post

‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নিপীড়িত মানুষের জাগরণ

হারুন ইবনে শাহাদাত

০৩ জুলাই ২০২০
করোনা মহামারীর মৃত্যু-ভয়কে উপেক্ষা করে লাখ লাখ মানুষ আমেরিকা-ইউরোপের বড়-ছোট শহরের অলি-গলিতে স্লোগান তুলছে- ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, ‘জাস্টিস ফর জর্জ’, ‘জাস্টিস ফর ফ্লয়েড’। এই স্লোগানের ঢেউ লেগে ভেঙে পড়ছে আমেরিকায় নোঙর করা ইতালীয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাসসহ অন্যান্য ঔপনিবেশিক শোষক ও দাস ব্যবসায়ীদের মূর্তি। মানুষ হয়ে যারা মানুষকে গোলামে পরিণত করেছিল তারা মানবসভ্যতার কলঙ্ক। বিক্ষুব্ধ জনতা এই কলঙ্কচিহ্ন নির্মূল না করা পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এবারই প্রথম নয় আমেরিকা ও ইউরোপের ইতিহাসের একটি বিশাল অংশ দখল করে আছে বর্ণবাদ, দাস প্রথা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও যুদ্ধ। সেই প্রসঙ্গে আলোচনার আগে চলমান আন্দোলন কী এবং কেন সে প্রসঙ্গে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। আইনের শাসন, সংবিধান এককথায় মানবজাতিকে অন্যায় অবিচার দুঃশাসন থেকে রক্ষা করতে সময়ের প্রয়োজনে মানুষ যুগে যুগে প্রয়োজনে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় তারা এবারও রাস্তায় নেমেছে। তারা জানে কখনো কখনো এমন সময় আসে যখন বিরোধী দল, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওপর ভরসা করে ঘরে বসে থাকলে চলে না। বিরোধী দল, মানবাধিকার সংগঠন এমনকি সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে জনতার প্রতিবাদ শক্তি জোগায়। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের রক্ষাকবচ জনতার এই সম্মিলিত শক্তি। গত ২৫ মে আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে পুলিশের নির্মমতায় প্রাণ হারান কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড। পুলিশি নির্যাতনে শ্বাসবন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে মানবিকবোধ সম্পন্ন সাদা-কালো, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে পুলিশের নির্যাতনে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। ফ্লয়েডের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মাথায় আসা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেভাবে তার মৃত্যু হয়েছে, সেটা ‘হত্যাকাণ্ড’। তাকে ঘাড়ে হাঁটু দিয়ে ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে চেপে রাখা হয়। এভাবে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। পথচারীদের মোবাইলে ধারণ করা ভিডিও, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ এবং দাফতরিক নথি পর্যালোচনা করার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ওই সময়ের ঘটনাগুলো জোড়া দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। এতে দেখানো হয়েছে, ঘাড়ে চাপা দেয়ায় শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক কাকুতি-মিনতি করেছিলেন ফ্লয়েড। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে সাহায্য করার অনুরোধ জানালেও পুলিশ তাতে সাড়া দেয়নি। ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরদিন মঙ্গলবার ওই ঘটনায় জড়িত চার পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে পুলিশ বিভাগ। হেনেপিন কাউন্টি অ্যাটর্নি মাইক ফ্রিম্যান বরখাস্ত পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনেন। ঘটনার সূচনা একটি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে। এক খাবারের দোকানের কর্মচারী ৯১১-এ কল করে অভিযোগ করেন, এক ক্রেতা সিগারেট কেনার পর ২০ ডলারের জাল নোট দিয়েছে। পুলিশ এসে ওই অভিযোগে ৪৬ বছর বয়সী ক্রেতা জর্জ ফ্লয়েডকে গ্রেফতার করে। পুলিশ এসে তাকে ঘিরে ধরে। তার ওপর নিপীড়ন শুরু করে। ঘটনাস্থলে পুলিশের গাড়ি আসার ৭২ মিনিট পর রাস্তায় তিন পুলিশের নিচে চাপা পড়ে থাকা ফ্লয়েড অচেতন হয়ে ছিলেন, তার মধ্যে প্রাণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। এই ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ জনতার আন্দোলন দমন করতে পুলিশের নির্মমতার আরো অনেক ঘটনা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ফলশ্রুতিতে নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় শহর বাফেলোতে দু’জন পুলিশ অফিসারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও আন্দোলন চলছে। গত ৯ জুন ফ্লয়েড সমাহিত হয়েছেন হিউস্টনের মেমোরিয়াল গার্ডেনসে তার মায়ের পাশে। ফ্লয়েডের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে বক্তারা বর্ণবাদী অপরাধের বিচার দাবি করে বলেছেন, ফ্লয়েডের আত্মত্যাগের মাধ্যমে একটি আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে উঠেছে, যা বিশ্বকে বদলে দেবে। ফ্লয়েডের ভাগনি ব্রুকলিন উইলিয়ামস বর্ণবাদকে মহামারী উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না। কিন্তু আমার নিঃশ্বাস যতদিন আছে, ততদিন বিচার চাইবো। এটা একটা হত্যাকাণ্ডই নয়, এটা ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ।’ ফ্লয়েড তার জীবন দিয়ে বড় কোনো পরিবর্তনের পথ তৈরি করে গেলেন কি না, কিংবা গড়ে ওঠা প্রতিবাদের ‘বিশাল ঝড়’ বৈষম্যের ভিত্তি উপড়ে ফেলতে কী ভূমিকা রাখবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এটুকু তো বলা যায়ই যে পুলিশি সংস্কারের বিষয়টি আর উপেক্ষা করতে পারবে না মার্কিন কর্তৃপক্ষ। পুলিশ সংস্কারের নানা উদ্যোগ এর মধ্যেই লক্ষ করা যাচ্ছে। পরিবর্তনের পক্ষে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ অনেকেই কথা বলছেন। আগামী সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট না দেয়ার কথাও বলছেন তার কোনো কোনো সাবেক সহকর্মী। ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় এখন ভাটার টান। রাষ্ট্র পরিচালনায় ট্রাম্পের ব্যর্থতার সমালোচনা তার নিজ দলের মধ্যেই হচ্ছে। ট্রাম্পের ব্যর্থতা বলা হলেও আসলে এই ব্যর্থতার শিকড় অনেক গভীরে। আমেরিকার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে বর্ণবাদ এবং বর্ণবাদ-বিরোধী সংগ্রাম, যুদ্ধ। ঐতিহাসিক সত্য হলো, আজ যারা আমেরিকা শাসন করছে তারা এই দেশের ভূমিপুত্র নয়। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। আমেরিকার ভূমিপুত্র রেড ইন্ডিয়ানরা অত্যাচার নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে আজ সংখ্যালঘু। সেই হত্যাকারীদের মধ্যে সবার ওপরে যে ঘাতকের নাম তিনি হলেও ক্রিস্টোফার কলম্বাস। হতভাগা ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা জুড়ে মূর্তি ভাঙার যে আয়োজন চলছে সেই প্রেক্ষাপটে ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে হতভাগা বলা হয় না। এর আসল কারণ তিনি আমেরিকা আবিষ্কার করলেও দেশটির নাম হয়েছে অন্য একজন নাবিক আমেরিগো ভেসপুচির নামে। কারণ তিনিই কলম্বাসের আগে প্রথম বুঝতে পারেন তারা নতুন কোন ভূ-খণ্ডে এসে পৌঁছেছেন। ক্রিস্টোফার কলম্বাস ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশে যাত্রা করে ভুলবশত আমেরিকার ভূখণ্ড আবিষ্কার করে ফেলেন। ১৭৯২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশে ১২ অক্টোবরকে কলম্বাস ডে হিসেবে পালন করা হয়। কারণ ১৪৯২ সালের এই দিন তিনি তিনটি জাহাজ নিয়ে আমেরিকার মাটিতে পা ফেলেছিলেন। ১৯৩৪ সালে কলম্বাস দিবসকে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। যদিও সব অঙ্গরাজ্যই এই নিয়মটি মেনে চলে না। যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ২৩টি অঙ্গরাজ্য আংশিকভাবে কলম্বাস দিবস পালন করে। আগামী দিনে হয়তো তাও হবে না। কলম্বাস মোট চারবার স্পেন থেকে আমেরিকা মহাদেশে অভিযান চালান। তিনি মহাদেশের মূল ভূখণ্ডেও পৌঁছান। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি নতুন এক মহাদেশে পৌঁছেছেন। তিনি মনে করতেন প্রাচ্যের ইন্ডিয়ার কোন অঞ্চলে এসেছেন। কলম্বাস সত্যিই ছিলেন দুর্ভাগা। একটি মহাদেশের আবিষ্কারক হয়েও তার নামে এটির নামকরণ হয়নি। তার শেষজীবনও সুখের হয়নি। দেশের জন্য প্রচুর সম্পদ বয়ে আনার পরও শেষজীবনে রাজরোষে পড়ে জেল খাটতে হয় তাকে। জীবনও কাটে দারিদ্র্যের মধ্যে। তাই তাকে বলা হয় নতুন পৃথিবীর পথপ্রদর্শক। ১৫০৬ সালে ভ্যাসাডোলিড শহরে এক সাধারণ কুঠিরে সবার অগোচরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কলম্বাস। আধুনিক ইতিহাসবিদরা বলছেন, যে আমেরিকা মহাদেশে পা রাখা প্রথম ইউরোপীয় কলম্বাস নন। তার আগে একাদশ শতকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার নাবিকরা আমেরিকায় যাওয়ার পথ জানতেন। তাদেরও আগে আবু রায়হান মুহাম্মদ আল বেরুনি (৯৭০-১০৪৮) ১১ শতকের শুরুতে প্রথম আমেরিকা আবিষ্কার করেন। মুসলিমরাই প্রথম আমেরিকা আবিষ্কার করেন একজন গবেষক মনে করে কলম্বাসের প্রায় ৫০০ বছর পূর্বেই মুসলিমরা আমেরিকা আবিষ্কার করেন। আবু রায়হান মুহাম্মদ আল বেরুনি (৯৭০-১০৪৮) ১১ শতকের শুরুতে প্রথম আমেরিকা আবিষ্কার করেন। প্রফেসর ম্যাপাও তাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী বলে অভিহিত করেছেন। আমেরিকার বিখ্যাত ঐতিহাসিক S. Frederick Starr আল বেরুনিকে আমেরিকা আবিষ্কারের জনক বলে অভিহিত করেছেন। তার বিখ্যাত History today এর ৬৩ নম্বর ভলিউমে ঝড়. ডযড় উরফ উরংপড়াবৎ অসবৎরপধ একটি বিখ্যাত রচনা। এতে তিনি লেখেন, So. Who Did Discover America একটি বিখ্যাত রচনা। এতে তিনি লেখেন, Abu Raihan. an islamic scholar from central Asia, May have discovered the new world centuries before columbus without leaving his study. ২০১৪ সালের ১০ জানুয়ারি The Express Triuvne World পত্রিকায় New Research : Al Biruni May Have Discovered America নামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয় Letest research shows that central Asian Muslim scholar Abu Raihan Al Biruni discovered the Americas hundreds of years prior to christopher columbus the spanish explorer who has always been crideted with the discovery. বিখ্যাত পত্রিকা World Bulletin এর ২০১৪ সালের ৪ জানুয়ারি সোমবার সংখ্যায় Muslim scholar discovered America 500 years before Columbus শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে অন্য কোন নিবন্ধে সুযোগ পেলে লেখার আশা রেখে আলোচ্য বিষয়ের দিকে যাওয়া যাক। আধুনিক যুক্তরাষ্ট্রের যাত্রা শুরু মুসলমানদের কৃতিত্ব চাপা রাখতে আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কারের কৃতিত্ব কলম্বাসকেই দেওয়া হয়। কারণ কলম্বাসের হাত ধরেই আমেরিকা মহাদেশের সঙ্গে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী, বাণিজ্যিক ও সামরিক সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটে। যদিও তিনি পথ ভুলে আমেরিকা গিয়েছিলেন। তার এই ভুলের কারণেই আমেরিকার আদি অধিবাসী বা ভূমিপুত্রদের বিশ্ববাসী চিনে রেড ইন্ডিয়ান বলে। তিনি আমেরিকা পৌঁছে সেখানে ঔপনিবেশিক শাসন পাকাপোক্ত করতে সে দেশের আদিবাসীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার নির্যাতন করেছেন। তার এই অপকর্মের কারণে রেড ইন্ডিয়ানরা আজ নিজ দেশে পরবাসী। দখলদাররাই আজ সে দেশের মালিক। ইতালির নাবিক স্পেনের রাণীর অর্থ তারপরও কেন আমেরিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন হয়? এখনো কেন তাদের বংশধররাই দেশটির হর্তাকর্তা এই প্রশ্নের উত্তরের সাথে জড়িয়ে আছে বর্তমান সংঘাতের শিকড়। অভিযানের আগে কলম্বাস প্রথমে পর্তুগালের লিসবনে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি ভূমধ্যসাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগরীয় বাণিজ্যিক বন্দরগুলোতে নৌ অভিযান পরিচালনা করেন। পর্তুগালের রাজা জন দ্বিতীয়র কাছে কলম্বাস তার পরিকল্পনা জমা দেন। তাতে ছিল আটলান্টিক হয়ে পশ্চিমের দিকে ইন্ডিজে (এশিয়া) যাওয়ার পরিকল্পনা। রাজা যখন তার পরিকল্পনায় রাজি হলেন না, তখন তিনি তা স্পেনের রাজা ও রাণীর কাছে পেশ করেন। তৎকালীন ক্যাস্টিল রাজ্যের (বর্তমান স্পেনে) রানী ইসাবেলার অনুদানে তিনি আমেরিকায় অভিযাত্রা করেন। তখন ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে নতুন নতুন দেশ দখল করে ঔপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে লুটপাটের প্রতিযোগিতা চলছিল। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর এর দক্ষিণাঞ্চলে স্পেন যখন প্রায় শত বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত, তখন উত্তর আমেরকিায় উপনিবেশ স্থাপনে ফ্রান্স ও ব্রিটিশরা ব্যাপক প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। বর্তমানে যে অঞ্চলটি যুক্তরাষ্ট্র বা মূল আমেরিকা বলে পরিচিত ব্রিটিশরা তা দখলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। ১৫৮৪ সালে ইংল্যান্ডের রানী প্রথম এলিজাবেথের রয়েল প্যাটেন্ট নিয়ে স্যার ওয়াল্টার রেলি (১৫৫৪-১৬১৮) আমেরিকা অভিযানে বের হন। প্রথম যাত্রায় তারা তেমন সুবিধা করতে না পেরে ১৬০৬ সালে ‘চার্টার অব দ্য ভার্জিনিয়া কোম্পানি অব লন্ডন’ নামে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত করেন ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস। উদ্দেশ্য ব্যক্তিগত পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে কলোনি স্থাপন। অল্প সময়ে বিপুল লাভের সম্ভাবনা দেখিয়ে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে পুঁজি গঠন করা হয়। এই কোম্পানির দু’টি শাখা খোলা হয় : ১. লন্ডন কোম্পানি ২. প্লাইমাউথ কোম্পানি। লন্ডন কোম্পানি ‘কলোনি অব ভার্জিনিয়া’ (বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট অব ভার্জিনিয়া) প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, পরিপূর্ণ জরিপের মাধ্যমে সব প্রতিকূলতা জেনে, সামগ্রিক প্রস্তুতি নিয়ে। স্থানীয় আদিবাসীদের বিতাড়িত করে দাস দিয়ে কৃষিজ উৎপাদন ছিল মূল লক্ষ্য। লন্ডন কোম্পানি তাদের ভার্জিনিয়া অভিযানের জন্য ক্রিস্টোফার নিউপোর্টকে ক্যাপ্টেন নির্বাচন করে। ১৬০৬ সালের নভেম্বর প্রায় দেড় শ’ অভিযাত্রী নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দেন নিউপোর্ট। ১৬০৭ সালের ১০ এপ্রিল উত্তর আমেরিকায় ভর্জিনিয়ার উপকূলে চেসপিক উপসাগরে পৌঁছান। চেসপিক উপসাগরে যে নদীটা এসেছে মিশেছে নিউপোর্ট তার নাম দেন জেমস রিভার। এই নদী দিয়ে প্রবেশ করে প্রায় ১০০ মাইল উজানে গিয়ে নদীর উত্তর পাড়ে ভার্জিনিয়ার রাজধানী হিসেবে এক নগর পত্তন করেন নিউপোর্ট এবং তার নাম দেন জেমসটাউন। তখন ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন প্রথম জেমস। ১৬২৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমস ভার্জিনিয়া চার্টার প্রত্যাহার করেন। তখন ভার্জিনিয়া হয় একটি রয়েল কলোনি। ভার্জিনিয়া ছিল আমেরিকা তথা সারা পৃথিবীতে ব্রিটিশদের প্রথম স্থায়ী/সফল উপনিবেশ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসে এটি ওল্ড কলোনি নামেও পরিচিতি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হয় এখান থেকেই। ভার্জিনিয়ার পর ব্রিটিশরা আমেরিকার বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক নতুন উপনিবেশ স্থাপন করে এবং অন্য ইউরোপীয়দের উপনিবেশ ছিনিয়ে নেয়। এসব উপনিবেশের মধ্যে ১৩টি ছিল বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্র-সীমানায়। ব্রিটিশ ইতিহাসে এরা থার্টিন কলোনি নামে পরিচিত। সেগুলো হলো : ডেলাওয়্যার, পেনসিলভানিয়া, নিউ জার্সি, জর্জিয়া, কানেকটিকাট, ম্যাসাচুসেটস বে, মেরিল্যান্ড, দক্ষিণ ক্যারোলিনা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ভার্জিনিয়া, নিউ ইয়র্ক, উত্তর ক্যারোলিনা এবং রোড আইল্যান্ড অ্যান্ড প্রভিডেন্স প্লান্টেশন। এই ১৩টি কলোনিই ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ব্রিটিশদের কাছ থেকে ‘দি ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’ নামে স্বাধীনতা লাভ করে। সংক্ষেপে ইউনাইটেড স্টেটস বা ইউ.এস. উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত একান্ন রাজ্য ও একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় জেলা নিয়ে গঠিত এক যুক্তরাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র। এই দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামেও পরিচিত। উত্তর আমেরিকা মহাদেশের মধ্যভাগে অবস্থিত আটচল্লিশটি রাজ্য ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি অঞ্চলসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডটি পশ্চিমে প্রশান্ত ও পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগরদ্বয়ের মধ্যস্থলে অবস্থিত; এই অঞ্চলের উত্তর ও দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত যথাক্রমে কানাডা ও মেক্সিকো রাষ্ট্রদ্বয়। আলাস্কা রাজ্যটি অবস্থিত মহাদেশের উত্তর-পশ্চিমে; এই রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে রয়েছে কানাডা ও পশ্চিমে বেরিং প্রণালী পেরিয়ে রয়েছে রাশিয়া। হাওয়াই রাজ্যটি মধ্য-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত একটি দ্বীপপুঞ্জ। এ ছাড়াও ক্যারিবীয় সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক অঞ্চল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকারভুক্ত। মজার বিষয় হলো স্বাধীনতা লাভ করলেন ব্রিটিশদের বংশধরদের হাতেই থাকে দেশটির শাসন ক্ষমতা। কারণ ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে ভূমিপুত্র রেড ইন্ডিয়ানরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। আমেরিকায় বর্ণবাদের সূচনা ১৬১৯ সালের ২৪ আগস্ট। আমেরিকার ভার্জিনিয়া উপকূলে একটি জাহাজ নোঙর করলো। জাহাজে ইউরোপীয়রা আফ্রিকা উপকূল থেকে কালো মানুষদের ধরে ধরে শিকলবন্দি করে নিয়ে এসেছে। সাদা ইউরোপীয়রা ওদের মানুষ মনে করে না, তাদের চোখে ওরা দাস। এভাবেই আমেরিকায় দাসত্ব প্রথা চালু করেছিল ইউরোপীয়রা। কলম্বাস আমেরিকায় পদার্পণের আগে রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে দাসপ্রথা ছিল না। মানুষকে মানুষের গোলামে পরিণত করার এই ঘৃণ্য প্রথা থেকেই শুরু হয়েছে মানুষে মানুষে বৈষম্যের অমানবিক মতবাদ রেসিজম বা বর্ণবাদ। তারা গোটা পৃথিবীকে শোষণ করতে ‘ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা জন্মগতভাবেই উৎকৃষ্ট’ এই মতবাদ তৈরি করেছে। পঞ্চদশ শতকের শেষ থেকে ক্রমান্বয়ে আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়া ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে আসে। আমেরিকায় এই দখল নিশ্চিত করার জন্য সেখানকার উচ্চ সভ্যতার নির্মাতা আদিবাসীদের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষকে হত্যা করা হয়। অন্য দিকে আফ্রিকার কালো মানুষদের দাসে রূপান্তর করা হয় এবং তাদের নিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকায়। ইউরোপীয় বণিকদের জন্য দাসবাণিজ্য খুবই লাভজনক হয়ে ওঠে। বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও সে সময় থেকে তার ডালপালা ছড়িয়েছে। আমেরিকার দক্ষিণাংশের ১১টি রাজ্যের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল দাসশ্রম। ১৮৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাসের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ মিলিয়ন। আমেরিকার উত্তরাংশে দাসপ্রথাবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠে সমাজসংস্কারক উইলিয়াম গ্যারিসন, ‘আংকল টমস কেবিন’ এর লেখক হ্যারিয়েট বিচার স্টো প্রমুখের নেতৃত্বে। ১৮৬০ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হন আব্রাহাম লিংকন। লিংকন আমেরিকার পশ্চিমাংশে দাসপ্রথা প্রসারের বিরোধিতা করেন। ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল শুরু হয় আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট লিংকন ‘দাসপ্রথাবিরোধী ঘোষণা’ জারির মাধ্যমে আমেরিকার দক্ষিণাংশের কনফেডারেট রাজ্যগুলোর দাসদের দাসত্ব মোচন করেন। ১৮৬৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দেশ থেকে দাসপ্রথা বিলোপ করা হয়। দাসপ্রথা বিলুপ্তির পরও আমেরিকার বহু জায়গায় লেখা থাকত ‘কুকুর ও কৃষ্ণাঙ্গ প্রবেশ নিষেধ’। হোটেল, বাস, ট্রেনসহ প্রতিটি জায়গায় পদে পদে তাদেরকে লাঞ্ছিত হতে হতো। বর্ণবাদী নির্যাতনের ইতিহাস ভয়াবহ। এর অর্থ এটা নয় সকল শ্বেতাঙ্গ এর সহযোগী কিংবা এই ব্যবস্থার সুবিধাভোগী। বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের আন্দোলন সবরকম বৈষম্য-নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বড় অনুপ্রেরণা। সেই আন্দোলন নতুন ঐক্য ও পরিচয় তৈরি করেছিল যার সঙ্গে শ্বেতাঙ্গরাও ছিলেন। অবজ্ঞা, অবহেলা, সুযোগের অভাবই যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের একটা বড় অংশকে সহিংসতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। একজন কৃষ্ণাঙ্গ বাবা হওয়ার সময়ই জানতেন, ছেলেকে শেখাতে হবে, পুলিশের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয়। আরও শেখাতে হবে, গ্রেফতার এড়ানোর ফন্দি-ফিকির। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের ফার্গুসন শহরতলির কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনযাপন এমনই। কৃষ্ণাঙ্গরা ফার্গুসনে গাড়ি চালাতে ভয় পান। কারণ যে কোন সময় পুলিশ তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করতে পারে। কৃষ্ণাঙ্গ হলে ‘যে কোন সময় আপনার মৃত্যু হতে পারে, জেলে যেতে পারেন বা জরিমানা গুনতে হতে পারে।’ নিপীড়নের ফল জাগরণ এই নিপীড়নের ফলেই মানবিকবোধ সম্পন্ন সাদা-কালো সব মানুষ জেগে উঠেছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে। সমগ্র আমেরিকাতে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তিগুলোকে উচ্ছেদ করে ফেলা হয়েছে। সম্প্রতি কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ঘটনায় দেশটি জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে ভীষণভাবে সোচ্চার উঠেছে দেশটি। ইতিহাসের গোড়া থেকে সহিংস বর্ণবাদী আচরণ পর্যালোচনা করে ইতিহাস পুনর্র্নির্মাণ করতে চাইছে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত আমেরিকানরা। বিক্ষোভকারীরা বোস্টনে কলম্বাসের একটি মূর্তির শিরñেদ করার পর মেয়র মার্টি ওয়ালশ বলেন, শহর কর্তৃপক্ষ অস্থায়ীভাবে কলম্বাসের স্মৃতিস্তম্ভটি সরিয়ে নেবে এবং এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য পুনরায় মূল্যায়ন করবে। কলম্বাসের জন্য উৎসর্গীকৃত মূর্তিগুলো সরিয়ে নেয়ার জন্য দেশব্যাপী কেন চাপ সৃষ্টি হয়েছে এবং কেন তাকে বর্ণবাদী বলে অভিহিত করা হচ্ছে, তার যথাযথ কারণ দেখিয়েছেন ইতিহাসবিদরা। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তিগুলোর অপসারণ করাটা বর্ণবাদী হিসাবে চিহ্নিত জোটবদ্ধ আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের ১১টি রাজ্যের যুদ্ধের প্রতীক পতাকা এবং তথাকথিত যুদ্ধবীরদের প্রতি উৎসর্গীকৃত স্মৃতিসৌধগুলো থেকে মুক্তির জন্য একটি বর্ধমান আন্দোলনের অংশ। দেশজুড়ে সমালোচক ও আন্দোলনকারীরা যুক্তি দিয়েছেন, কলম্বাস গণহত্যা এবং দাসত্বের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং আদি আমেরিকানদের প্রতি তার সহিংস আচরণের কথা মনে করিয়ে দেন। আমেরিকার সংবাদপত্র দ্য হিল জানিয়েছে, ম্যাসাচুসেটসের বিক্ষোভকারীরা কলম্বাসের মূর্তির শিরñেদ করার কয়েক ঘণ্টা পর ভার্জিনিয়াতে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’র আন্দোলনকারীরা কনফেডারেট প্রেসিডেন্ট জেফারসন ডেভিসের একটি মূর্তি ভেঙে ফেলে। একই দিন বিকেলে মিনেসোটা ক্যাপিটলের বাইরে কলম্বাসের অন্য আরেকটি একটি মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়। মূর্তি ভাঙার কারণ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মাটি ছাপিয়ে এই আন্দোলনের বাতাস যখন ইউরোপের দেশগুলোতে লাগে তখন এটি আরও বেগবান হয়। এখন আন্দোলন শুধু ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ ‘আই ক্যান্ট ব্রিদ’ লেখা প্ল্যাকার্ডের মধ্যে নেই। এই আন্দোলন রূপ নিয়েছে বর্ণবাদবিরোধী কঠিন আন্দোলনে। বিভিন্ন শহরে বর্ণবাদের সঙ্গে জড়িত মানুষের মূর্তি ভেঙে ফেলা হচ্ছে, সড়কের নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে। অতীতের উপনিবেশবাদী, দাস ব্যবসায়ী এবং নৃশংস নেতাদের জন্য যে স্মৃতিস্তম্ভগুলো বানানো হয়েছিল, সেগুলো দেখলে ভয়াবহতার দিনগুলো সামনে আসে। অনেকেরই এই মূর্তিগুলো নিয়ে নানা মত থাকলেও সেগুলো স্ব-স্থানেই এতদিন বিরাজমান ছিল। এবারের প্রতিবাদী আন্দোলন বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। বর্ণবাদ, দাসত্বের সঙ্গে জড়িত বিখ্যাত ব্যক্তিদের মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়েছে, নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, রং ছুড়ে করা হয়েছে প্রতিবাদ। সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য নতুন নতুন শর্ত যুক্ত করা হচ্ছে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মূর্তিই শুধু নয়, তাদের টার্গেট দাস ব্যবসায়ী, বর্ণবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসকদের মূর্তিও। যেমন- এডওয়ার্ড কলস্টন। তিনি দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের অ্যাভন নদীর মোহনায় গড়ে ওঠা ব্রিস্টল শহরটির বিকাশ ও সমৃদ্ধির ইতিহাসের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই জড়িয়ে আছে দাস ব্যবসা। সেই দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যাডওয়ার্ড কলস্টনের নাম। ব্রিস্টল শহরে কয়েক শতাব্দী ধরে তার স্মৃতিকে সম্মানিত করা হয়েছে। ব্রিস্টলকে নিজের শহর মনে করলেও লন্ডনে থেকেছেন অনেক বছর। ব্রিটেনে দাস ব্যবসার একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল রয়াল আফ্রিকান কোম্পানির হাতে। আর ১৬৮৯ সালে এই কোম্পানির ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন কলস্টন। এই যুগে আফ্রিকা থেকে ধরে আনা দাস কেনাবেচা করা হতো। ধারণা করা হয়, ১৬৭২ সাল থেকে ১৬৮৯ সাল পর্যন্ত কলস্টনের জাহাজে করে প্রায় ৮০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ, নারী ও শিশুকে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। তাদের গায়ে এ সি কোম্পানির নামে সিল মেরে আমেরিকাগামী জাহাজে তোলা হতো। শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় তাদের শুইয়ে দেওয়া হতো জাহাজের খোলের মধ্যে। ক্যাপ্টেনদের বলে দেওয়া হতো একেকটি জাহাজ যত ক্রীতদাসকে সুবিধাজনকভাবে বহন করতে পারবে ততজনকেই যেন নেওয়া হয়। তার জীবদ্দশায় লন্ডনই ছিল দাস ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র, তবে কলস্টনের মৃত্যুর পরে ১৭৩০ ও ১৭৪০ সালে ব্রিস্টলই দাস ব্যবসার ক্ষেত্রে লন্ডনের জায়গা নিয়ে নেয়। ১৬৯৮-১৮০৭ সাল পর্যন্ত ব্রিস্টল থেকে মোট ২,১০০টি জাহাজ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের নিয়ে আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করেছিল। আরও পরে লিভারপুল শহরও এ ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্র ছিল। কলস্টন মারা যান লন্ডনে, তবে তার কবর হয় ব্রিস্টলের অল সেইন্টস চার্চে। ব্রিস্টল শহরের বেশ কিছু রাস্তার নামকরণ হয়েছে তার নামে। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকে কেন্দ্র করে দাসত্ব ও বর্ণবাদের অবসানের প্রতিবাদ হিসেবে ৭ জুন কলস্টনের মূর্তির গলায় দড়ি দিয়ে টেনে নামিয়ে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। ব্রিস্টলের অনেক মানুষ অনেক দিন ধরেই এই ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কলস্টনের মূর্তিটি সরিয়ে ফেলার পর অনেকের দাবি, ব্রিটেনে নানা জায়গায় বর্ণবাদ ও দাস ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অনেকের যেসব ভাস্কর্য আছে সেগুলোও অপসারণ করতে হবে। ব্রিস্টলের বাসিন্দা কবি মাইলস চেম্বার্স বলেন, ‘কিছু লোক আছে যারা বুঝতেই পারে না যে সেই দাসত্বের প্রভাব এখনো কিভাবে কৃষ্ণাঙ্গরা তাদের জীবনে অনুভব করেন। দাসদের উত্তরসূরিরা অর্থনৈতিকভাবে এখনো দরিদ্র, মানসিকভাবে তারা নিজেদের নিকৃষ্ট বলে অনুভব করেন, আফ্রিকান-ক্যারিবিয়ান পুরুষরা এখনো বিসদৃশ সংখ্যায় কারাগারে, তারা পড়াশোনায় ভালো করতে পারছেন না, কাজ পাচ্ছেন না বা পেলেও কম বেতন পাচ্ছেন। দাসপ্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেলেও এসব বদলায়নি। সেই ইতিহাসের কারণে আমরা এখনো দাসত্বের অনুভূতি থেকে বের হতে পারিনি। কলস্টনের মূর্তি সরিয়ে ফেললে বা কিছু নাম বদলে ফেললে বর্ণবাদ বা দাস মনোবৃত্তি পাল্টে যাবে না। কিন্তু তখন কৃষ্ণাঙ্গদের উদ্দেশ্যে এটা বলা সহজ হবে যে তোমরা আমাদের সমান, তোমরা ব্রিটিশ, তোমাদের মূল্য আছে এবং তোমাদের সঙ্গে অন্যদের কোনো পার্থক্য নেই।’ যে স্কুলের নাম কলস্টনের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছিল তারাও নাম পরিবর্তনের কথা ভাবছে। ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির দাসত্ব ইতিহাসের প্রফেসর অলিভেট অটিলি বলেন, ‘কলস্টনের মূর্তি নিয়ে এখনো অনেক গবেষণা ও লেখাপড়া করার আছে। কারণ এটি এখনো ব্রিস্টলের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া এই মহাদেশগুলোর বেশির ভাগ ইতিহাস একটি অপরটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত। চাইলেই এগুলোকে আলাদা করা যায় না।’ রবার্ট মিলিগান: ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের জের ধরে লন্ডনের ডকল্যান্ডসের জাদুঘরের বাইরে থেকে ৯ জুন বিখ্যাত দাস ব্যবসায়ী রবার্ট মিলিগানের মূর্তি অপসারণ করা হয়েছে। ১৭৪৬ সালে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী ধনাঢ্য রবার্ট মিলিগান দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন ব্যবসায় দাসদের নিয়োগ দিতেন তিনি। জ্যামাইকাতে তার একটি সুগার কোম্পানিতে ৫২৬ জন দাস কাজ করত। সুগার ছাড়াও তার কফি এবং জাহাজের ব্যবসা ছিল। রবার্ট মিলিগানের মূর্তিটি ১৮১৩ সালে স্থাপন করা হয়। সে সময় ওয়েস্ট ইন্ডিয়া কিম্বর ডেভেলপমেন্টে তার ভূমিকার জন্য এটি স্থাপন করা হয়। তার নামে লাইম হাউজে একটি রোডের নামও রয়েছে। এতদিন ধরে মিলিগানের মূর্তি সরানো না হলেও প্রতিবাদের এই সময় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানায়, জাদুঘরের বাইরের প্রাঙ্গণে মূর্তিটি বহু বছর ধরে অস্বস্তিকরভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। স্থানীয় জনগণের ইচ্ছায় মিলিগানের মূর্তি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান বলেছেন, ‘দাস ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নগরীর সমস্ত মূর্তি সরিয়ে ফেলা এবং রাস্তার নাম বদলে দেওয়া উচিত।’ শহরের বিভিন্ন ল্যান্ডমার্ক- ম্যুরাল, রাস্তার নাম, মূর্তি যেগুলো লন্ডনের বৈচিত্র্য প্রতিফলিত করে তা নিশ্চিত করতে তিনি একটি কমিশন গঠন করেছেন। রবার্ট ক্লাইভ : ইংল্যান্ডের ছোট্ট শহর শ্রুসবেরির কেন্দ্রের খোলা চত্বরে উঁচু বেদিতে দাঁড়িয়ে আছে ব্রোঞ্জের তৈরি রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর থেকে শহরের মানুষ এর অপসারণের জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। ব্রিটেনে তার পরিচয় ‘ক্লাইভ অব ইন্ডিয়া’ নামে। শ্রুসবেরি ছাড়াও ব্রিটিশ সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্র হোয়াইটহলের ডাউনিং স্ট্রিটের পেছনে এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরের সামনে রয়েছে রবার্ট ক্লাইভের আরও একটি মূর্তি। দাবি উঠেছে সেগুলো সরিয়ে ফেলারও। এর অপসারণের জন্য বেশ কয়েকটি আবেদনপত্র খোলা হয়েছে চেঞ্জ-ডট-অর্গ ওয়েবসাইটে। প্রতিটিতেই রবার্ট ক্লাইভকে একজন বর্ণবাদী, লুটেরা এবং দুর্বৃত্ত বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তার মতো মানুষকে মূর্তি বানিয়ে স্মরণ করার কোনো কারণ নেই। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীকে পরাজিত করার মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়েছিল। এরপর কার্যত রবার্ট ক্লাইভ হয়ে উঠেছিলেন ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। ১৭৫৮ সালে তাকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রথম গভর্নর নিযুক্ত করা হয়েছিল। ১৭৬৯-৭০ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে রবার্ট ক্লাইভ এবং তার উত্তরসূরি ব্রিটিশ শাসকদের শাসনকে দায়ী করা হয়। ১৭৬০ সালে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে অন্যতম বিত্তশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন। তার বিরুদ্ধে ছিল অসংখ্য অভিযোগ। নিজের সময়ে এরকম ঘৃণিত একজন ব্যক্তি পরবর্তীকালে কিভাবে আবার ইংল্যান্ডে পুনর্বাসিত হলেন এবং হোয়াইটহলের মতো জায়গায় তার স্মারক মূর্তি বসানো হলো তাই নিয়ে এখন নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। উইনস্টন চার্চিল : ব্রিটেনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন উইনস্টন চার্চিল। ছিলেন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন সাহিত্যিকও। ২০০২ সালের এক জরিপে বিবিসি তাকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রিটন’ বলে উপাধিও দেয়। তবে চার্চিল সব সময় একজন বিতর্কিত ব্যক্তি ছিলেন। বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কখনো তিনি গোপন করেননি। বর্ণবাদী শ্রেণি বিভাগে বিশ্বাস করতেন তিনি। এই শ্রেণি বিভাগে সবার ওপরে ছিল শ্বেতাঙ্গ প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান, তার নিচে শ্বেতাঙ্গ ক্যাথলিক খ্রিস্টান, তাদের নিচে ভারতীয়রা এবং তারও নিচে আফ্রিকানরা। রেড ইন্ডিয়ান বা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের প্রতি শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের নির্মম আচরণের একজন কঠিন সমর্থক ছিলেন চার্চিল। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে বাংলায় দুর্ভিক্ষে এবং দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী মহামারীতে ৩৫ থেকে ৩৮ লাখ মানুষ মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষের সময় চার্চিল দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলায় খাদ্য সরবরাহের পরিবর্তে ভারতের চাল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য পাঠান এবং গ্রিস এবং অন্যান্য জায়গায় ইউরোপিয়ানদের জন্য বিপুল মজুদ গড়ে তোলেন। তিনি বলতেন যে আধপেটা বাঙালির জন্য দুর্ভিক্ষ তেমন কিছু নয়। এখন এই ব্যক্তির মূর্তি রাখতে হচ্ছে পুলিশি পাহারায়। আন্দোলনকারীরা ৭ জুন চার্চিলের ভাস্কর্যে সবুজ রং স্প্রে করে তাকে বর্ণবাদী আখ্যা দেন। আন্দোলনকারীদের হুমকির পর কর্তৃপক্ষ চার্চিলের ভাস্কর্যটি ঢেকে দিয়েছে। এই বিদ্রোহের আগুন খুব সহসাই নিভে যাবে এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। নিপীড়িত মানুষ জেগে উঠেছে। নিপীড়ন বন্ধ করে, তাদেরকে মানুষের মর্যাদা দিলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। আসমানি কিতাবপ্রাপ্ত সব ধর্মের মানুষই বিশ্বাস করেন, তারা সবাই হযরত আদম (আ) ও মা হাওয়ার সন্তান। সবার সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহতায়ালা। মানুষের মর্যাদার মাপকাঠি বংশ মর্যাদা কিংবা শরীরের রঙ বা বর্ণ নয়। আদম (আ) সন্তানদের মধ্যে যারা জ্ঞান ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় এবং আল্লাহর ভয় বা তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত তারাই বেশি মর্যাদার অধিকারী। মানুষকে মানুষের গোলামি থেকে মুক্তি দিতে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনবিধান বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সিনিয়র সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির