post

রেড টেরর

গোলাপ মুনীর

০৪ জুন ২০২১

‘রুশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি’ তথা আরএসডিএলপি ১৯১৭ সালের নভেম্বরে রাশিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দখল করে। এই পার্টির চরমপন্থী অংশের সদস্যদের বলা হয় বলশেভিক বা বলশেভিস্ট। বলশেভিজম হচ্ছে এই বলশেভিকদের এবটি ডকট্রিন বা প্রোগ্রাম। এর দাবি চরম পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে পুঁজিবাদের পতন সাধন। বলশেভিজমের অপর নাম রুশ কমিউনিজ বা সোভিয়েত কমিউনিজম। আবার বলা হয়, ১৯০৩ ও ১৯১৭ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রাশিয়ার বলশেভিকেরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে প্রলেতারিয়েতদের একটি ডিক্টেটরশিপ প্রতিষ্ঠার জন্য যে কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করে তারই নাম বলশেভিজম। সোভিয়েত রাশিয়ায় ‘রেড টেরর’ তথা লাল সন্ত্রাস ছিল বলশেভিকদের পরিচালিত, প্রধানত বলশেভিক গুপ্ত পুলিশ চেকার মাধ্যমে সম্পাদিত একটি রাজনৈতিক নির্যাতন নিপীড়ন ও হত্যার উদ্দেশ্যতাড়িত একটি সন্ত্রাসী অভিযান। রেড টেররের সূচনা ১৯১৮ সালের মাঝামাঝি রুশ গৃহযুদ্ধ শুরুর পর। বলশেভিক নেতা লেনিনকে হত্যার উদ্যোগের পর এই রেড টেরর অভিযান শুরু হয়। রেড টেরর পরিকল্পিত হয় ফরাসি বিপ্লবের জবরমহ ড়ভ ঞবৎৎড়ৎ-এর মডেল অনুসরণ করে। রেড টেরর অভিযানের লক্ষ্য ছিল বলশেভিকদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও বলশেভিক সরকারের জন্য সম্ভাব্য হুমকিতুল্য অন্যসব শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। রেড টেরর অভিযানে অবলম্বিত সন্ত্রাসের মাধ্যমে জনগণ ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে ভীতিপ্রদর্শন করা হতো। অবলম্বিত হতো নির্বিচার হত্যার উপায়।

আরো বিস্তৃত মাত্রায় ‘রেড টেরর’ শব্দবাচ্যটি ব্যবহার করা হতো পুরো গৃহযুদ্ধ সময়ের (১৯১৮-২২) বলশেভিকদের রাজনৈতিক নির্যাতন বুঝাতে। এর বিপরীতে রয়েছে বলশেভিক শাসনবিরোধী রুশ ও অ-রুশ গোষ্ঠীর হোয়াইট আর্মির বলশেভিকসহ অন্যান্য রজনৈতিক শত্রুর বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘হোয়াইট টেরর’। বলশেভিকদের ‘রেড টেরর’ অভিযানের শিকারের পরিণত হওয়ার লোকসংখ্যা সম্পর্কে ঐকমত্যভিত্তিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। একটি সূত্র মতে, রেড টেররের নির্যাতন ও দমন-পীড়নের শিকার হয় ১৩ লাখ মানুষ। অপর একটি সূত্র মতে, ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর ও ১৯২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রতিবছর এই সন্ত্রাসী অভিযানে হত্যার শিকার হয় ২৮ হাজার লোক। রেড টেররের প্রথম দিকটায় হত্যা করা হয় কমপক্ষে ১০ হাজার লোককে। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হিসাব মতে, রেড টেররের লোকক্ষয় ঘটে এক লাখ। আবার অন্যরা বলেন, এ সংখ্যা দুই লাখ। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এই রাজনৈতিক সন্ত্রাসের প্রধান ভূমিকায় ছিল সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ বাহিনী চেকা ও এর ফ্যানাটিক্যাল লিডার ফেলিক্স ডিজারঝিন্সকি। কোর এজেন্টেরা সেইসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে লক্ষ্যে পরিণত করে, যারা বলশেভিকদের দৃষ্টিতে সরকার ও বলশেভিক নীতির প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত। তাদের টার্গেটের মধ্যে ছিল: জারবাদী, উদারপন্থী, অ-বলশেভিক সমাজবাদী, গির্জার যাজকমণ্ডলীর সদস্য, কুলাক (সচ্ছল কৃষক), বিদেশী ও সব ধরনের রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী। রেড টেরর চলার সময় চেকার আকার ও তাদের কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়। রেড টেররের সত্যিকারের প্রভাবের পরিমাণ নির্ধারণ খুবই জটিল। বলশেভিক সরকারি তথ্য মতে, রেড টেররের প্রথম বছরে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে সাড়ে ৮ হাজার লোকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর দশগুণ মানুষকে আটক, জিজ্ঞাসাবাদ, গ্রেফতার ও বিচার করা হয়। কিংবা পাঠানো হয় কারাগার অথবা বন্দিশিবিরে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার লোকদের সঠিক সংখ্যা নিঃসন্দেহে এর চেয়ে অনেক বেশি। সম্ভবত সেই সংখ্যা পৌঁছেছিল ছয় অঙ্কের সংখ্যায়।

ইতিহাসবিদেরা এই রেড টেররের উৎস ও এর সূচনাকাল সম্পর্কে দীর্ঘকাল নানা অভিমত প্রকাশ করেছেন। অনেকের বিশ্বাস এই রেড টেরর অভিযানের শুরু ১৯১৮ সালের গ্রীষ্মে। তখন লেনিনের শাসনের বিরোধিতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে, যেখান থেকে প্রতিবিপ্লব সংঘটিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। তখন অনেক মা-বাবার মধ্যে বলশেভিক-বিরোধী ক্রমবর্ধমান চেতনা কাজ করছিল। আর ১৯১৭ সালের অক্টোবরে বলশেভিকদের সমর্থন কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে বড় বড় শহরের শিল্প এলাকা ও মিলিটারি গ্যারিসনে। এসব স্থানের বাইরে বলশেভিকদের সমর্থন ছিল সীমিত। জারের আমলে অনেক রুশের প্রত্যাশা ছিল সবকিছুর উপরে একটি রাজনৈতিক ফোরাম ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি’ প্রতিষ্ঠা, যা হবে একটি নির্বাচিত আইনসভা। এর ক্ষমতা থাকবে আইন পাস কিংবা সংশোধনের। সংস্কারবাদী ও বিপ্লবী উভয় গ্রুপেরই প্রত্যাশা ছিল এটি। এই কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির প্রতি বিপ্লবী গ্রুপের ব্যাপক সমর্থন ছিল। এদের মধ্যে কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্র্যাট, সমাজবাদী বিপ্লবী, মেনশেভিক ও এমনকি উদারমনা বলশেভিকও। ১৯১৮ সালে জানুয়ারিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত এই কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বাতিল করা হয়। এর পরের সপ্তাহ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর দমন-পীড়ন, ১৯১৮ সালের মার্চে ব্যাপকভাবে রুশও ব্রেস্ট-লিটভস্ক টেরিটরির নাগরিকদের আত্মসমর্পণ, মে মাসে চেক লেজিয়নের বিদ্রোহ এবং জুনে ওয়ার কমিউনিজমের সূচনা ইত্যাদি সবকিছু মিলে এই নয়া সরকারের বিরোধিতা ব্যাপক বেড়ে যায়। এই বিরোধিতা তুঙ্গে ওঠে ২০১৮ জুলাইয়ের দিকে, তখন বলশেভিকেরা দমন-পীড়ন চালায় মস্কো ও অন্যান্য শহরে বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারি পার্টির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভকারীদের ওপর। এ সময় বলশেভিকেরা সমেঝোতা করতে ব্যর্থ হয় এমনকি এর ঘনিষ্ঠ মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেও। এর এক সপ্তাহ পর, চেকা অ্যাজেন্টেরা একাতেরিনবার্গে নির্মমভাবে হত্যা করে দ্বিতীয় নিকোলাস জার ও তার পরিবারের সদস্যদের। এই ঘটনাও অনেককে আহত করেছিল। নিকোলাস জার ও তার পরিবার সদস্যদের নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড জন্ম দেয় কমিউনিস্ট শাসনের আরেক কালো অধ্যায়ের। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে কমিউনিস্টরা কতটুকু নৃশংস হতে পারে, এই হত্যাকাণ্ড তারই এক ঐতিহাসিক উদাহরণ।

রেড টেরর অভিযান জোরদার করে তোলায় ১৯১৮ সালের আগস্ট একটি উল্লেখযোগ্য মাস। এই সময়ে প্রতিবিপ্লবী গোষ্ঠী ‘হোয়াইট আর্মি’র গঠন এবং কৃষকদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভ বলশেভিকদের সমধিক বিক্ষুব্ধ করে তোলে। হোয়াইট আর্মি পরিচিত হোয়াইট ব্রিগেড বা হোয়াইট গার্ড নামেও। হোয়াইট আর্মি রুশ গৃহযুদ্ধে বলশেভিক রেড আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য। সে যা-ই হোক লেনিন রেড টেররের সময় প্রতিবিপ্লবী হোয়াইট আর্মির বিরুদ্ধে ‘রাথলেস মাস টেরর’ ও ‘মার্সিলেস স্ম্যাশিং’-এর চালাতে বলেছিলেন। ৯ আগস্টে বলশেভিক এই নেতা জারি করেন সরকারি আদেশ অমান্য করার অপরাধে ১০০ বিদ্রোহী কুলাকের (সচ্ছল কৃষকের) বিখ্যাত ফাঁসির আদেশ। ১৭ আগস্ট পেত্রোগ্রাদ চেকা লিডার মইসি ইউরিটস্কিকে হত্যা করে ক্যানেজিসার নামের এক ইয়ং ক্যাডেট অফিসার। ইউরিটস্কির হত্যা ছিল ক্যানেজিসারের বন্ধুকে চেকার হত্যার প্রতিশোধ। এর পনেরো দিন পর লেনিন মস্কোর একটি কারখানা পরিদর্শনে যান। তখন ফানিয়া কাপলান নামের এক তরুণী জনতার ভিড় থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে বলশেভিক নেতা লেনিনের বুকে ও কাঁধে গুলি করেন। গুলিতে আহত লেনিনকে চিকিৎসা দিয়ে সারিয়ে তোলা হয়। কাপলানকে গ্রেফতার, জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের পর গুলি করে হত্য করা হয়। ঘটনার পর এই হত্যাচেষ্টার কারণ জানা যায় তার চিঠি থেকে। চিঠিতে তিনি লিখেন: : I do not think I succeeded in killing him. If I regret anything, it is only that. He is a traitor to the Revolution. I lay the responsibility for the treacherous peace with Germany and the dissolution of the Constituent Assembly at his feet.”

তবে এটি স্পষ্ট হয়ে যায়, এই হত্যাচেষ্টা এককভাব চালিয়েছেন কাপলান একা। তারই প্রচেষ্টা ছিল বাম সমাজবাদী বিপ্লবী দল ও অন্যান্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বলশেভিকবিরোধী সন্দেহে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর পরিচালিত সন্ত্রাসের কারণে। ১ সেপ্টেম্বর বেশ ক’জন বলশেভিক নেতা ও চেকা কমান্ডার প্রতিবিপ্লবীদের হুমকি প্রশ্নে প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে বলেন, এদের মোকাবেলায় কৌশল হিসেবে সন্ত্রাস অবলম্বন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ৫ সেপ্টেম্বর সেন্ট্রাল কমিটি এক ডিক্রি জারি করে। এই ডিক্রিতে চেকার প্রতি আহ্বান জানানো হয়, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নকে শ্রেণিশত্রু থেকে রক্ষা করতে হবে, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে বন্দিশিবিরে রাখতে হবে।’ এই ডিক্রিতে আরো আদেশ দেয়া হয়, সন্দেহভাজন প্রতিবিপ্লবীদের গুলি করে মেরে ফেলতে হবে এবং নিহত ব্যক্তির নাম ও হত্যার কারণ জনসমক্ষে জানাতে হবে। সোভিয়েত কমিশার, গ্রেগরি পেটরোভস্কি সন্ত্রাস সম্প্রসারণের আহ্বান জানান। ১৯১৮ সালের অক্টোবরে চেকা কমান্ডার মার্টিন লেটসিস রেড টেররকে শ্রেণিযুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট করেন। তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘আমরা বুর্জোয়াদের ধ্বংস করছি একটি শ্রেণী হিসেবে’। রেড টেররের প্রথম শিকার ছিল ‘সোশ্যালিস্ট রেভোলিশনারিজ’ (এসআর); এর সাথে কাপলান নিজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এটি ছিল ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত রাশিয়ার এক বিপ্লবী পার্টি। বহু বছর ধরে এটি ছিল রাশিয়ার বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের এই দলটি সক্রিয় ছিল। তখন এদের অনেকেই যোগ দিয়েছিল হোয়াইট মুভমেন্টে। এরা ছিল সমাজবাদী, তবে মার্কসবাদী নয়। এরা চলতো রাশিয়ার পপুলিস্ট রেভুলিউশনারি ট্র্যাডিশনে। এরা রাশিয়ার কৃষকদের বিবেচনা করতো বিপ্লবের স্পষ্ট উৎস হিসেবে। এরাও প্রয়োজনে আতঙ্ক সৃষ্টি ও সন্ত্রাস পরিচালনায় বিশ্বাসী ছিল।

সে যা-ই হোক, উল্লিখিত ডিক্রি জারির পরবর্তী কয়েক মাসে ৮০০ এসআর সদস্যকে হত্যা করা হয়। হাজার হাজার সদস্যকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়, নয়তো আটকে রাখা হয় শ্রমশিবিরে। এরই মধ্যে রেড টেররের সম্প্রসারণ ঘটে। বলশেভিক পার্টি ও এর নীতির প্রতি হুমকি যে কোনো ব্যক্তি, সাবেক জারপন্থী, লিবারেল, মেনশেভিক, রুশ অর্থোডক্স চার্চের সদস্য, বিদেশী, লাভজনক খাবার ও ফল মজুদদার-এদের সবাইকে রেড টেররের টার্গেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যেসব কৃষক রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণের বিরোধী তাদেরকেও হত্যার শিকার করা হয়। পরবর্তী সময়ে যেসব কারখানাশ্রমিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, কিংবা ধর্মঘট করার সাহস দেখিয়েছে, তাদেরকেও রেড টেররের টার্গেট করা হয়। বিপ্লবের শত্রু কারা, আর মিত্রই বা কারা- সে সংজ্ঞা যখন আরো সম্প্রসারিত করা হলো, তখন চেকা বাহিনীও সম্প্রসারিত করা হলো। শুরুতে এটি ছিল কয়েকশ জনের একটি ছোট্ট বাহিনী। ১৯১৮ সালের শুরুর দিকে মাত্র দুই বছরে এটি হয়ে ওঠে সোভিয়েত ইউনিয়নের বড় বড় বাহিনীগুলোর একটি। তখন এর সদস্য-সংখ্যা দাঁড়ায় দুই লাখ। রেড টেররের সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাস শিগগিরই জারবাদী ও ১৯০৫ সালের এসআর-এর সন্ত্রাসের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। রেড টেররের মাধ্যমে চেষ্টা চলতো সাধারণ রুশদের আনুগত্য আদায় কিংবা বিরোধীদের অপসারণের লক্ষ্যে। সন্ত্রাসের পদ্ধতি-প্রক্রিয়া কী হবে, সে দায়িত্ব দেয়া হয় চেকার ওপর। তখন যে কোনো ব্যক্তির ওপর চাইলেই নিপীড়ন চালানো হতো কিংবা গ্রেফতার করা হতো। আগের সরকারের সাথে কারো দূরতম সম্পর্ক থাকলে, কিংবা প্রকাশ্যে কখনো বলশেভিক বা লেনিনের বিরুদ্ধে কোনো কথা উচ্চারণ করে থাকলে- তার রক্ষা নেই।

সন্দেহভাজন প্রতিবিপ্লবী ও দলত্যাগীেেদর আটক রাখার জন্য বলশেভিকেরা আবার চালু করে প্রত্যন্ত এলাকার কারাগার ও শ্রমশিবির ‘কাতরগাস’। জার সরকারের নিরাপত্তা সংস্থার লোকেরা এই কারাগার ও শ্রমশিবির পরিচালনা করতো। জাহাজে করে হাজার হাজার বন্দী সেখানে নিয়ে যাওয়া হতো। স্টালিন ১৯৩০-এর দশকে এই শ্রমশিবির নেটওয়ার্ককে পরিণত করে কুখ্যাত বাধ্যতামূলক শ্রমশিবির ‘গুলাগ’-এ। সরকারি পরিসংখ্যান মতে সংখ্যা অনেক কম বলা হলেও ইতিহাসবিদদের মতে, রেড টেররের সময় এক লাখ লোককে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে গৃহযুদ্ধে নিহতদের সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে রেড টেররের প্রকৃতি ও অপরিহার্যতা নিয়ে। রিভিশনিস্ট ও লিবারটারিয়ান ইতিহাসবিদদেরা এটিকে দেখেন একটি সময়ের প্রয়োজনীয় সৃষ্টি হিসেবে। ১৯১৮ সালের প্রথমদিকের মাসগুলোতে রাশিয়াজুড়ে যে বলশেভিকিজম-বিরোধী টেরোরিজম ও বিরোধিতা ছড়িয়ে পড়েছিল তারই উদ্বেগ ও ভীতির কারণেই রেড টেরর সূচিত হয়েছিল। পাশ্চাত্যের অনেক উদার (লিবারেল) ও রক্ষণশীল (কনজারভেটিভ) ইতিহাসবিদ এর বিপরীত দাবি করেন, সন্ত্রাস ও ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে বলশেভিক আদর্শ ও পদ্ধতি (আইডিওলজি ও মেথডোলজি) হচ্ছে মজ্জাগত বিষয়। বলশেভিক আন্দোলন এমনিতেই বিপ্লবী উত্তাপে উত্তপ্ত। এরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে কেবল সন্ত্রাস ও ভীতি সৃষ্টির উপায় অবলম্বনের মধ্য দিয়ে। বলশেভিক সরকার নীতি ও সংস্কার আরোপ করতে পারে শুধু দমন-পীড়ন ও শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এই মতের সমর্থক ইতিহাসবিদের বিশ্বাস রেড টেররের বীজ বপন করা হয়েছিল মধ্য-১৯১৮-এর বলশেভিকবিরোধী সন্ত্রাস শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেই। আগস্টে লেনিনের ওপর গুলি করার পর রেড টেররের আনুষ্ঠানিক সম্প্রসারণ ও পদ্ধতি জোরালো করে তোলার কাজটি সম্পন্ন করা হয়েছিল।

ইতিহাসবিদ Jamie Bishe-এর অভিমত: Bolshevik terror crept out of European Russia like a biblical pestilence, months before Dzerzhinsky publicly declare ‘We stand for organized terror’ and an official government terror campaign was formalized by the order ‘On Red Terror’ in September 1918. Arbitrary arrests, mass shootings, torture and imprisonment were an integral element of Bolshevik policy long before anti-Bolshevik armies gathered.” অর্থাৎ তার অভিমত হচ্ছে: ‘বলশেভিক টেরর একটি বাইবেলীয় মহামারীর মতো ইউরোপীয় রাশিয়া থেকে নীরবে ছড়িয়ে পড়ে; জারজিনস্কির জনসমক্ষে দেয়া ‘We stand for organised terror’ ঘোষণা ও ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরের ‘অন রেড টেরর’ নামের আনুষ্ঠানিক সরকারি আদেশের কয়েক মাস আগেই। বলশেভিকবিরোধী আর্মি সংগঠিত হওয়ার অনেক আগেই এলোপাতাড়ি গ্রেফতার, নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, নির্যাতন ও কারাগারে আটক রাখা ছিল বলশেভিক নীতির অবিচ্ছেদ্য উপাদান।’ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির