post

ভারত উপমহাদেশে কলঙ্কিত কিছু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড

মু. এনামুল হক

০২ সেপ্টেম্বর ২০২১

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়েছে। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটেছে এবং বারবার ঘটেছে। হিংসা, ক্ষমতার রাজনীতি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, বংশীয় রাজনীতি, ধর্মীয়ও মতাদর্শগত দ্বন্দ্বসহ বিভিন্ন কারণে এই ধরনের কলঙ্কিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। হাজারো জনপ্রিয়তা আর যাদের বলিষ্ঠ ভূমিকার মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছিল এবং দেশ ও দেশের জনগণের জন্য যারা সারাজীবন কাজ করেছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য এই দেশের মানুষ আবার তাদেরকে হত্যা করেছে। শুধু রাষ্ট্রপ্রধানের তালিকা করলে এই তালিকা অনেক বড় হবে। ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতের জাতির জনক করমচাঁদ গান্ধী হত্যার মাধ্যমে। ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এই উপমহাদেশের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এক চাপা আতঙ্ক তার জন্ম দেয়। আর এভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশে নিয়মিত বিরতিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ হত্যার শিকার হচ্ছে।

শেখ মুজিবুর রহমান

১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মর্মান্তিক কলঙ্কিত দিন। এই দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বাংলাদেশের লক্ষ জনতার জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সাথে পৃথিবীর অন্য কোনো হত্যার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশে অবস্থান করা পরিবারের একজন সদস্যকেও সেদিন বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। বিদেশে অবস্থান করায় দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র চার বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল। হত্যার শিকার হন শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ তার পরিবারের ১৩ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন ছাত্রনেতা। ক্রমেই তিনি আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতৃত্বের উচ্চপদে আসীন হয়েছিলেন। তার বড় গুণ ছিল তুখোড় বক্তৃতা দেয়ার ক্ষমতা। তাঁর অতুলনীয় নেতৃত্বে বাঙালি জাতি দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও ’৫২, ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ এর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে। অতঃপর ১৯৭১ সালে এসে উপনীত হয়। ১৯৭০ সালের ৭ মার্চ এর ভাষণ এক ঐতিহাসিক ভাষণ, যা বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে প্রস্তুত হতে সাহস জোগায়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিকামী মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠেন নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের নেতা হিসেবে। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালি স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে প্রথমে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর ভিত্তি করে সংবিধান প্রণয়ন করেন এবং সে অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। দারিদ্র্য বেকারত্ব সর্বব্যাপী অরাজকতা এবং সেইসঙ্গে ব্যাপক দুর্নীতি মোকাবেলায় তিনি কঠিন সময় অতিবাহিত করেন। ১৯৭৫ সালের প্রথম দিকে শেখ মুজিবুর রহমান সব দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নিজেকে আজীবন এর জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। এর ৭ মাস পর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পেছনে কিছু সামরিক কর্মকর্তা ও কয়েকজন বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগের সদস্য জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে মূল হোতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাক্তন সহকর্মী খন্দকার মোশতাক আহমেদ। বঙ্গবন্ধুর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাদের দু’জনের মধ্যে তুই-তোকারি সম্পর্ক ছিল। মোশতাক আহমেদ নিজের সহ সকল খুনিকে রক্ষার জন্য ১৯৭৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের সকল পথ বন্ধ করে ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে। শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার সাথে জড়িত কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, খন্দকার আব্দুর রশিদ, শরিফুল হক (ডালিম), মহিউদ্দিন আহমেদ, নূর চৌধুরী, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ ও চৌকস কর্মকর্তা ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বা ইমডেমনিটি আইন বাতিল হয়। যার ফলে বিচারপ্রক্রিয়ার পথ খুলে যায়। বিভিন্ন বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। আর বাকি খুনিরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছে। বিভিন্ন জটিলতার কারণে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

মহাত্মা গান্ধী

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অহিংস মতবাদ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রবক্তা ছিলেন। তিনি সকলের কাছে মহাত্মা গান্ধী নামে সমধিক পরিচিত। তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তিনি ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিদের একজন। ভারত সরকারিভাবে তাঁর সম্মানার্থে তাঁকে ভারতের জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা করেছে। অন্যতম রাজনীতিক মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর যেসব ব্যক্তি তাদের কর্ম দিয়ে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম অবদান হলো স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তোলা। তিনি স্বদেশী আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে ভারতীয়দেরকে বিদেশি বস্ত্র ও পণ্য বর্জন করার জন্য আহ্বান করেন। তিনি নিজেও বিলেতি পণ্য বর্জন করে খাদির চাকা ঘুরিয়ে বস্ত্র তৈরি করে তা পরিধান করতেন। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। নতুন দিল্লির বিরলা ভবনের মাঝে রাত্রিকালীন পথ সভা করা অবস্থায় নথুরাম গডস নামে এক উগ্র হিন্দু তাকে হত্যা করে। গান্ধীজি ছিলেন এক অন্যরকম নেতা, তিনি রক্তপাত পছন্দ করতেন না। প্রাণী হত্যা হবে বলে ডিম পর্যন্ত খেতেন না। যিনি সারা জীবন জীব হত্যার বিপক্ষে ছিলেন অথচ তাকেই হত্যা করা হলো। হিন্দু ধর্মকে তার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। অথচ উগ্র হিন্দুবাদের হাতেই তার প্রাণ গেল। ১৯৪৯ সালে ভারতের আদালতে তাঁর হত্যাকারী নাথুরামকে ফাঁসির আদেশ দেয় এবং ঐ বছরই ১৫ নভেম্বর পাঞ্জাবের আম্বালা জেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

লিয়াকত আলী খান

পাকিস্তানের সেরা শাসক ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তিনি পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন লিয়াকত আলী খান। তিনি কাশ্মির সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৫০ সালে ভারতের সাথে ঐতিহাসিক লিয়াকত-নেহেরু চুক্তি করেন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিণ্ডির কোম্পানিবাগে এক জনসভায় বক্তৃতাকালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। হত্যাকারী খুব কাছ থেকে গুলি করে তাকে হত্যা করে। আর এই আততায়ীকে পথসভার মধ্যে গুলি করে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার পর পাকিস্তানের সরকারের বরাত থেকে বলা হয় হত্যাকারী আফগান বংশোদ্ভূত তার নাম সাইদ আকবর। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনপ্রিয় নেতা লিয়াকত আলী খানের হত্যার রহস্য বা কাদের ষড়যন্ত্রে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তা আজও উদঘাটিত হয়নি। মৃত্যুর পর তাকে শহীদ-এ-মিল্লাত উপাধিতে ভূষিত করা হয়। রাওয়ালপিণ্ডির যে উদ্যানে নিহত হন সে উদ্যানের নামকরণ করা হয় লিয়াকত বাগ। ২০০৭ সালে এই স্থানে পাকিস্তানের আরেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোকে হত্যা করা হয়।

জিয়াউর রহমান

জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন দুর্দান্ত সাহসী দেশপ্রেমিক সেনা ও রাষ্ট্রপ্রধান। ১৯৭০ সালে জিয়াউর রহমান অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় অধিনায়ক হিসেবে চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। স্বভাবতই জনসাধারণের কাছে জিয়াউর রহমান নামটি অপরিচিত ছিল। কিন্তু তিনি তাৎক্ষণিক জাতীয় ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হলেন যখন তিনি ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ এবং যুদ্ধ পরিচালনায় জিয়াউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ১ নং সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে এবং পরে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান নিজেকে অসীম সাহসী যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করে তোলেন এবং সাহসিকতার জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর ক্ষমতায় আসেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে একদল বিপথগামী সেনাসদস্য। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন, ঠিক সেই সশস্ত্র বাহিনী ও জনতার সমন্বয়ে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সিপাহি বিপ্লব ঘটে। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বিচারপতি এ এস এম সায়েমের পদত্যাগের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিধ্বস্ত গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নিষিদ্ধ হওয়া সব রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান নতুন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে বিপথগামী সেনা অফিসারদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন। ২৯ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল মীমাংসার জন্য চট্টগ্রাম যান। ৩০ মে চট্টগ্রাম জিওসি জেনারেল মঞ্জুর অধীনস্থ কিছু সেনা অফিসার এ হামলার নেতৃত্ব দেয়। এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান, কর্নেল মাহবুব, মেজর খালেদ হোসেন, মেজর মোজাফফর ও ক্যাপ্টেন মুসলেউদ্দিনসহ অন্যরা। হত্যাকাণ্ডের মতিউর রহমান মাহবুবকে পলায়নরত অবস্থায় হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে হত্যায় অংশগ্রহণকারী অধিকাংশই সৈন্য আত্মসমর্পণ করেন। নেতৃত্ব প্রদানকারী অফিসাররাসহ জি ওসি মঞ্জুর পলায়নের চেষ্টা করেন। পথিমধ্যে সরকার প্রেরিত বাহিনী কর্তৃক তারা গ্রেফতার হন। পরবর্তীতে একদল উচ্ছৃঙ্খল সৈন্যের হাতে নিহত হন বলে ঘোষণা করা হয় তবে জনমনে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়। সামরিক ট্রাইব্যুনালে জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দায়ে ১৮ জন অফিসারকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড রায় দেয়া হয় এবং কার্যকর করা হয়। আর বাকি পাঁচজনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়।

ইন্দিরা গান্ধী

ইন্দিরা গান্ধী ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর নাম ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী নেহেরু। তার দাদা মতিলাল নেহেরু একজন প্রথম সারির কংগ্রেস নেতা ছিলেন। তাঁর পিতা জওহরলাল নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তার ছেলে রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর পুত্র ও পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী ও নাতি নাতনি রাহুল গান্ধী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। একটি বিষয় অনেকে মনে করেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে মহাত্মা গান্ধীর পারিবারিক সম্পর্ক আছে। আসলে এটা একটা ভুল ধারণা। তিনি ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তারা তিন মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপর ১৯৮৪ সালে আবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী পরিচিত হয়ে ওঠেন তার অভাবনীয়ভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার কঠোর মনোভাবের জন্য। তিনি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। এই যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। এর ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে ও ভারতে তার প্রভাব প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধীকে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবরে দুইজন শিখ দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং গুলি করে হত্যা করে। এর কয়েক মাস আগেই ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দিরে অভিযান চালানো হয় এবং এই অভিযানে অনেককে হত্যা করা হয় এবং ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। অনুমান করা হয় এই ক্ষোভের জের হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীকে তার দেহরক্ষীরা হত্যা করে। ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকারী বেয়ান্ত সিংকে ঘটনাস্থলেই অন্যান্য দেহরক্ষীরা গুলি করে হত্যা করে। হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আর সাতওয়ান্ত সিংকে ১৯৮৯ সালে দিল্লির তেহার জেলে ফাঁসি দেয়া হয়।

রাজীব গান্ধী

মাত্র ৪০ বছর বয়সে ভারতের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হন শ্রী রাজীব গান্ধী। তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম তরুণ প্রধানমন্ত্রী। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর মায়ের মৃত্যুর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থাকার সময় ইতালির যুবতী সোনিয়া মাইনোর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে ১৯৬৮ সালে নয়া দিল্লিতে তিনি সোনিয়ার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই সোনিয়া মাইনোস বর্তমানে গান্ধী পরিবার ও কংগ্রেসের কর্ণধার। ১৯৯১ সালের ২১ মে এক নির্বাচনী জনসভায় আততায়ীর হাতে খুন হন রাজীব গান্ধী। জনসভায় এক নারী তার পায়ে কুর্নিশ করা অবস্থায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এতে ঘটনাস্থলেই রাজীব গান্ধীসহ আরো ১৭ জন নিহত হন। ১৯৮৯ সালে সরকারে থাকা অবস্থায় তিনি শ্রীলঙ্কায় সেনা পাঠিয়ে এলটিটি বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করেন এবং তিনি ঘোষণা করেন আবার ক্ষমতায় গেলে আরো সৈন্য পাঠাবেন। এই কারণে সবাই ধারণা করেন রাজীব গান্ধীর হত্যার পিছনে এল.টি.টির হাত রয়েছে। এই ঘটনায় শ্রীলংকার তামিল টাইগারদের সাত সদস্য শান্তন, নলিনী, পেরারিবলন, মরুগন, রবার্ট পায়াস, জয়কুমার এবং রবিচন্দনকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দেয়া হয়।

জিয়াউল হক

জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানের ক্ষমতায় এসেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর শাসনামলে। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সর্বাপেক্ষা অধিক সময় রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। তিনি ভুট্টো সরকারের বিপক্ষে সামরিক অভ্যুত্থান পরিচালনা করে তাদের উৎখাত করেন এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়। জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতায় এসে বেশ কিছু ইসলামী আইন জারি করেন যদিও তিনি নিজে ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেননি। জেনারেল জিয়াউল হকের ফরমান অনুযায়ী পাকিস্তানে চুরি, মদ্যপান, ব্যভিচার এবং ধর্মীয় বিরোধিতার বিচার শুরু হয় ইসলামী আইন অনুসারে। জিয়াউল হক প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে জাতিসংঘের অধিবেশনে প্রথম কুরআন তিলাওয়াত দিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেন। ১৯৮৮ সালের ১৭ আগস্ট বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা ও দুইজন মার্কিন কূটনীতিকসহ বাহাওয়ালপুরে রহস্যজনক বিমান সংঘর্ষে তিনি নিহত হন। পাকিস্তানের সিনেটর মোশাহিদ হোসাইন জানান জিয়াউল হককে হত্যার পিছনে আমেরিকা এবং পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক প্রশাসন যৌথভাবে কাজ করেছে।

বেনজির ভুট্টো

পাকিস্তানের মতো একটি কট্টরপন্থী দেশের শীর্ষপদে দুবার আরোহণ করে মুসলিম বিশ্বে তাক লাগিয়ে বিশ্বের প্রথম মুসলিম নারী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেনজির ভুট্টো। তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর এবং পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির স্ত্রী। ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯০ এবং ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ দুই মেয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। পাকিস্তানিদের চোখে বেনজির ভুট্টো ছিলেন গণতন্ত্র ও নারী অধিকার রক্ষায় অগ্রনায়ক। সামরিক শাসন কবলিত পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। দুর্বল নেতৃত্ব ও ত্রুটিপূর্ণ শাসনকার্যের দুর্নাম থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘরোয়া ভাবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। বেনজির ভুট্টো একমাত্র ও প্রথম নারী রাষ্ট্রপ্রধান যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সন্তান জন্ম দিয়ে ছিলেন। তবে গত বছর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় নারী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডান সন্তান জন্ম দেন। ২০০৭ সালে প্রায় আট বছর নির্বাসন কাটিয়ে অক্টোবর মাসে দেশে ফেরেন বেনজির ভুট্টো। দেশে ফেরার দিনই তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় তবে সেবার অল্পের জন্য বেঁচে গেলেও মৃত্যু তার পিছু ছাড়েনি। ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে এক নির্বাচনী সভায় আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন এই রাজনীতিবিদ। ১৫ বছর বয়সী বিলাল নামক আত্মঘাতী বোমারু বেনজিরকে লক্ষ্য করে গুলি এবং তারপর নিজের সাথে বহন করা বোমায় নিজেসহ আরো ২০ জনকে হত্যা করে। পাকিস্তানের তালেবান গোষ্ঠীর এই হত্যার দায় স্বীকার করলেও হত্যাকাণ্ডটি কার নির্দেশে হয়েছে তা আজও উদঘাটন হয়নি। এছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশে আরো কিছু রাষ্ট্রপ্রধানকে বিভিন্ন সময় হত্যা করা হয়েছে। ১৯৫৯ সালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী সালমান বন্দরনায়েক। ১৯৬৩ সালে লেবাননের বৈরুতে এক হোটেলে রহস্যজনকভাবে মারা যান অবিভক্ত বাংলার শেষ পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ৫ এপ্রিল ১৯৬৪ সালে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জিগমে দোরজীকে হত্যা করা হয়। এরপর ১৯৭৮ সালের ২৭ এপ্রিল আফগানিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদকে হত্যা করা হয়। ১৯৯৩ সালের পহেলা মে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি রানাসিঙ্গে প্রেমাদাসা এল.টি.টি.ই কর্তৃক আত্মঘাতী বোমার আঘাতে নিহত হন। ভারতীয় উপমহাদেশে এই বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কারণ কী? নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য? ভারতীয় উপমহাদেশে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগের তুলনায় বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যার ঝুঁকি অনেক গুণ বেড়ে গেছে। উদার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়ানো সম্ভব আমার কাছে মনে হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির