ্য করা যায় না, এদেরকে গ্রেফতার করা হলেও জামাই আদরে থানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়। সরকার সমর্থক এই গোষ্ঠী টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ব্যাংক ডাকাতি, গুম করে মুক্তিপণ আদায়, শিক্ষক লাঞ্ছনা, ছাত্রনির্যাতন, ছাত্রীনির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানা অপকর্মের সাথে জড়িত। প্রকৃতপক্ষে এরাই জঙ্গি, এরাই উগ্রবাদী ও সন্ত্রাসী। রাষ্ট্রই যেখানে অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক সেখানে এদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির বিধান করবে কে? দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে মিডিয়ার একটি অংশ প্রতিনিয়ত আজগুবি চটকদার সংবাদ পরিবেশন করছে। তাদের ভাষ্য মতে, দেশে এত বেশি জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ঘটেছে যে, দেশ আফগানিস্তান, পাকিস্তান হতে চলছে। আরেকটি অংশ সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে প্রকৃত সত্য পরিবেশন করছে না, নেহাত সরকারের তরফ থেকে যা প্রচার করতে নির্দেশ দেয়া হয় ¯্রফে তাই তারা প্রচার করছে। এরা দোষীকে সাধু বানায় আর নিরীহকে বানায় জঙ্গি, বোমারু! ডাহা মিথ্যাকে সত্যের প্রলেপ দিয়ে সত্যকে ধামাচাপা দেয়ার অবারিত চেষ্টা করছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে দেশে কোনো আইএসআই নেই। সরকার বলছে এসব অঘটন বিএনপি-জামায়াতের ছত্রছায়ায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, হুজি ও জেএমবি ঘটাচ্ছে। অথচ ঢাকার গুলশানে, কল্যাণপুরে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে এবং সিলেটের জালালাবাদের ঘটনার দায় আইএসআই তাদের মুখপাত্র আমাক নিউজ এজেন্সির বরাদ দিয়ে জঙ্গিকার্যক্রম সংস্থা সাইড ইন্টেলিজেন্স স্বীকার করেছে! ধর্মকে বা ধর্মের সাথে রিলেটেড বিষয়গুলো নিয়ে বিষোদগার করা নাস্তিকদের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। এমন স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েই অনেক সাধারণ মুসলমান অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে অনলাইনে উসকানিমূলক লেখালেখি ও বক্তব্যের মাধ্যমেও সহজ সরল ঈমানদারদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলছে কথিত নাস্তিক শ্রেণী। এসবকেও জঙ্গিবাদের উত্থান বলে চালিয়ে দেয়া হয়। আর এসব ঘটনাকে তালগোল পাকিয়ে মুসলমানদেরকে জঙ্গি তকমা লাগানোর ঘৃণ্য চেষ্টা চলছে। যারা স্বাধীনচেতা মনোভাবের নামে আরেকজনের বিশ্বাসের উপর কুঠারাঘাত করছে তাদের ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপ অনেকটা বক্তব্যসর্বস্ব। এহেন জটিল পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আমাদের কারো জন্য সুখকর নয়। কোথাও বোমা মেরে বা কিছু লোককে হত্যা করে কোন উগ্রপন্থী বা জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামের নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে এটি নেহাত আজগুবি কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ কোন গোষ্ঠী এধরনের জবরদস্তিমূলক ক্ষমতা দখল করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। তাই এমন কোন পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য রাষ্ট্রকে এবং রাষ্ট্রের সুশীলদেরকে এসব বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, যারা  রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত তারা অনির্বাচিত আর যারা সুশীল হিসেবে বুলি আওড়ায়  তাদের  ভূমিকাও আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদ বা উগ্রবাদ দমনে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রেÑ প্রথমত: আগামী প্রজন্মকে জাগতিক জ্ঞানের পাশাপাশি ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে। তাই আমাদের চলমান শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ দুনিয়াবি কর্মমুখী শিক্ষার পাশাপাশি পরকালীন জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই একজন মানুষ নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে। ভালো-মন্দের ফারাক বুঝতে সক্ষম হয়। কেবলমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার্জনের মাধ্যমেই সত্যকে সত্য ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলার সৎ সাহস অর্জন করে। অনাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সৎ সাহস অর্জন করে। দ্বিতীয়ত: ধর্মচর্চার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। যে যার যার ধর্ম পালন করবে, এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা কোন গোষ্ঠী যেন কোন ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। এক ধর্মের জনগোষ্ঠী যেন আরেক ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর উপর কোনো বিরূপ মন্তব্য  না  করে, তাহলে  পারস্পরিক সম্প্রীতি  তো নষ্ট  হবে  না বরং  সবাই সবার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে। তৃতীয়ত: রাজনৈতিক অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে কোনো বাধাবিপত্তি দেয়া চলবে না। স্বাধীন মতপ্রকাশ, সভা-সমাবেশ করার অধিকার দিতে হবে। বাধা-বিপত্তি হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে। কারণ মানুষ যখন মতপ্রকাশের অধিকার পায় না তখন মতপ্রকাশের ভিন্ন উপায় খুঁজে নেয়। তাই রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করা উচিত। এ ছাড়াও সুষ্ঠুভাবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগও থাকতে হবে। চতুর্থত: জঙ্গিপনা বা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবারের কোনো সদস্য উগ্রবাদে লিপ্ত হচ্ছে কি না? কারা তাদের সঙ্গ দিচ্ছে? তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজখবর রাখতে হবে। আমার ধারণা, ভুল-ভাল বুঝিয়েও যা ইসলাম নয় তা ইসলাম হিসেবে মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের অপচেষ্টা করছে কোন স্বার্থান্বেষী মহল। পঞ্চমত: যারা ইসলামের পক্ষ শক্তি হিসেবে দাবি করে অথচ ইসলামবিরোধী কাজে লিপ্ত হয় তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। কারণ বিনা কারণে ইসলামের দোহাই দিয়ে কিছু লোককে হত্যা করলে ইসলাম কায়েম হয়ে যাবে ভাবা নেহাত বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলাম এমন কোনো ঠুনকো জিনিস নয় যে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে! ষষ্ঠত: ইসলামী দল, সংগঠন, সংস্থাকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে এর ভয়াবহতা ও অনিষ্টকর দিকগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে বোঝাতে হবে। ইসলামের জিহাদ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এক নয়, একথা বিশেষ করে মুসলিম যুবকদের মাঝে কাউন্সেলিং করতে হবে। জঙ্গিবাদের সাথে সত্যিকার ইসলামপন্থীরা জড়িত নয়। তাই সরকারকে জঙ্গিবাদ দমনের জন্য প্রকৃত ইসলামী শক্তি, ইসলামী দলগুলোর সহযোগিতা নিতে হবে এবং তাদের সাথে নিয়েই কর্মপন্থা ঠিক করতে হবে। ইসলামী শক্তি ও দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার উদ্দেশ্যে ইসলামী আদর্শ, ইসলামী শিক্ষালয়সমূহকে ঢালাওভাবে জঙ্গি আখড়া, জঙ্গি প্রজনন কেন্দ্র, মৌলবাদী অভয়ারণ্য বলার মতো উসকানিমূলক বক্তব্য সরকারকে বন্ধ করতে হবে। বর্তমান সরকারি দলের মাথায় ঢুকেছে যে, ইসলামী দল মানে রাষ্ট্রবিরোধী। তাদেরকে সভা-সমাবেশসহ বৈধ কোনো কর্মকান্ড করতে দেয়া যাবে না। তাদের ধারণা সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ দিলে ইসলামী দলসমূহ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাদের এহেন স্বৈরাচারী মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে। সপ্তমত: সরকারের উচিত কোনো প্রকার টালবাহানা না করে বা কোনো পক্ষ বিপক্ষ না নিয়ে দেশ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও উগ্রবাদীদের তৎপরতা জাতির সামনে পরিষ্কার করতে হবে এবং প্রকৃত দোষীদের যথাযথ শাস্তির বিধান করতে হবে। নাইন-ইলেভেন সংঘটনের পেছনের শক্তি কারা? কারা আইএসআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা শক্তি? কারা আমাদের দেশে জঙ্গিবাদ আমদানি করেছে? ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বিবেকবান মানুষ বুঝতে শুরু করেছে। ধীর ধীরে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসছে। মূলত ইহুদি, খ্রিষ্টান ও জায়নবাদীদের যৌথ প্রযোজনায়, সমগ্র দুনিয়াব্যাপী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ইসলামের প্রতি আগ্রহকে ভীতিতে পরিণত করছে এবং মুসলিম বিশ্বব্যাপী গোলযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে সিংহভাগ অর্থনৈতিক পরিমন্ডলকে এরা দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এসব অপশক্তি মুসলমানদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে ফায়দা লুটছে। এক্ষুনি মুসলিম মিল্লাতের সজাগ হবার সময়,  এক্ষুনি  এই সকল ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির