post

সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসরদের ছোবলে মিসরের গণতন্ত্র

০৭ নভেম্বর ২০১৩

এইচ এম জোবায়ের

যদি সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক, ক্ষমতা দেয়া ও কেড়ে নেয়ার একমাত্র উৎস, মনের আবেগ আর বাহ্যিক প্রকাশ উভয়েরই সর্বোত্তম শ্রবণকারী করুণাময়ের ওপর অগাধ প্রেম ও বিশ্বাস না থাকতো তবে মিসরের ঘটনায় নিজেকে আন্দোলন থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিতাম এতে কোন সন্দেহ নেই। সর্বোত্তম বিচারক ও ইজ্জত দেয়া ও নেয়ার মালিক যদি সর্বাবস্থায় ধৈর্য ধারণ ও হতাশ না হতে বলতেন তাহলে এতদিনে চরম ধৈর্যহারা হয়ে হতাশার এক বুক জ্বালা নিয়ে হয়তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। যদি ইসলামী আন্দোলন করে এটা না বুঝতাম যে কোন দলের সাময়িক জয়-পরাজয়ের সাথে ব্যক্তির জান্নাত-জাহান্নাম নির্ভর করে না বরং ব্যক্তির জান্নাত-জাহান্নাম নির্ভর করে তার চেষ্টা-প্রচেষ্টা ও নিয়তের ওপর তাহলে এতক্ষণে ইসলামী আন্দোলন করা না করার ব্যাপারেই হয়ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতাম। একজন রব বিশ্বাসী মানুষের পক্ষে এগুলো কোনোটাই করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমার হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ও চোখের পানি দিয়ে আশ্রয়হীনের আশ্রয়দানকারী ও মজলুমের মহান সাহায্যকারী রাব্বুল ইজ্জতের কাছে একটাই আর্তি- ‘হে মালিক আপনি অন্তর্যামী, আপনি অনেক শক্তিশালী আমরা অনেক দুর্বল, আপনি আমাদের উত্তম ধৈর্য ধারণের তৌফিক দিন এবং সঠিক পথে অবিচল রাখুন।’ মিসরের সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে এখনই চূড়ান্ত মন্তব্য করা কঠিন। ইখওয়ানের বিজয়ের পর তাদের ত্যাগ-কোরবানি নিয়ে দুনিয়াব্যাপী ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। আলোচিত হয়েছে তাদের স্ট্র্যাটেজি। আর এখনও অনেকে তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা হারানো (আল কুরআনের মতে সাময়িক) নিয়ে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাবেন। কিন্তু যে যত কিছুই তত্ত্ব-আলোচনা করেন মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড, আলজেরিয়ার ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্ট ও তুরস্কের সা’দাত পার্টি যা পূর্বে রাফাহ পার্টি হিসেবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গিয়েও টিকে থাকতে না পারাটা এবং পাশাপাশি দেশে দেশে ইসলামী আন্দোলনের বিপর্যয়ের মূল কারণ হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের অনৈক্য এটাই মুদ্দাকথা। বিশেষ করে ইসলামের পবিত্র ভূমি এবং মহাগ্রন্থ আল কুরআনের আলোকে গঠিত ও বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা)-এর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন কর্তৃক নির্মিত যে রাষ্ট্রব্যবস্থা মক্কা-মদিনায় গড়ে উঠেছিল সেখানে যদি ‘খিলাফত আ’লা মিন হাজিহিন্নবুয়্যাহ’ প্রতিষ্ঠিত না হয় তবে বিশ্বের কোথাও ইসলামী আন্দোলন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে ‘স্টে’ করতে পারবে বলে মনে হয় না। তার বাস্তব প্রমাণ হচ্ছে আলজেরিয়া, তুরস্ক ও সবশেষ মিসর। ১৯৯০ সালের জুন মাসে অবাধ মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে ৮০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে আলজেরিয়ার ধর্মভিত্তিক দল ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্ট। মাত্র ১ দিনের ব্যবধানে ক্ষমতা দখলে নেয় সেনাবাহিনী। ১৯৯৭ সালের জুনে ক্ষমতায় এসে ১৯৯৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৮ মাসের ব্যবধানে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত রাফাহ পার্টি প্রধান তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দীন আরবাকান সেনা বাহিনীর হাতে ক্ষমতা হারান। সবশেষ ৩ জুলাই ’১৩ দিবাগত রাতে ১ বছরের মাথায় রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অস্ত্রের মুখে নামিয়ে দেয়া হলো মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ‘ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি’র মিসরের ইতিহাসের প্রথম অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসিকে। পাশাপাশি আরব বসন্তের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘ স্বৈরশাসনে জর্জরিত কয়েকটি দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ সামনে কী সুফল বয়ে আনে তাও ভেবে দেখার বিষয়। নাকি সবই পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপ-আমেরিকার তল্পিবাহক রাজতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের যৌথ কারসাজিতে ভ-ুল হবে তাও সময়ই বলে দেবে। কারণ আরব বসন্তের ধাক্কায় মধ্যপ্রাচ্যে বিচ্ছিন্নভাবে যে-কয়েকটি দেশ যেমন, তুরস্ক, তিউনিসিয়া, মরোক্কো ও লিবিয়াতে গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটেছিল, সেসব দেশ ইদানীং আরব বসন্তের হাওয়া কাটতে না কাটতেই অনভিপ্রেত ও অস্বাভাবিকভাবে গণবিক্ষোভে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যকে যদি একটি বাড়ি ধরি তাহলে সেই বাড়ির মোড়ল বলা যায় সৌদি আরবকে। আর সৌদির খুব কাছের মিত্র কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাত, দুবাই, বাহরাইন, ওমান এসবই তেল সমৃদ্ধ দেশ ও রাজতান্ত্রিক ধাঁচে পরিচালিত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। আর আমির, রাজা, বাদশাহগণ যেহেতু জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন না তাই তাদের সবচেয়ে বেশি ভয় জনগণকে নিয়েই। তাই পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে যখন জনগণ জেগে ওঠে ও একনায়কতন্ত্রের পতন হয় তখন এসব কায়েমি রাজা-বাদশাহগণ নিজেদের পায়ের নিচে মাটি শূন্যতা অনুভব করেন। তাদের তখতে তাউসের ভীত থরহরি কাঁপতে থাকে। আর এই কম্পমান রাজা-বাদশাহরা তখন বাংলার মীর জাফর হয়ে লর্ড ক্লাইভদের পদযুগল কুর্নিশে লেগে যান। তাদেরকে নামমাত্র মূল্যে তেল দিয়ে, অধিক মূল্যে তাদের পণ্যসামগ্রী কিনে, আরব উপদ্বীপের মতো পবিত্র জায়গায় তাদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি দিয়ে তাদের অনুকম্পা ও নেকনজর লাভের জন্য মরিয়া হয়ে পড়েন। আর শত শত বছর ধরে যারা এশিয়া, আফ্রিকা ও পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ডাকাতি, লুটপাট, অস্ত্রের বাণিজ্য ও দেশে দেশে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের আধিপত্যবাদ ও ‘নিউ কলোনিয়ালিজমে’র ‘প্রাকটিস’ করে আসছেন তারাও এই দীনতার সুযোগ পুরো মাত্রায় গ্রহণ করেন। রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সংশ্লিষ্ট দেশের সেক্যুলারিস্ট, সোসালিস্ট, লিবারালিস্ট ও সেনাবাহিনীকে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ঘসেটি বেগম, উমি চাঁদ ও রায় দুর্লভ হিসেবে পেয়ে থাকে। যুগে যুগে হামিদ কারজাই, নূরে আল মালিকিদের দিয়েই সাম্রাজ্যবাদ তাদের অধিপত্য গোটা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত রেখেছে। আর হুসনি মোবারক ও জেনারেল সিসিরা হলেন সাম্রাজ্যবাদীদের বাহনমাত্র। সেনাবাহিনীকে দুটো উপায়ে বশে রাখার চেষ্টা করা হয়। প্রথমত ক্ষমতার লোভ অতঃপর অর্থ। পৃথিবীর বর্তমান পরাশক্তি আমেরিকা সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ অনুদান দিয়ে থাকে ইসরাইলের সেনাবাহিনীকে। দ্বিতীয় অবস্থানেই আছে মিসর। মিসর সেনাবাহিনীকে দেয় সাহায্যের পরিমাণ বাছরে ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা মিসর সেনাবাহিনীর মোট বার্ষিক ব্যয়ের ৩৩%। সুতরাং যার নুন খাই তার গুণ গাই। প্রসঙ্গত, ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় মিসর ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে প্রেসিডেন্টের অবকাশ যাপন কেন্দ্র ক্যাম্প ডেভিডে টানা ১৩ দিনের গোপন বৈঠক শেষে ১৯৭৮ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর আরব-ইসরাইল শান্তির ব্যাপারে সমঝোতা চুক্তি হয়। যার ফলশ্রুতিতে পরের বছর ইসরাইল-মিসর শান্তিচুক্তি হয়। এটি ‘ক্যাম্প ডেভিড’ চুক্তি হিসেবে পরিচিত। ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন। এ চুক্তির দু’টি পরিকাঠামো (ফ্রেমওয়ার্ক) হোয়াাইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়। এই ক্যাম্প ডেভিড চুক্তির মাধ্যমে আপাতদৃষ্টিতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও পরোক্ষভাবে সবচেয়ে লাভবান হয় যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলকে বৈধতা দেয়ার পাশাপাশি গাজা ও পশ্চিমতীরকে আলাদা ও বঞ্চিত রাখার ফন্দি আঁটা হয় এই চুক্তিতে। তাই হুসনি মোবারকের পুরো সময়টা গাজা ও পশ্চিমতীর নিগৃহীত থাকে। এই মহৎ (?) চুক্তি সম্পাদনের জন্য ১৯৭৮ সালে আনোয়ার সাদাত ও বেগিনকে যৌথভাবে নোবেল শান্তি (!) পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র উভয় রাষ্ট্রকে বার্ষিক কয়েক বিলিন ডলার ভর্তুকি দিতে রাজি হয়। মার্কিন পণ্য কেনার বাধ্যবাধকতার ভিত্তিতে দুই দেশ এসব অর্থ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তার নামে অনুদান হিসেবে এখনো পেয়ে যাচ্ছে। আর মিসর সেনাবাহিনীকে প্রদেয় ১.৩ বিলিয়ন ডলার তারই অংশ। এত এত অর্থের পাশাপাশি মিসর সেনাবাহিনী ড. মুরসিকে উৎখাতের জন্য সর্বশেষ পায় একশ কোটি ডলার। একদিকে জেনারেল সিসিদের পূর্বসূরি জামাল আব্দুন নাসের, হুসনি মোবারক ও ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অব দি আর্মড ফোর্সেস’ এর দীর্ঘদিনের দেশ শাসন ও ক্ষমতার বিলাসিতা অন্য দিকে ঘুষ হিসেবে প্রাপ্ত লক্ষ-কোটি মার্কিন ডলার মিসরের জেনারেলদের বানিয়েছে উচ্চাভিলাষী, দাম্ভিক ও রাষ্ট্র ক্ষমতা লোভী। এই দুইয়ের মিশ্রণেই মিসরের ইতিহাসের প্রথম জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মদ মুরসি ক্ষমতাচ্যুত হন। সেই সাথে মুখ থুবড়ে পড়ে আরব বিপ্লবের। সাময়িক আশাহত হয় মিসরের জনগণ। ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’। আসমানি কিতাবের ভাষ্য মতে মুমিনগণের বন্ধু শুধু মুমিনগণই হতে পারেন। কিন্তু যাদেরকে আল্লাহ তেলের খনি দিলেন, যারা মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতির সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন, যেখান থেকেই কেঁপে উঠেছিল পৃথিবীর সকল ইহুদি-নাসারাদের তখতে তাউস আজ তারাই মুমিন ভাইদের ওপর দিয়ে ট্যাংক-বুলডোজার উঠিয়ে দিতে সেনাবাহিনীকে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সাহায্য দিলেন। প্রিয় নবীর স্মৃতি বিজড়িত মক্কা-মদিনার বর্তমান মালিক আপনারা। নিশ্চয়ই আপনাদের সাথে হাশরের ময়দানে প্রিয় নবীর সাক্ষাৎপ্রার্থী হবে না ওই ইহুদি-নাসারারা। বরং আপনাদের সাথে আমরা এবং মিসরের শত শহীদের তপ্ত লোহিত কণায় সিক্ত রাবেয়া স্কয়ারের ‘কিশোর কন্যা’ শহীদ আসমা বেলতাগী হবেন সেদিন রাসূলের (সা) সাক্ষাৎপ্রার্থী। আবুল কাসেম রাসূল (সা) কে সেদিন ঐ কিশোরী কন্যা আসমা বেলতাগী নিশ্চয়ই বলবেন- ‘হে আল্লাহর মহান রাসূল (সা) আমরা আপনার রেখে যাওয়া বিপ্লবী পবিত্র কুরআন থেকে শিখেছি, আমরা আপনার বাণীর অমিয় ভা-ার থেকে মধু পিয়ে উপলব্ধি করেছি, আমরা হযরত খব্বাবকে হৃদয়ের গহিন কোনায় চিত্রিত করেছি এমতাবস্থায় যখন বাতিল তার সমস্ত পিঠকে তরবারি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে গর্ত করে ফেলেছিল। আমরা আপনার সাহাবী খুবাইব ইবনে আদিকে এমন অবস্থায় চিনতে পেরেছি যখন শূলি কাষ্ঠে জীবন্ত লোকটার একেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীর থেকে আলাদা করে ফেলা হচ্ছিল। হযরত সুমাইয়াই তো আমাকে শিখিয়েছেন কিভাবে আপনার পথে সত্যের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে শাহাদাত বরণ করতে হয়। হে মানবতার বন্ধু রাসূল (সা) আপনার খাব্বাব, খুবাইব ও সুমাইয়গণ কাদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন তাতো আপনি ভাল করেই জানেন। আর আপনি এও নিশ্চয়ই জানেন আমি মিসরের আসমা বেলতাগী কাদের হাতে শহীদ হয়েছিলাম। আমাকে নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করেছিল আমারই মুসলমান ভাইয়েরা। আর এই ভাইদের রিয়াল-ডলার দিয়ে সাহায্য করেছিল আপনার জন্মভূমির লোকেরা। যাদের পূর্ব-পুরুষদেরকে সাথে নিয়ে আপনি বদর-উহুদ-খন্দকে লড়েছিলেন। যাদেরকে আপনি ভ্রাতৃত্ব শিখিয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন ইসলামের জন্য জীবন দেয়ার রীতি। আজ তাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। ‘আহকামুল হাকিমিন’ই আজ আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ফয়সালা করবেন।’ আজকের এই আমীর-উমরাগণ নিশ্চয়ই সেদিন ধরা পড়ে যাবেন। আজকে যারা তাদের সহায়ক শক্তি, পরাশক্তি সেদিন তারাও হবেন নগণ্য গোলাম। আজকের মিসাইল, ড্রোন বা সেনাবাহিনী সেদিন কোন কাজে আসবে না। লক্ষ লক্ষ অসহায় ফিলিস্তিনি শিশু-বৃদ্ধ-নারী যখন ইসরাইলের বর্বরদের দ্বারা নির্যাতিত, ধর্ষিত ও লাঞ্ছিত হয় রাজতন্ত্রের শক্তিগুলো তখন চুপ করে থাকে। গাজা ও পশ্চিমতীরের লাখ মানুষ যখন আবদ্ধ অবস্থায় খাবার-পানি সঙ্কটে মৃত্যুর মুখে নিপতিত হয় তখন হয়তো এরা সুরম্ম দুবাই বুরুজের শত তলায় বিলাসিতায় মগ্ন থাকে। ইমাম হুসাইনের পদ চুম্বনে ধন্য ইরাকের পবিত্র ভূমিতে যখন ইহুদি-নাসারারা টনকে টন মিসাইল নিক্ষেপ করে নিরস্ত্র মানুষকে হত্য করছিল তখনও এরা বাকহীন ঘুমন্ত। কিন্তু কোন দেশ যখন পার্লামেন্টে ইসলামকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় তখনই এরা সজাগ হয়ে যায়। সমস্ত উপায়-উপকরণ অবলম্বন করে সেটাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেয়ার জন্য প্রয়োজনে আল-কুরআন ঘোষিত শত্রুর সাথেও হাত মিলাতে দ্বিধা করে না। মিসর বিপ্লবের শুরু থেকেই রাজতান্ত্রিক শক্তি ইখওয়ানের বিজয়কে নিজেদের অস্তিত্ব সঙ্কটের কারণ বলে মনে করে আসছে। তাদের ধারণা ছিল মিসর বিপ্লব স্থায়ী হলে তা গোটা আরব বিশ্বে ডাল-পালা ও ছায়া বিস্তার করবে। এভাবে তাদের দেশেও যদি জনগণ নিজেদের ঈমানী চেতনায় জেগে ওঠে তবে রাজতন্ত্রের পতন হবে। তাই সহযোগিতাতো দূরের কথা গোপনে ইখওয়ানের পতনই চাইতো রাজা-বাদশারা। ইসরাইলের অস্তিত্ব রক্ষা ও বন্ধু আমেরিকার মন ধরে রাখতে তারা মুসলমান ভাইদের ওপরই উঠিয়ে দিলেন বুলডোজার, চলালেন গুলি। বহিঃশত্রুর পাশাপাশি ঘরের শত্রুর বিবেকহীন স্বল্প স্বার্থের প্রাধান্যই দেশে দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের পতনের প্রধান কারণ। তবে হ্যাঁ, এসব ঘটনার মাধ্যমে আল্লাহ সত্য-মিথ্যাকে দুনিয়াবাসীর সামনে উন্মোচিত করার পাশাপাশি কারা কোন পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন তাও প্রকাশ করেন। প্রকৃত শত্রু চেনার জন্য ঘাত-প্রতিঘাত ও জুলুম-নির্যাতন সহায়ক ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি সত্যপন্থীরাও নিজেদের পথকে সত্য হিসেবে চেনার অনেক তথ্য-প্রমাণ পেয়ে যান। তারা দেখতে পান কারা তাদের বিরোধিতা করছে। ইহুদি-নাসারা ও তাদের দোসরদের অন্যায় ও নিষ্ঠুর বিরোধিতা তাদের হৃদয়-মনকে ইসলামের পথে অবিচল-অটল পাহাড়ের ন্যায় দাঁড় করিয়ে দেয়। সত্যের জন্য তখন তারা কামানের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। বুলেট-বেয়নেট দিয়ে তাদের দেহ থেকে রুহকে আলাদা করে ফেলা হয়। মাটিতে অর্ধেক গাড়া অবস্থায় মাথায় করাত চালিয়ে দেহকে দুই ভাগ করে ফেলা হয়। জেলখানার নির্মম প্রকোষ্ঠে তাদেরকে প্রশ্রাব খেতে দেয়া হয়, ইলেকট্রিক শক দিয়ে শরীরের পেশিগুলোকে অকার্যকর করে দেয়া হয়। নখের নিচ দিয়ে বড় বড় সুচ ঢুকানো হয়। এত জুলুমের পরও তারা ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ ধ্বনিতেই প্রশান্তি খুঁজে পায়। আসলে ইসলামের বিরোধিতা যুগে যুগে ফেরাউন, হামান, নমরুদ ও আব্দুল্লাহ বিন উবাই তৈরি করেছে। আর ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে বেলাল, আম্মার, হাসানুল বান্না ও আসমা বেলতাগী তৈরি করেছে। সত্যিই মানুষের তৈরি করা আইন মানুষের জন্য শান্তি আনতে পারে না। যখন আমাদের দেশে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে কালমার্কস, মাওসেতুং, লেনিনের আইন চালু থাকে, তখন আমাদের দেশে জন্ম নেয় ঐশীর মতো ইয়াবাসেবী মেয়ে, ইমরানের মত নাস্তিক ব্লগার, সুরঞ্জিত ও আবুলের মতো চোর মন্ত্রী সর্বোপরি দুর্নীতির শীর্ষে অবস্থানকারী এক বাংলাদেশ। যেখানে শুধুই অশান্তি আর অশান্তি। অশান্তির কারণ একটাই। সেটা হলো ইসলাম বিরোধিতা। পরিশেষে মিসরের নির্যাতিত মানুষের জন্য একটি সফল বিপ্লবের পূর্ব মুহূর্তের দৃশ্যকে স্মরণ করিয়ে আলোচনা শেষ করবো। ইরানের ইসলামী বিপ্লব। ১৯৭৯ সালে ঘটা একটি যুগান্তকারী বিপ্লব যা ইরানকে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভীর একনায়কতন্ত্র থেকে আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলামিক গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করে। একে বলা হয় ফরাসি এবং বলশেভিক বিপ্লবের পর ইতিহাসের তৃতীয় মহান বিপ্লব। কিন্তু সেই বিপ্লব একদিনে আসেনি। মাসের পর মাস টনকে টন রক্তের বিনিময়ে এসেছিন সেই বিপ্লব। শেষের দিকের একটি ঘটনা ছিল এরকম- আগের দিন সেনাদের ট্যাংক ও বন্দুকের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেছিল শত শত মানুষ। পরের দিন তার প্রতিবাদে হবে বিক্ষোভ। লাখ জনতার মাঝে শহীদ হওয়ার উদগ্র বাসনা। যুবকেরা বৃদ্ধদেরকে বলছে- আপনারা হলেন আমাদের কর্ণধার, আপনারা অভিজ্ঞ। আপনাদের অভিজ্ঞতা এদেশকে সামনের দিনে অনেক দূর এগিয়ে নেবে। তাই আমরা যুবরাই মিছিলের সামনে থাকি। শত্রুর কোন বুলেট যদি মিছিল ভেদ করতে চায় তবে আমরা যুবকরাই হবো তার প্রথম খোরাক। যুবকদের এই অভিব্যক্তি দেখে বৃদ্ধগণ বলছেন- না তা হয় না। তোমরা হলে দেশের ভবিষ্যৎ। আমাদের দেয়ার দিন শেষ হয়েছে। তোমাদের সামনে সোনালি ভবিষ্যৎ। তোমরা দেশকে সামনের দিনে অনেক খেদমত করতে পারবে। এভাবে বৃদ্ধ ও যুবকদের মিছিল সামনে এগিয়ে চলছে। সেনাদের কামান, ট্যাংক ও বন্দুক থেকেও বর্ষিত হচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটার মতো গুলি। অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হলো যে শহীদদের লাশ কামানের নল বরাবর চলে এল। পতন হলো জালিমের। অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো মজলুমের। সেদিনের সেই ফোঁটা ফোঁটা রক্তের বিন্দু চলমান ¯্রােত হয়ে গিয়ে পড়ল পাশের ড্রেনে। ড্রেন দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে তা গিয়ে পড়ল সেনাদেরই গোসল করার হ্রদ-নালা ও পুকুরে। পরের দিন যখন সেনারা গাতে গোসল করতে গেল তখন এক সেনা আরেক সেনাকে বলল, ‘একি কিসে আমাদের লেকের সবুজ পানি লাল করে দিল?’ আরেক সেনা উত্তর দিল ‘গতকাল তোমরা যে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছ তারই একটা দৃশ্য আজকের এই লাল পানি।’ সুতরাং সত্যের বিজয় হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ের আগে মুমিনদের সাথে আল্লাহ পরিচয় করিয়ে দেবেন কারা ইসলামের আসল বন্ধু আর কারা আসল শত্রু। এখন শুধু সামনের সেই চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য নিজেদেরকে সকল দিক থেকে প্রস্তুত করার সময়। আজ হোক কাল হোক বিজয় সত্যের পক্ষেই আসবে। ইনশাআল্লাহ। লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির