post

লক্ষ্য অর্জনের পথে

মু. রাজিফুল হাসান

০৩ জুলাই ২০২০

[শেষ পর্ব] অতঃপর মুসলিম বাহিনী বনু কুরাইজার অভিমুখে রওনার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। এ সময় হযরত আলী রা.-এর নেতৃত্বে একটি ছোট অগ্রবর্তী দলকে বনু কুরাইজায় প্রেরণ করেন রাসূল সা.। হযরত আলী রা. যখন বনু কুরাইজার দুর্গের নিকট পৌঁছালেন তখন বনু কুরাইজার লোকজন রাসূল সা. সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করেছিল। এসময় হযরত আলী রা. রাসূলকে সা. নিয়ে কটূক্তিমূলক বাক্য শুনে ফেলেন। অতঃপর আলী রা. ফেরার পথে রাসূল সা.-এর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি বলেন: ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, এইসব জঘন্য লোকদের কাছে আপনার যাওয়া উচিত নয়।’ রাসূল সা. বলেন, ‘কেন? মনে হয় তুমি তাদের কাছ থেকে আমার সম্পর্কে কোনো কটুবাক্য শুনেছ।’ আলী রা. বলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, সত্যই তাই।’ রাসূল সা. বলেন, ‘আমাকে দেখলে তারা ওই ধরনের কিছুই বলতো না।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম) এদিকে বনু কুরাইজা মুসলমানদের আগমনের বিষয়টি বুঝতে পেরে দূরের দুর্গের ভেতরে উঁচু পাহাড়ে অবস্থান নেয়। তখন হুয়াই ইবনে আখতাব তার ওয়াদা রক্ষার্থে বনু কুরাইজার সাথে দুর্গে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে রাসূল সা.-এর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী বনু কুরাইজার নিকট পৌঁছে যায়। তখন রাসূল সা. বনু কুরাইজাকে উদ্দেশ করে বললেন: ‘হে বানরের ভাইয়েরা, আল্লাহ তোমাদের লাঞ্ছিত করেছেন তো? তার শাস্তি ভোগ করছো তো?’ জবাবে তারা বলল: ‘হে আবুল কাসিম, তোমার তো কিছুই অজানা নেই।’ ‘আবুল কাসিম’ ছিল রাসূল সা.-এর একটি উপনাম। উল্লেখ্য, ইহুদিরা মুহাম্মদ সা.কে কখনো রাসূলুল্লাহ বলে সম্বোধন করত না। কারণ তাদের ধারণা মতে রাসূলুল্লাহ বলে সম্বোধন করলে নবুয়তের প্রতি স্বীকৃতি দেয়া হয়ে যায়। তাই তারা রাসূলকে সা. সম্বোধন করার ক্ষেত্রে উপনাম ব্যবহার করত। এ সময় মুসলিম বাহিনী বনু কুরাইজা দুর্গের পার্শ্ববর্তী ‘আত্তা’ নামক কূপের নিকট তাঁবু গাড়লেন। মদিনা শহর হতে দলে দলে আগত মুসলমানরা ক্রমান্বয়ে তাঁবুতে এসে জড়ো হতে লাগলো। এশার সালাত পর্যন্ত মুসলমানদের আগমন চললো এ সময় বনু কুরাইজার আসার পথে অনেক সাহাবী আসর সালাত, আবার কেউ কেউ আসর ও মাগরিবের সালাত কাজা করে ফেলেন। মূলত রাসূল সা.-এর পক্ষ হতে সাহাবীদের বনু কুরাইজায় গিয়ে আসরের নামাজ পড়ার যে কথা বলেছিলেন, তার উপর আমল করতে গিয়ে কিছু সাহাবী বনু কুরাইজায় পৌঁছা পর্যন্ত কোনো নামাজ পড়লেন না। আবার অনেক সাহাবী মাঝপথেই নামাজ পড়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সাহাবীগণ বিষয়টি রাসূল সা.-এর নিকট উপস্থাপন করলে তিনি দুই দলের সিদ্ধান্তকেই সঠিক বলে মত প্রকাশ করেন। বনু কুরাইজার এই অবরোধে ৩০০০ জন সাহাবী অংশ নেয়, যাদের সাথে ছিল ৩০টি উট। এভাবে বনু কুরাইজার লোকজন অবরোধ অবস্থায় ২৫ দিন অতিবাহিত করার পর যখন বুঝতে পারলো যে রাসূল সা. যুদ্ধ না করে কিছুতেই ফিরে যাবেন না। তখন তাদের নেতা কাব ইবনে আসাদ গোত্রের লোকজনকে ডেকে বললো: ‘হে ইহুদিগণ শোন! তোমাদের ওপর কি মুসিবত এসেছে দেখতে পাচ্ছ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আমি তোমাদের কাছে ৩টি প্রস্তাব রাখছি। এর যেকোনো একটি গ্রহণ করতে পারো।’ জবাবে তারা বলল: ‘সে প্রস্তাবগুলো কী?’ কাব ইবনে আসাদ বলল: ‘মোহাম্মদকে আমরা সবাই অনুসরণ করি ও মেনে নিই। আল্লাহর কসম তিনি যে নবী তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট। আমাদের ধর্মগ্রন্থেও তার সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। এভাবে আমরা আমাদের নিজের এবং স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির জান ও মালের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হতে পারবো।’ এই প্রস্তাব শোনার পর বনু কুরাইজার লোকজন বলল: ‘আমরা কখনও তাওরাতের কর্তৃত্ব অস্বীকার করব না এবং তার বিকল্পও গ্রহণ করব না।’ জবাব শোনার পর কাব ইবনে আসাদ দ্বিতীয় প্রস্তাবটি এভাবে উপস্থাপন করেন যে: ‘এটা যদি না মানো তাহলে এসো আমরা আমাদের স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের সবাইকে হত্যা করি। তারপর তরবারি নিয়ে মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে লড়াই করি। তখন আমাদের পেছনে কোনো ঝামেলা ও দায় দায়িত্ব থাকবে না। তারপর আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মদের মধ্যে একটি চূড়ান্ত ফায়সালা না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে থাকবো। যদি আমরা নিহত হই তাহলে আমাদের বংশধরদের পরিণাম সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই মরতে পারব। আর যদি জয়লাভ করি তাহলে নতুন করে স্ত্রী এবং সন্তানাদিও লাভ করতে পারব।’ দ্বিতীয়ে প্রস্তাবটির জবাবে তারা বলল: ‘এই নিরীহ প্রিয়জনদেরকে মেরে ফেলবো এও কি সম্ভব? ওরাই যদি না থাকল তাহলে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কী? এবার কাব ইবনে আসাদ সর্বশেষ ও তৃতীয় প্রস্তাবটি উপস্থাপন করে বলেন: ‘এটাও যদি অস্বীকার করো তাহলে আর একটা উপায় অবশিষ্ট থাকে। আজ শনিবারের রাত। সম্ভবত মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীগণ আজকে আমাদের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকবে। তাই এসো আমরা আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে মুহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের হত্যা করি।’ জবাবে তারা বলল: ‘আমরা কি এভাবে শনিবারের অমর্যাদা করবো? এদিনে আমাদের পূর্ববর্তীরা যা করেনি তাই করবো? অবশ্য কিছু সংখ্যক লোক করেছিল। তার ফলে তাদের চেহারাও বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো তা তোমাদের অজানা নেই।’ এবার কাব ইবনে আসাদ বলল: ‘আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে একটি লোকও এমন জন্মেনি, যে সারা জীবনে একটি রাতের জন্যও স্থির ও অবিচল সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।’ এভাবে আলাপ-আলোচনা করেও কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি বনু কুরাইজার ইহুদিরা। অতঃপর তারা রাসূল সা.-এর নিকট এই মর্মে বার্তা পাঠালো যে: ‘আপনি আবু লুবাবা ইবনে আবদুল মুনযিরকে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন। তার সাথে আমরা কিছু পরামর্শ করবো।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম) আবু লুবাবা হলো এক আনসারি সাহাবী, যার সাথে বনু কুরাইজার ইহুদিদের পূর্ব থেকেই সুসম্পর্ক ছিল। আবু লুবাবা বনু কুরাইজায় গেলে তারা তাকে ঘিরে সমবেত হলো এবং বলল: ‘হে আবু লুবাবা, তুমি কি মনে করো মুহাম্মদের ফায়সালাই আমাদের মেনে নেয়া উচিত?’ জবাবে আবু লুবাবা বলল: ‘হ্যাঁ’। অতঃপর আবু লুবাবা তার নিজের গলায় হাত দিয়ে ইশারায় তাদেরকে বোঝালো যে, তাদের জন্য রাসূল সা.-এর ফায়সালা হলো মৃত্যু। উল্লেখ্য, এ কাজটি তিনি মনের অজান্তেই করে ফেলেছিলেন। আবু লুবাবা- ইহুদিদের শাস্তির বিষয়ে রাসূল সা.-এর সিদ্ধান্তের বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন আবু লুবাবা। তবে এ সিদ্ধান্ত রাসূল সা. প্রকাশ করার পূর্বে অন্য কেউ প্রকাশ করাটা নিঃসন্দেহে একটি অন্যায়। আর আবু লুবাবা তার নিজের অজান্তেই নিজের গলায় হাত দিয়ে ইঙ্গিত করার মাধ্যমে এই কাজটি করে ফেলেছিলেন। তবে পরক্ষণেই তিনি তার ভুল বুঝতে পারলেন এবং এ বিষয়ে তিনি বলেন: ‘আমি তৎক্ষণাৎ উপলব্ধি করলাম যে আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছি।’ অতঃপর আবু লুবাবা মসজিদে নববীতে চলে গেলেন এবং নিজেকে একটি খুঁটির সাথে বেঁধে বললেন: ‘আমি যে ভুল করেছি তা আল্লাহ আমাকে মাফ করে না দেয়া পর্যন্ত আমি এই স্থান থেকে নড়বো না। আমি আল্লাহর কাছে ওয়াদা করছি বনু কুরাইজার মাটি আর মাড়াবো না, যে মাটিতে আমি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, সেখানে আমি আর কখনো কাউকে মুখ দেখাবো না।’ এদিকে আল্লাহর রাসূল সা. আবু লুবাবার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তার বিষয়ে অবহিত হলেন এবং বললেন: ‘সে যদি আমার কাছে আসতো তাহলে আমি তার জন্য ক্ষমা চাইতাম। কিন্তু সে যখন এরূপ প্রতিজ্ঞা করেই ফেলেছে তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করা পর্যন্ত আমি তাকে মুক্ত করতে পারি না।’

আবু লুবাবা মসজিদে নববীতে খুঁটির সাথে নিজেকে ৬ দিন বেঁধে রাখে। অতঃপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমার ঘোষণা এলে সাহাবীরা তার বাঁধন খুলতে যায়। এ সময় আবু লুবাবা বলে উঠলো: ‘রাসূলুল্লাহ সা. নিজ হাতে মুক্ত করে না দিলে আমি নিজেকে মুক্ত করবো না।’ এ কথা জানার পর রাসূল সা. ফজরের নামাজে যাওয়ার মুহূর্তে তার বাঁধন খুলে দেন। উল্লেখ্য, ইহুদিদের মৃত্যুর ফায়সালার ব্যাপারে ইতোমধ্যে আবু লুবাবা কিছুটা অনুধাবন করেছিলেন। আর এই অনুধাবনের ভিত্তি হলো- ইতোমধ্যে অবরুদ্ধ বনু কুরাইজার শাসক ইবনে কায়েস রাসূল সা.-এর নিকট গিয়ে ইতঃপূর্বে বনু নাজিরকে যে শর্তে প্রাণভিক্ষা দেয়া হয়েছিল সেই একই শর্তে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল। তবে রাসূল সা. তাতে রাজি হননি। অতঃপর শাসক ইবনে কায়েস বলেছিলেন: ‘তাহলে শুধু আমাদের প্রাণভিক্ষা দিন এবং আমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদেরকে আমাদের হাতে সমর্পণ করুন। অতঃপর আমাদের বিতাড়িত করে দিন। উটের পিঠে করে কোনো প্রকার মালামাল আমরা নিতে চাই না।’ এই প্রস্তাবও রাসূল সা. প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তার ফায়সালা মেনে নেয়ার প্রতি গুরুত্ব দেন। (জারকানি প্রণীত- শরহুল মাওয়াহেব) রাসূল সা. শাস ইবনে কায়েসের করা দুটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার প্রেক্ষাপটে আবু লুবাবা ধরেই নিয়েছিলেন যে হত্যাই হলো তাদের (বনু কুরাইজার) জন্য ফায়সালা। আবু লুবাবার এই ইঙ্গিত পেয়ে বনু কুরাইজার আর কোনো আশা রইলো না। এদিকে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ক্রমান্বয়ে বনু কুরাইজার মনে মুসলমানদের ভয় প্রবল করে দিলেন। তারা মানসিকভাবে একেবারেই সাহসহীন হয়ে যায় যখন হযরত আলী রা. এবং হযরত জোবায়ের রা. বনু কুরাইজার বসতির দিকে এগিয়ে যান। এ সময় হযরত আলী রা. বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন: ‘হে ঈমানদার সৈন্যরা, তোমরা শোনো, আর দেরি নয়। আল্লাহর শপথ, এবার আমিও তাই পান করব হযরত হামযা রা. যা পান করেছিলেন (অর্থাৎ এ দুর্গ জয় করব)।’ অতঃপর বনু কুরাইজা তড়িঘড়ি করে রাসূল সা.-এর নিকট এসে নিজেদের সমর্পণ করে বলল: ‘আপনি যা ভালো মনে হয় তাই করুন।’ অথচ তখনও তাদের দুর্গের ভেতর পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী মজুদ ছিল এবং পর্যাপ্ত পানির জন্য ছিল কূপের ব্যবস্থা। আর পক্ষান্তরে মুসলমানদের অবস্থান ছিল দুর্গের বাইরে। যেখানে ছিল হাড়কাঁপানো শীত, ক্ষুধার কাতরতা এবং টানা যুদ্ধ করার ফলে শারীরিক ক্লান্তি। (আর রাহিকুল মাখতুম)

এদিকে বনু কুরাইজার এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে পেরে আউস গোত্রের লোকজন রাসূল সা.-এর নিকট এসে বলল: ‘হে আল্লাহর রাসূল, বনু কুরাইজা আমাদের মিত্র। খাযরাজ গোত্রের মোকাবেলায় তারা আমাদের সহায়তা করে থাকে। খাযরাজের মিত্রের (বনু কাইনুকার) ক্ষেত্রে আপনি কি আচরণ করেছেন তাতো আপনার জানা আছে।’ উল্লেখ্য, ইতঃপূর্বে খাজরাজ গোত্রের অনুরোধে তাদের পূর্বেকার মিত্র বনু কাইনুকার লোকজনকে প্রাণভিক্ষা দিয়েছিলেন রাসূল সা.। আর এবার আউস গোত্রের লোকজন তাদের পূর্বেকার মিত্র বনু কুরাইজার প্রাণভিক্ষা চাইলো রাসূল সা.-এর নিকট। আউস গোত্রের লোকজনের কথা শুনে রাসূল সা. বললেন: ‘হে আউস গোত্রের লোকজন, আমি যদি তোমাদের একজনকে সালিশ নিয়োগ করি তবে তাতে তোমরা রাজি আছো তো?’ তারা বলল: ‘হ্যাঁ’। অতঃপর রাসূল সা. বললেন: ‘সাদ ইবনে মুয়াযকে আমি সালিশ নিযুক্ত করলাম।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম) এদিকে সাদ ইবনে মুয়ায রা. আহত অবস্থায় মসজিদে নববীর একটি তাঁবুতে অবস্থান করছিলেন। এ সময় সাদের রা. গোত্রের লোকজন একটি গাধার পিঠে নরম বিছানা বিছিয়ে তার নিকট হাজির হলো। অতঃপর সাদকে রা. রাসূল সা.-এর নিকট নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় সাদের রা. নিজ গোত্র আউসের লোকজন তাকে উদ্দেশ্য করে বলল: ‘হে সাদ, তোমার মিত্রদের সাথে সদয় আচরণ করো। তোমাকে সালিশ নিয়োগ করেছেন এই জন্য যাতে তুমি তাদের প্রতি সহৃদয় আচরণ করো।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম)

সাদ ইবনে মুয়ায রা. রাসূল সা.-এর নিকট পৌঁছলে তিনি বললেন: ‘তোমরা তোমাদের নেতাকে স্বাগত জানাও।’ অতঃপর সবাই সাদের রা. নিকট এগিয়ে গিয়ে বললো: ‘হে সাদ, রাসূলুল্লাহ সা. আপনাকে আপনার মিত্রদের ব্যাপারে ফায়সালা করার দায়িত্ব দিয়েছেন।’ তখন সাদ রা. বললেন: ‘আমি যে ফায়সালা ঘোষণা করবো সেটাই ফায়সালা বলে স্বীকৃতি হবে, তোমরা সবাই আল্লাহর নামে এ (কথার উপর) প্রতিশ্রুতি দিচ্ছ? তারা বলল: ‘হ্যাঁ’। অতঃপর সাদ রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর পাশে থাকা সাহাবীদের ইঙ্গিত করে বলেন: ‘এখানে যারা আছেন তারাও কি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ?’ তখন ঐ সকল সাহাবীগণও ‘হ্যাঁ’ বলার মাধ্যমে তাদের সম্মতি জানালেন, সাথে রাসূল সা.ও ‘হ্যাঁ’ বললেন। উল্লেখ্য, সাদ রা. প্রতিশ্রুতি চাওয়ার সময় শ্রদ্ধাবশত রাসূল সা.-এর কথা উল্লেখ করেননি। অতঃপর সাদ ইবনে মুয়াজ রা. তার ফায়সালা এভাবে ঘোষণা করেন যে: ‘আমার ফায়সালা এই যে, বনু কুরাইজার সব পুরুষকে হত্যা করা হোক, সমস্ত ধনসম্পদ বণ্টন করে দেয়া হোক এবং স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হোক।’ ফায়সালা শোনার পর রাসূল সা. সাদ রা.কে উদ্দেশ করে বললেন: ‘তোমার ফায়সালা সাত আসমানের উপর থেকে আল্লাহর যে ফায়সালা এসেছে তারই অনুরূপ।’ (সিরাতে ইবনে হিশাম) অতঃপর রাসূল সা. বনু কুরাইজার লোকদের হত্যার বিষয়ে নির্দেশনা দিতে গিয়ে বলেন: ‘যাদের নাভির নিচে চুল গজিয়েছে শুধু তাদেরকেই যেন হত্যা করা হয়।’ (আর রাহিকুল মাখতুম) রাসূল সা.-এর নির্দেশে সাহাবীগণ কতগুলো গর্ত খনন করলেন। আর এসকল গর্তে চুক্তি ভঙ্গকারী ইহুদি কাফেরদের কতল করা হয়। বনু কুরাইজার ইহুদিদের যখন দলে দলে গর্তের দিকে যেখানে রাসূল সা. ছিলেন সেদিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তারা তাদের গোত্রের প্রধান কাব ইবনে আসাদকে উদ্দেশ করে বলছিল: ‘হে কাব, আমাদের সাথে কী ধরনের আচরণ করা হবে বলে আপনি মনে করেন?’ জবাবে কাব বলেছিল: ‘তোমরা কি কিছুই বুঝো না? দেখছো না, যে ডেকে নিচ্ছে সে কেমন নির্লিপ্ত, নির্বিকার? দেখছো না, তোমাদের যে যাচ্ছে সে আর ফিরে আসছে না? আল্লাহর কসম, সবাইকে হত্যা করা হবে।’ অবশেষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রু জোট গঠনে যিনি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই হুয়াই ইবনে আখতাবকে কতলের জন্য গর্তের নিকট নিয়ে গেলে সে বলেছিল: ‘(মুহাম্মদ) তোমার সাথে শত্রুতা করে আমি কখনো অনুতপ্ত হইনি। তবে আল্লাহকে যে পরিত্যাগ করে তাকে পর্যুদস্ত হতেই হয়। অতঃপর উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে সে বললো: হে জনমণ্ডলী, আল্লাহর হুকুম অলঙ্ঘনীয়। বনি ইসরাইলের জন্য আল্লাহ ভাগ্যলিপি ও মহা হত্যাকাণ্ড নির্ধারিত করে রেখেছিলেন।’ এখানে হুয়াইয়ের বক্তব্যের মাধ্যমে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, হুয়াই সারা জীবন হযরত মুহাম্মদ সা.-এর বিরোধিতা করলেও আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার নীতির ব্যাপারে তার বিশ্বাস ছিল সঠিক। প্রতিহিংসার কারণে হুয়াই আল্লাহর দেয়া সীমা (হুকুম আহকাম) মেনে চলতে পারেনি। তবে আল্লাহর সীমা যে অলঙ্ঘনীয় এবং যে কেহ তা লঙ্ঘন করবে তার ধ্বংস যে অনিবার্য, সেই বিষয়ে স্বীকৃতি দিতে ভুল করেনি হুয়াই। তবে তার এই স্বীকৃতি তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আর এখান থেকে এ শিক্ষা পাওয়া যায় যে, আল্লাহর নীতির শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করার মাঝে কোনো কল্যাণ নেই যতক্ষণ না পর্যন্ত তা বাস্তবিক জীবনে পালন করা হয়। এভাবে এক এক করে বনু কুরাইজার ৬০০-৭০০ জন ইহুদিকে কতল করা হয়। কোনো কোনো বর্ণনায় এর সংখ্যা ৮০০-৯০০ জন বলে উল্লিখিত হয়েছে। খন্দক যুদ্ধের সূচনা থেকে সমাপ্তি, অতঃপর বনু কুরাইজার উপর শাস্তি কার্যকরসহ উপরোক্ত ঘটনাপ্রবাহ এবং পর্যবেক্ষণগুলোর সামষ্টিক পর্যালোচনার প্রেক্ষিতে লক্ষ্য অর্জনের পথে চলা উম্মাহর জন্য এই মূলনীতি গ্রহণ করা যায় যে, ইসলামকে সমূলে উৎপাটিত করার লক্ষ্যে সক্রিয় শত্রুজোটের ষড়যন্ত্র মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী কৌশলী পদক্ষেপ, যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেয়ার মতো নেতৃত্ব, ইসলামের প্রতি সুদৃঢ় ও অবিচল এবং আত্মোৎসর্গের মনোভাবসম্পন্ন ধৈর্যশীল জনবল এবং আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার উপর তাওয়াক্কুল। তাহলেই ব্যর্থ হবে শত্রুজোটের সকল ষড়যন্ত্র আর উন্মোচিত হবে মুসলিমদের বিজয়ের নতুন দ্বার।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির