post

প্রথম প্রকৃত বিজ্ঞানী

মূল : অধ্যাপক জিম আল খলিলী অনুবাদ : ইকরামুল হাসান

২১ আগস্ট ২০১৬
আইজ্যাক নিউটন সর্বকালের সেরা পদার্থবিজ্ঞানী- এই ব্যাপারে মোটামুটি সবাই একমত। নিউটনকে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের একমাত্র জনক বলা হয়ে থাকে। আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইগুলোতেও, আমরা এমনটিই জেনে এসেছি কেননা বইগুলোতে তার লেন্স ও প্রিজমের পরীক্ষা, আলোর প্রকৃতি ও এর প্রতিফলন এবং আলোর প্রতিসরণ ও আলোর বিচ্ছুরণে রংধনু তৈরি ইত্যাদি বিষয়গুলো দ্বারা ভরপুর ছিল। কিন্তু একটি বিষয় অনেকেই জানেন না, আর আমি মনে করি এই বিষয়টা সকলের কাছে স্পষ্ট থাকা দরকার যে, আলোকবিজ্ঞানে নিউটনের অবদান রাখার পেছনে তার ৭০০ বছর আগের এক ব্যক্তি মূল ভূমিকা পালন করেছিলেন। ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান ইরাকে হাসান ইবনে হাইসাম নামে একজন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানে তার অবদান সন্দেহাতীতভাবে নিউটনের তুলনায় কোন অংশে কম নয়। অথচ পশ্চিমা বিশ্বের বেশির ভাগ লোক তার নামই শোনেনি। যেহেতু আমি নিজেই একজন পদার্থবিজ্ঞানী, আমার বিষয়ে তার অবদান দেখলে আমি অভিভূত হয়ে যাই। আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে আমি তার জীবনের কিছুটা গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছি। সুযোগটা এসেছিল বিবিসির মাধ্যমে। তাঁরা মধ্যযুগের ইসলামী বিজ্ঞানীদের নিয়ে চার পর্বের ফিল্ম করেছিল, যার তিনটি পর্বেই আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। আধুনিক পদ্ধতি বিজ্ঞানের প্রচলিত ইতিহাস থেকে জানা যায় যে প্রাচীন গ্রিক এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁ যুগের মধ্যবর্তী সময়ে বিজ্ঞানের তেমন কোন উন্নয়ন হয়নি। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপ অন্ধকার যুগের মধ্যে ডুবে ছিল- তার অর্থ এই নয় যে পৃথিবীর সব জায়গাতেই বিজ্ঞান গবেষণা এরকম স্থবির ছিল। নবম শতাব্দী থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী- এই সময়টুকু আসলে আরবীয় বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত। এই সময়টিতে গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, দর্শন ইত্যাদি সবগুলো বিষয়ের দারুণ অগ্রগতি হয়েছিল। আর এই সময়কালের সব মেধাবীর ভিড়ে ইবনে হাইসামের অবস্থান ছিল সবার উপরে। ইবনে হাইসামকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জনক বলা হয়। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে সাধারণভাবে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যে এটি হচ্ছে পর্যবেক্ষণ এবং পরিমাপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সেই তথ্য ব্যাখ্যার জন্য তত্ত্ব তৈরি এবং সেই তত্ত্বের সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে কোন ঘটনার অনুসন্ধান, নতুন কোন জ্ঞান অর্জন কিংবা পূর্ববর্তী কোন জ্ঞানের সংশোধন বা একীভূতকরণ। এভাবেই আমরা আজকের দিনে বিজ্ঞানের কাজগুলো করে থাকি এবং ঠিক এই জন্যই আমি বিজ্ঞানের যেসব উন্নয়ন হয়েছে তার ওপর আস্থা রাখতে পারি। কিন্তু প্রায়ই দাবি করা হয় যে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফ্রান্সিস বেকন এবং রেনে দেকার্তের আগে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিন্তু আমার মনে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে ইবনে হাইসাম এক্ষেত্রে সবার আগে। এমনকি ব্যবহারিক পরীক্ষণের প্রতি এবং একই ফলাফল পুনঃপরীক্ষণের মাধ্যমে নেয়ার প্রতি জোর দেয়ার জন্য তাকে ‘পৃথিবীর প্রথম প্রকৃত বিজ্ঞানী’ও বলা হয়ে থাকে। আলোর ব্যাখ্যা তিনিই সর্বপ্রথম কোন বস্তুকে আমরা কিভাবে দেখি তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন পরীক্ষণের মাধ্যমে আলোর নিঃসরণ তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করেছিলেন। এই তত্ত্বে বলা হয়েছিল আমাদের চোখ থেকে আলো গিয়ে কোন বস্তুর ওপর পড়লে সেটি আলোকিত হয়। প্লেটো, ইউক্লিড এবং টলেমির মত বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাও এই তত্ত্বকে সঠিক মনে করতেন। কোনো বস্তু থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে পড়লে তখন আমরা সে বস্তুকে দেখতে পাই- এই আধুনিক ধারণা তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি গাণিতিকভাবে এই প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন, যা এর পূর্বে আর কোন বিজ্ঞানী করেননি। তাই তাকে সর্বপ্রথম তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীও বলা যেতে পারে। তিনি পিনহোল ক্যামেরা এবং প্রতিসরণের সূত্র আবিষ্কারের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এ ছাড়াও তিনি আলোকে বিচ্ছুরিত করে তার উপাদান রংসমূহে বিভক্ত করার প্রথম পরীক্ষণটিও করেছিলেন এবং ছায়া, রংধনু ও গ্রহণ নিয়েও কাজ করেছিলেন। বায়ুমন্ডলে সূর্যের আলোর অপবর্তন পর্যবেক্ষণ করে তিনি আগের থেকেও আরো সঠিকভাবে বায়ুমন্ডলের উচ্চতা অনুমান করেছিলেন। তিনি বায়ুমন্ডলের উচ্চতা পেয়েছিলেন ১০০ কিলোমিটার। বন্দিত্বকালীন অধ্যয়ন অন্যান্য অনেক আধুনিক স্কলারের মতো ইবনে হাইসামেরও আলোকবিজ্ঞানের বিখ্যাত কাজগুলোসহ অন্যান্য কাজ নিয়ে লেখালেখি করার জন্য প্রচুর সময় ও একাকিত্বের প্রয়োজন ছিল। তিনি এরকম একটি অনাকাক্সিক্ষত সুযোগও পেয়ে যান। ১০১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাকে মিসরে বন্দী করে রাখা হয়। কেননা কায়রোর এক খলিফা তাকে শরৎকালে নীল নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিশেষ কাজ দিয়েছিলেন এবং তিনি তা করতে ব্যর্থ হন। ইবনে হাইসাম যখন বসরায় ছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন খাল খনন এবং বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে শরৎকালে নীল নদের পানি গ্রীষ্ম না আসা পর্যন্ত সংরক্ষণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু তিনি যখন কায়রো পৌঁছলেন তখন দেখলেন তার পরিকল্পনা প্রকৌশল বিদ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে মোটেও প্রয়োগযোগ্য নয়। তিনি নির্মম খলিফার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য নিজের ভুল স্বীকার না করে পাগল হয়ে যাওয়ার ভান করলেন যাতে তার শাস্তি মওকুফ হয়। এই জন্য তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় এবং তিনি ১০ বছর একাকী কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেলেন। গ্রহের গতি খলিফার মৃত্যুর পরই তিনি ছাড়া পেয়েছিলেন। এরপর তিনি ইরাকে ফিরে যান এবং সেখানে তিনি পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নতুন আরো ১০০টি কাজ করেন। আমার ফিল্ম তৈরির সময় যখন আমি মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করেছিলাম, তখন আমি আলেকজান্দ্রিয়ায় একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেই, যিনি ইবনে হাইসামের জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর সম্প্রতি কিছু আবিষ্কৃত কাজ আমাকে দেখিয়েছিলেন। এটা দেখে মনে হয়েছিল উনি মহাকাশীয় বলবিদ্যা তথা গ্রহগুলোর কক্ষপথ ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রেও উন্নয়ন সাধন করেছিলেন। তার কাজগুলোই কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, কেপলার এবং নিউটনের মত ইউরোপিয়ানদের কাজের পথ দেখিয়েছিল। আরো ১০০০ বছর পূর্বের একজন পদার্থবিজ্ঞানীর কাছে বর্তমান যুগের পদার্থবিজ্ঞানীরা ঋণী। আর এ সত্য আমরা এখন জানতে পারছি এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য। অনুবাদক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির