post

বিবর্তনবাদ

মূল : হারুন ইয়াহিয়া অনুবাদ : অধ্যাপক খোন্দকার রোকনুজ্জামান

১৯ ডিসেম্বর ২০১৬
[গত সংখ্যার পর] ১৯. অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধী হয়ে ওঠা বিবর্তনের উদাহরণ নয় কেন? আপন মতবাদের প্রমাণ হিসেবে বিবর্তনবাদীরা একটি জীববিজ্ঞানের ধারণা পেশ করার চেষ্টা করেন। এটা হলো ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ করার ক্ষমতা। অনেক বিবর্তনবাদী বই-পুস্তক অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের বিষয়টিকে জীবের বিকাশে মিউটেশনের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে। একই রকম দাবি করা হয় ডিডিটি-এর মত কীটনাশক প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জনকারী কিছু কীট-পতঙ্গের ব্যাপারে। যাহোক, এই বিষয়েও বিবর্তনবাদীরা ভুলের মধ্যে রয়েছেন। অ্যান্টিবায়োটিক হলো ‘হত্যাকারী অণু’। এটা আণুবীক্ষণিক জীব দ্বারা তৈরি হয় অন্য আণুবীক্ষণিক জীবের সাথে যুদ্ধ করার জন্য। প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ১৯২৮ সালে। ফ্লেমিং উপলব্ধি করলেন, ছত্রাক এমন এক অণু তৈরি করে, যা স্টেফাইলোকক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে পারে। এই আবিষ্কার ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের জগতে এক যুগান্তকারী ঘটনা। আণুবীক্ষণিক জীব থেকে প্রাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হতো ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে এবং এর ফলাফল ছিল সাফল্যজনক। শিগগিরই নতুন এক বিষয় আবিষ্কৃত হলো। সময়ের পরিক্রমায় ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধশক্তি অর্জন করল। কার্যকৌশলটি এভাবে কাজ করে: অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে বিপুল পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া মারা যায়। তবে কিছু ব্যাকটেরিয়া ঐ অ্যান্টিবায়োটিকের দ্বারা প্রভাবিত হয় না এবং তারা দ্রুত প্রতিরূপ তৈরি করে ও তাদের সংখ্যা বিপুল বৃদ্ধি পায়। এভাবে ব্যাকটেরিয়ার সমস্ত প্রজন্মটা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। বিবর্তনবাদীরা এটাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন ‘পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে ব্যাকটেরিয়া বিবর্তিত হয়’ বলে। অথচ সত্যটা এই খন্ডিত ব্যাখ্যা থেকে একেবারেই ভিন্ন। ইসরাইলি জৈব-পদার্থবিজ্ঞানী লি স্পেটনার এমন এক বিজ্ঞানী যিনি এই বিষয়ের ওপর সবচেয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থ Not by Chance  এর জন্য বিখ্যাত; এটি ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। স্পেটনার মন্তব্য করেন যে, ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধশক্তি সৃষ্টি হয় দু’টি ভিন্ন ভিন্ন কর্মকৌশলে; এর কোনটিই বিবর্তনবাদের পক্ষে প্রমাণ বহন করে না। এই দু’টি কর্মকৌশল হলো: এক. ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে পূর্ব থেকে বিদ্যমান প্রতিরোধ জিনের স্থানান্তর। দুই. মিউটেশনের ফলে জিনের তথ্য হারানোর কারণে প্রতিরোধশক্তি তৈরি। অধ্যাপক স্পেটনার ২০০১ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে প্রথম কর্মকৌশলকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন: ‘কিছু আণুবীক্ষণিক জীব এমন জিন দ্বারা ভূষিত, যা এসব অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ গড়তে পারে। এই প্রতিরোধ ঘটতে পারে অ্যান্টিবায়োটিক অণুর গুণগত মান ক্ষতিগ্রস্ত করে, কিংবা এটাকে কোষ থেকে বের করে দিয়ে ... যেসব জীবের এরকম জিন আছে, তারা এগুলিকে অন্য ব্যাকটেরিয়ায় স্থানান্তর করতে পারে; এভাবে তাদেরকেও প্রতিরোধশক্তি গড়ে দিতে পারে। যদিও প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা কোন বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য, তবু অধিকাংশ  রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ... কয়েক সেট জিন একত্র করতে পারে। এটা তাদেরকে বিভিন্ন রকম অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধী করে তোলে।” (Spetner. 2001) এরপর স্পেটনার বলে চলেন এটি ‘বিবর্তনবাদের প্রমাণ’ নয়: ‘এই পদ্ধতিতে অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন ... সেই ধরনের নয়, যা মিউটেশনের জন্য মূল নমুনা হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে এবং বিবর্তনের কারণ হিসাবে যা প্রয়োজন ... এই মতবাদ ব্যাখ্যা করার জন্য যে জিনগত পরিবর্তন, তা অবশ্যই ব্যাকটেরিয়ার জিনোমে তথ্য সংযোগ করবে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে অবশ্যই জীবজগতে নতুন তথ্য যোগ করতে হবে। জিনের সমান্তরাল স্থানান্তর কেবল সেসব জিনের চারিদিকে ছড়ায়, যা আগে থেকেই কোন প্রজাতির মধ্যে বিদ্যমান।’ (প্রাগুক্ত) কাজেই আমরা এখানে কোন বিবর্তনের কথা বলতে পারছি না। কারণ, কোন নতুন তথ্য তৈরি হচ্ছে না। পূর্ব থেকে বিদ্যমান জিনগত তথ্য কেবল ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে স্থানান্তর হচ্ছে। দ্বিতীয় প্রকার প্রতিরোধ ক্ষমতা, যা মিউটেশনের ফলস্বরূপ ঘটে, তা-ও বিবর্তনের দৃষ্টান্ত নয়। স্পেটনার বলেন: “... [অ] আণুবীক্ষণিক জীব কখনো-বা কোন অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধশক্তি অর্জন করে একক নিউক্লিওটাইডের অনিয়ন্ত্রিত প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ... সেলম্যান ওয়াকসম্যান এবং এলবার্ট স্কাটজ যৌথভাবে ১৯৪৪ সালে স্ট্রেপটোমাইসিন আবিষ্কার করেন। এটি এমন এক অ্যান্টিবায়োটিক, যার বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়া এই পদ্ধতিতে প্রতিরোধ শক্তি অর্জন করে। কিন্তু এই পদ্ধতিতে তাদের যে মিউটেশন ঘটে, তা যদিও স্ট্রেপটোমাইসিনের উপস্থিতিতে অণুজীবের জন্য উপকারী, তবুও এটা সেই ধরনের মিউটেশনের জন্য আদিরূপ হিসেবে কাজ করতে পারে না যা নব্য ডারউইনবাদের জন্য প্রয়োজন। যে ধরনের মিউটেশন স্ট্রেপটোমাইসিনকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে, তা রাইবোজমে ম্যানিফেস্ট হয় এবং অ্যান্টিবায়োটিক অণুর সাথে এটার আণবিক সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করে। (Spetner. 2001) Not by Chance  গ্রন্থে স্পেটনার এই অবস্থার তুলনা করেছেন তালা-চাবির মধ্যকার সম্পর্ক গড়বড় হয়ে যাবার সাথে। স্ট্রেপটোমাইসিন ঠিক সেই চাবির মত যা তালার মধ্যে নিখুঁতভাবে ফিট করে, একটি ব্যাকটেরিয়ার রাইবোজমে আটকে যায় এবং এটাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। পক্ষান্তরে, মিউটেশন রাইবোজমকে ভেঙে দেয় এবং এভাবে স্ট্রেপটোমাইসিনকে রাইবোজমের সাথে যুক্ত হতে বাধা দেয়। যদিও এটাকে ‘স্ট্রেপটোমাইসিনের বিরুদ্ধে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধ শক্তি অর্জন’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, তবুও এটি ব্যাকটেরিয়ার জন্য উপকারী নয়, বরং এটি তার জন্য এক ক্ষতি। স্পেটনার লিখেছেন: ‘আণুবীক্ষণিক জীবের রাইবোজমের উপরিভাগে এই পরিবর্তন স্ট্রেপটোমাইসিন অণুকে সংযুক্ত হতে এবং ব্যাকটেরিয়া বিরোধী ভূমিকা পালন করতে বাধা দেয়। ফলত এটা প্রমাণিত হয় যে, মানের এই অবনতি হলো প্রজাতিগত স্বাতন্ত্র্যের ক্ষতি, অতএব, তথ্যের ক্ষতি। মূল বিষয় হলো, বিবর্তন ... এ-ধরনের মিউটেশন থেকে বিবর্তন অর্জন হয় না, সংখ্যায় যতই থাকুক না কেন। যে মিউটেশন কেবল স্বাতন্ত্র্যের মান নষ্ট করে, এরকম অনেক মিউটেশন একত্র হয়ে বিবর্তন ঘটে না।’ (Spetner. 2001) মোটের ওপর, ব্যাকটেরিয়ার রাইবোজমকে আহতকারী মিউটেশন সেই ব্যাকটেরিয়াকে স্ট্রেপটোমাইসিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী করে তোলে। এর কারণ হলো, মিউটেশনের ফলে রাইবোজমটির ‘বিভাজন ঘটে’। অর্থাৎ কোন নতুন জিনগত তথ্য ব্যাকটেরিয়ায় যুক্ত হয় না। পক্ষান্তরে, রাইবোজমের কাঠামো বিভাজিত হয়। বলতে কি, ব্যাকটেরিয়াটি ‘প্রতিবন্ধী’ হয়ে যায়। (এটাও আবিষ্কৃত হয়েছে যে, সাধারণ ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় মিউটেশনের শিকার ব্যাকটেরিয়ার রাইবোজম কম কার্যকর হয়ে থাকে)। যেহেতু এই ‘প্রতিবন্ধিতা’ অ্যান্টিবায়োটিককে রাইবোজমের সাথে যুক্ত হতে বাধা দেয়, সেহেতু ‘অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ’ তৈরি হয়। পরিশেষে বলতে হয়, এমন কোন নজির নেই যে, মিউটেশন ‘জিনগত তথ্যের উন্নয়ন ঘটায়’। যেসব বিবর্তনবাদী অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধকে বিবর্তনবাদের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চান, তারা বিষয়টি খুব হালকাভাবে নেন আর ভুল করে বসেন। একই কথা সত্য সেসব কীট-পতঙ্গের ক্ষেত্রে, যারা DDT  এবং এ-ধরনের কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে আগে থেকে বিদ্যমান প্রতিরোধ-জিন ব্যবহৃত হয়। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সিসকো আয়ালা এই বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে বলেন: ‘বহু বিচিত্র রকমের কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য যে জিনগত রূপভেদ প্রয়োজন, তা স্পষ্টত সেসব কীটের মধ্যে বিদ্যমান থাকে, যারা মানুষের তৈরি এসব যৌগের সংস্পর্শে আসে।’ (Ayala.1978) অন্য কিছু উদাহরণ ব্যাখ্যা করা হয় মিউটেশন দ্বারা। সেগুলি ঠিক উপরোল্লিখিত রাইবোজম মিউটেশনের মতো; এটা এমন এক অবস্থা, যা কীটপতঙ্গের মধ্যে ‘জিনগত তথ্য ঘাটতি’ সৃষ্টি করে। এই ক্ষেত্রে এটা দাবি করা যায় না যে, ব্যাকটেরিয়া ও কীট-পতঙ্গের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বিবর্তনবাদের প্রমাণ। কারণ, বিবর্তনবাদ এই নিশ্চয়তার ওপরে ভিত্তিশীল যে, জীবের উন্নয়ন ও বিকাশ ঘটে মিউটেশনের মাধ্যমে। অথচ স্পেটনার ব্যাখ্যা করেছেন, না অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ, না অন্য কোন জীববিজ্ঞান সম্পৃক্ত ব্যাপার এই ধরনের মিউটেশনের উদাহরণ পেশ করতে পারে: ‘বড় মানের বিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় মিউটেশন কখনো লক্ষ্য করা যায়নি। কোন এলোপাতাড়ি মিউটেশন যা নব্য ডারউইবাদের জন্য প্রয়োজন, আণবিক পর্যায়ে পরীক্ষা করেও কোন তথ্য যোগ করা সম্ভব হয়নি। যে প্রশ্ন আমি করতে চাই, তা হলো: বিবর্তনবাদকে সমর্থন করার জন্য যে রকম মিউটেশন প্রয়োজন, আমাদের প্রত্যক্ষ করা মিউটেশন কি সেই ধরনের? এর উত্তর হলো ‘না’! (Spetner. 2001) ২০. সৃষ্টিতত্ত্ব ও বিবর্তনের মধ্যে কী ধরনের সম্পর্ক বিদ্যমান? আমরা এযাবৎ যেসব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করলাম, তা থেকে দেখতে পেলাম, বিবর্তনবাদ সম্পূর্ণভাবে  বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সাথে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে আছে। ঊনবিংশ শতকের আদিম বিজ্ঞান থেকে জন্ম নেয়া এই মতবাদ পরবর্তীকালে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দ্বারা সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে গেছে। যেসব বিবর্তনবাদী অন্ধের মত এই মতবাদের প্রতি নিষ্ঠাবান রয়েছেন, তারা বক্তৃতাবাজিতে সমাধান তালাশ করছেন। কারণ, তাদের কাছে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অবশিষ্ট নেই। তাদের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অবলম্বন হলো এই বস্তাপচা স্লোগান, সৃষ্টিতত্ত্ব হলো এক বিশ্বাস; কাজেই এটাকে বিজ্ঞানের অংশ বিবেচনা করা যেতে পারে না। আরো দাবি করা হয় যে, বিবর্তনবাদ এক বৈজ্ঞানিক মতবাদ, অথচ সৃষ্টিতত্ত্ব হলো কেবলই বিশ্বাস। যাহোক, এই কথার পুনরাবৃত্তি ... হয়েছে একেবারেই ভুল পরিপ্রেক্ষিত থেকে। যারা এ কথার পুনরাবৃত্তি করে চলেন, তারা বিজ্ঞান ও বস্তুবাদী দর্শনকে গুলিয়ে ফেলেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, বিজ্ঞানকে অবশ্যই বস্তুবাদের সীমারেখার মধ্যে থাকতে হবে, এবং যারা বস্তুবাদী নয়, তাদের কোনো বক্তব্য দেয়ার অধিকার নেই। অথচ স্বয়ং বিজ্ঞান বস্তুবাদকে প্রত্যাখ্যান করে। বস্তু নিয়ে গবেষণা আর বস্তুবাদী হওয়া এক নয়। আসুন প্রথমে আমরা বস্তুবাদকে আরো বিস্তারিতভাবে পরীক্ষা করার জন্য সংক্ষেপে এটাকে সংজ্ঞায়িত করি। বস্তুবাদ হলো এক দর্শন যা প্রাচীন গ্রিস থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত রয়েছে। বস্তুবাদ এই ধারণার ওপর ভিত্তিশীল যে, যা কিছু অস্তিত্বমান, তা-ই বস্তু। বস্তুবাদী দর্শনের মতে, বস্তু সব সময় বিদ্যমান থেকেছে এবং থাকবে। বস্তু থেকে ভিন্ন কিছুর অস্তিত্ব নেই। অথচ এটা কোনো বৈজ্ঞানিক দাবি নয়। কারণ, এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের অধীন হতে পারে না। এটা স্রফে এক বিশ্বাস, একটা যুক্তিহীন বিশ্বাস। যাহোক, এই অন্ধবিশ্বাস ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের সাথে মিশে গেছে; এমনকি এটা বিজ্ঞানের মৌলিক ভিত্তিতে পরিণত হয়েছে। অথচ, বিজ্ঞান বস্তুবাদকে মেনে নিতে বাধ্য নয়। বিজ্ঞান প্রকৃতি ও মহাবিশ্ব নিয়ে গবেষণা করে এবং কোন প্রকার দার্শনিক শ্রেণিবিন্যাসের সীমায় না থেকে ফলাফল প্রদান করে। কিছু বস্তুবাদী এটার মোকাবিলায় সচরাচর এক সরল শব্দখেলার আশ্রয়গ্রহণ করেন। তারা বলেন, ‘বস্তু হলো বিজ্ঞানের একমাত্র গবেষণার বিষয়; কাজেই বিজ্ঞানকে বস্তুবাদী হতে হবে।’ হ্যাঁ, বিজ্ঞান কেবল বস্তু নিয়ে গবেষণা করে, কিন্তু ‘বস্তু নিয়ে গবেষণা’ ‘বস্তুবাদী হওয়া’ থেকে একেবারেই ভিন্ন। এর কারণ হলো, যখন আমরা বস্তু নিয়ে গবেষণা করি, তখন উপলব্ধি করি, বস্তুতে এত বিপুল জ্ঞান ও পরিকল্পনা রয়েছে যে, তারা কখনোই বস্তু দ্বারা সৃষ্ট হতে পারে না। আমরা উপলব্ধি করতে পারি যে, এই জ্ঞান ও পরিকল্পনা এক বুদ্ধিমত্তার ফল, যদিও আমরা তা সরাসরি দেখতে পারি না। উদাহরণস্বরূপ, আসুন এক গুহার কথা কল্পনা করি। আমরা জানি না আমাদের আগে কেউ এখানে এসেছে কি-না। এই গুহায় প্রবেশ করার সময় যদি আমরা ধুলা, মাটি, পাথর ছাড়া আর কিছু না দেখি, তাহলে আমরা সিদ্ধান্তে আসি, এখানে বিশৃঙ্খলভাবে কিছু বস্তু ছড়িয়ে আছে মাত্র। অথচ, যদি গুহার দেয়ালে দক্ষ হাতে আঁকা চোখধাঁধানো রঙের ছবি থাকে, তাহলে আমরা অনুমান করতে পারি, আমাদের আগে সেখানে কোনো বুদ্ধিমান সত্তা ছিল। আমরা সেই সত্তাকে সরাসরি দেখতে পাচ্ছি না; কিন্তু সে যা তৈরি করেছে তা থেকে তার অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি। বিজ্ঞান বস্তুবাদকে খন্ডন করেছে বিজ্ঞান প্রকৃতি নিয়ে ঠিক সেভাবেই গবেষণা করে, যেমনটি উপরের উদাহরণে দেখানো হলো। যদি প্রকৃতির সমুদয় নকশা কেবল বস্তুগত দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেত, তাহলে বিজ্ঞান বস্তুবাদকে নিশ্চিত করত। অথচ আধুনিক বিজ্ঞান প্রকাশ করেছে, প্রকৃতিতে যে নকশা বা পরিকল্পনা রয়েছে, বস্তুগত দিক দিয়ে তা ব্যাখ্যা করা যায় না। সকল বস্তুর মধ্যে এ নকশা রয়েছে যা একজন সৃষ্টিকর্তা দ্বারা অস্তিত্ব লাভ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ প্রমাণ করে যে, বস্তু আপনা থেকে প্রাণের উৎপত্তি ঘটাতে পারে না। সেই কারণে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে অবশ্যই বস্তুর অতীত সৃষ্টি হিসাবে। এই লক্ষ্যে পরিচালিত সকল বিবর্তনবাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রাণের সৃষ্টি কখনোই জড়বস্তু থেকে হয়নি। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী এ্যানড্রু স্কট বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’-এ এই বিষয়ের ওপর নিম্নলিখিত স্বীকারোক্তি দিয়েছেন: ‘কিছু বস্তু নিন, সেগুলো উত্তাপ দিতে থাকুন, নাড়াচাড়া করুন এবং অপেক্ষা করুন। এটা হলো পয়দায়েশ (জেনেসিস) এর আধুনিক সংস্করণ। মাধ্যাকর্ষণের ‘মৌলিক’ বল, বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় শক্তি এবং সবল ও দুর্বল আণবিক শক্তি বাকি কাজটি করেছে বলে অনুমিত হয়। কিন্তু এই পরিচ্ছন্ন কাহিনীর কতটা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, আর কতটা আশাবাদী অনুমান? সত্যটা হলো এই যে, প্রায় প্রতিটি প্রধান ধাপের কার্যপ্রণালী, রাসায়নিক পূর্বসূচক থেকে প্রথম শনাক্ত করার উপযোগী কোষ পর্যন্ত, হয় বিতর্ক, নয়ত সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হবার মতো বিষয়।’ (Scott.1985.p-30) প্রাণের মূল হলো অনুমান ও বিতর্কের ওপর ভিত্তিশীল। কারণ, বস্তুবাদী অন্ধবিশ্বাস জোর দিয়ে বলে, প্রাণ বস্তু থেকে উৎপন্ন। অথচ বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা দেখিয়ে দিচ্ছে, বস্তুর এমন কোন ক্ষমতা নেই। জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ ফ্রেড হোয়েল (যিনি বিজ্ঞানে অবদানের জন্য নাইট উপাধিপ্রাপ্ত) এই বিষয়ের ওপর নিম্নলিখিত মন্তব্য করেন: ‘যদি বস্তুর কোনো মৌলিক নীতি থাকত যা কোন না কোনভাবে জৈবপ্রক্রিয়াকে প্রাণের দিকে চালিত করেছিল, তাহলে সেই নীতির অস্তিত্ব সহজেই গবেষণাগারে প্রদর্শন করা যেত। উদাহরণস্বরূপ, কেউ আদি স্যুপ তৈরির জন্য বেছে নিতে পারত এক সুইমিং পুল, নিজের পছন্দমত যেকোনো অজৈব রাসায়নিক পদার্থ নিতে পারত, এর মধ্য দিয়ে বা ওপর দিয়ে নিজের ইচ্ছামাফিক যেকোনো গ্যাস চালনা করতে পারত, ইচ্ছামত যেকোনো বিকিরণ এর ওপর দিয়ে চালনা করতে পারত। এক বছর ধরে এরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা পরিচালনা করে দেখা যেত সেই ২০০০ এনজাইমের (জীবন্ত কোষের দ্বারা উৎপন্ন প্রোটিন) কতগুলো সেই সুইমিং পুলে পাওয়া যায়। আমিই এর উত্তর দিচ্ছি এবং সত্যি সত্যি এই পরীক্ষা চালানোর সময়, ঝামেলা ও খরচ বাঁচিয়ে দিচ্ছি। আপনি মোটেই কিছু পাবেন না। সম্ভবত কিছু আলকাতরার মতো তৈলাক্ত কাদা ছাড়া; এগুলো অ্যামিনো এসিড এবং অন্য কিছু সরল রাসায়নিক উপাদান।’ (Hoyle.1983.p-20-21) আসলে বস্তুবাদের উভয়সঙ্কট আরো করুণ। বস্তু প্রাণের সৃষ্টি করতে পারে না; এমনকি যখন এর সাথে মানুষের জ্ঞান ও সময় যুক্ত হয়, তখনো না। নিজে নিজে গঠিত হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। যে সত্যের ওপরে আমরা সামান্য নজর বুলালাম, সেটা হলো এই যে, বস্তু নিজে থেকে পরিকল্পনা ও জ্ঞান তৈরি করতে পারে না। অথচ এই মহাবিশ্ব এবং এর মধ্যকার জীবকুলের মধ্যে রয়েছে অসাধারণ জটিল পরিকল্পনা ও জ্ঞান। এটি আমাদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মহাবিশ্ব এবং জীবকুলের মধ্যে এই যে পরিকল্পনা এবং জ্ঞান- এগুলো অসীম ক্ষমতা ও জ্ঞানের অধিকারী একজন স্রষ্টার কাজ। তিনি বস্তুরও আগে বিদ্যমান ছিলেন এবং বস্তুকে নিয়মের অধীন করেছেন। আমরা যদি সতর্কতার সাথে দেখি, তাহলে মানতে হবে, এটি সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত উপসংহার। এটি কোনো ‘বিশ্বাস’ নয়, বরং এটি এমন এক সত্য, যা বিশ্বজগৎ এবং এর মধ্যস্থিত জীবকুলকে পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে। এজন্যই ‘বিবর্তনবাদ বিজ্ঞানসম্মত, কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্ব হলো এমন বিশ্বাস যা বিজ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ করতে পারে না’- এই দাবি অন্তঃসারশূন্য প্রতারণা। এটা সত্য যে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বস্তুবাদ বিজ্ঞানের সাথে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিল এবং বিজ্ঞানকে পরিচালনা করেছিল বস্তুবাদী অন্ধবিশ্বাস। তবে বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের উন্নতি সেই বার্ধক্যপীড়িত পুরাতন বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ ছুড়ে ফেলেছে, এবং বস্তুবাদের দ্বারা ঢাকা পড়া সৃষ্টিতত্ত্বের সত্য অবশেষে প্রকাশিত হয়েছে। বিখ্যাত সাময়িকী ‘নিউজ উইক’-এর ১৯৯৮ সালের ২৭ জুলাই ঐতিহাসিক সংখ্যায় ব্যানার শিরোনাম ছিল ‘বিজ্ঞান স্রষ্টাকে খুঁজে পেয়েছে’। এখানে পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে, সকল বস্তুবাদী প্রতারণার আড়াল থেকে বিজ্ঞান স্রষ্টাকে খুঁজে পেয়েছে; তিনি মহাবিশ্ব এবং এর মধ্যস্থিত সবকিছুর স্রষ্টা। (সমাপ্ত)

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির