post

কাফেরদের চক্রান্ত এবং আল্লাহর কৌশল

মাওলানা নুরুল ইসলাম

০৯ এপ্রিল ২০২৩

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تَتَّقُوا اللّٰهَ یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ فُرۡقَانًا وَّ یُکَفِّرۡ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ؕ وَ اللّٰهُ ذُو الۡفَضۡلِ الۡعَظِیۡمِ ﴿۲۹﴾ وَ اِذۡ یَمۡکُرُ بِکَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لِیُثۡبِتُوۡکَ اَوۡ یَقۡتُلُوۡکَ اَوۡ یُخۡرِجُوۡکَ ؕ وَ یَمۡکُرُوۡنَ وَ یَمۡکُرُ اللّٰهُ ؕ وَ اللّٰهُ خَیۡرُ الۡمٰکِرِیۡنَ ﴿۳۰﴾

অনুবাদ

(২৯) হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করো, তাহলে তিনি তোমাদের ভালো-মন্দের পার্থক্য করার একটি মানদ- দিবেন। এবং তোমাদের থেকে মুছে দিবেন তোমাদের পাপগুলোকে আর ক্ষমা করে দিবেন তোমাদের ত্রুটি বিচ্যুতি। আল্লাহ তো মহা অনুগ্রহের মালিক। (৩০) কাফিররা যখন তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছিল তোমাকে বন্দি করার; কিংবা হত্যা করার অথবা দেশ থেকে বের করে দেবার। তারা চক্রান্ত করেছিলো আর আল্লাহও কৌশল করছিলেন, আর আল্লাহই সর্বোত্তম কৌশলী। (সূরা আনফাল : ২৯-৩০)

 

একনজরে সূরা আনফাল 

মোট আয়াত সংখ্যা ৭৫, রুকু সংখ্যা ১০, সূরাটি মাদানি 

নামকরণ 

এ সূরায় বর্ণিত প্রথম আয়াত থেকেই انفال শব্দটি নেওয়া হয়েছে যা نفل এর বহুবচন। 

يَسْأَلُونَكَ عَنِ ٱلأَنْفَالِ قُلِ ٱلأَنفَالُ لِلَّهِ وَٱلرَّسُولِ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَأَصْلِحُواْ ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ 

যার অর্থ- অনুগ্রহ, দান, উপঢৌকন ইত্যাদি। 

যুদ্ধলব্ধ সম্পদের ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআনে তিনটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে- ১. আনফাল   ২. গনিমত   ৩. ফাই


- انفال তথা গনিমতের পরিচয়-

যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে যা অর্জিত হয় তাকে আনফাল বা গনিমত বলা হয়। এ বিষয়ে উক্ত সূরার ৪১ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّمَا غَنِمۡتُمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ فَاَنَّ لِلّٰهِ خُمُسَهٗ وَ لِلرَّسُوۡلِ وَ لِذِی الۡقُرۡبٰی وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ ابۡنِ السَّبِیۡلِ ۙ اِنۡ کُنۡتُمۡ اٰمَنۡتُمۡ بِاللّٰهِ وَ مَاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا یَوۡمَ الۡفُرۡقَانِ یَوۡمَ الۡتَقَی الۡجَمۡعٰنِ ؕ وَ اللّٰهُ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ

‘আর জেনে রেখ! যুদ্ধে যা কিছু তোমরা (গনিমত হিসেবে) লাভ কর, তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ, তাঁর রাসূলের, রাসূলের নিকটাত্মীয়, পিতৃহীন এতিম, দরিদ্র এবং পথচারীদের জন্য। যদি তোমরা আল্লাহ ও সেই জিনিসে বিশ্বাসী হও, যা ফয়সালার দিন (বদর প্রান্তরে) আমি আমার বান্দার প্রতি নাজিল করেছিলাম; যেদিন দু’দল (মুসলিম ও কাফের) পরস্পর মুখোমুখি হয়েছিল। আর আল্লাহ তায়ালা সর্ববিষয়ে শক্তিমান।’ (সূরা আনফাল : ৪১)

এ আয়াতে গনিমতের বিধান ও তার বণ্টননীতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অভিধানে গনিমত বলা হয় সে সব মাল-সামানাকে যা শত্রুর নিকট থেকে লাভ করা হয়। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষা অনুযায়ী অমুসলিমদের কাছ থেকে যুদ্ধ-বিগ্রহে বিজয়ার্জনের মাধ্যমে যে মালামাল অর্জিত হয়, তাকেই বলা হয় ‘গনিমত’ (ফাতহুল কাদির)। আর যা কিছু আপস, সন্ধি ও সম্মতির মাধ্যমে অর্জিত হয়, তাকে বলা হয় ‘ফাই’ (ইবন কাসির)। ‘ফাই’-এর আলোচনা সূরা হাশরে রয়েছে।

এখানে জিহাদের পর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ গনিমতের হকদারদের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। সমস্ত সম্পদ পাঁচ ভাগে ভাগ করা হবে। এর চার ভাগ যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আর বাকি এক-পঞ্চমাংশ বা পাঁচ ভাগের এক ভাগকে আবার পাঁচভাগে ভাগ করা হবে।

১. প্রথমভাগ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের। এ অংশ মুসলিমদের সাধারণ স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যয় হবে।

২. দ্বিতীয়ভাগ রাসূলুল্লাহ সা.-এর স্বজনদের জন্য নির্ধারিত। তারা হলেন ওই সমস্ত লোক যাদের উপর সদকা খাওয়া হারাম। অর্থাৎ বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব। কারণ তাদের দেখাশুনার দায়িত্ব ছিল রাসূলুল্লাহ সা.-এর ওপর। তিনি তার নবুওয়তের কর্মকা-ে ব্যস্ত থাকায় তাদের জন্য এ গনিমতের মাল থেকে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

৩. তৃতীয়ভাগ এতিমদের জন্য সুনির্দিষ্ট।

৪. চতুর্থভাগ ফকির ও মিসকিনদের জন্য। 

৫. পঞ্চম ভাগ মুসাফিরদের জন্য (ইবন কাসির)।

হজরত ইবন তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, বর্তমানে পুরো এক-পঞ্চমাংশই ইমামের কর্তৃত্বে থাকবে। তিনি মুসলিমদের অবস্থা অনুযায়ী কল্যাণকর কাজে ব্যয় করবেন। (ইবন কাসির)

সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, গনিমতের মাল যদিও আগে সূরা আনফালের প্রথম আয়াতে শুধু আল্লাহ ও তার রাসূলের বলা হয়েছে তবুও তা মূলত মুসলিমদের মধ্যেই পুনরায় বণ্টন হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ সা. তার জন্য তার জীবদ্দশায় যা কিছু পেতেন তাও বর্তমানে সাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়ে থাকে।


- ফাই এর বিধান : যুদ্ধ ব্যতীত, চুক্তি বা সন্ধির মাধ্যমে যা অর্জিত হয়।

বিনা যুদ্ধে অর্জিত শত্রু সম্পত্তিগুলো রাসূল সা.-এর মালিকানাধীন ‘ফাই’ হিসাবে গণ্য হয়। যে বিষয়ে আল্লাহ বলেন,

وَمَا أَفَاءَ اللهُ عَلَى رَسُولِهِ مِنْهُمْ فَمَا أَوْجَفْتُمْ عَلَيْهِ مِنْ خَيْلٍ وَلا رِكَابٍ وَلَكِنَّ اللهَ يُسَلِّطُ رُسُلَهُ عَلَى مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ 

‘আল্লাহ জনপদবাসীদের নিকট থেকে তাঁর রাসূলকে যে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, যার জন্য তোমরা ঘোড়ায় বা উটে সওয়ার হয়ে যুদ্ধ করোনি। কিন্তু আল্লাহ যার উপর ইচ্ছা করেন, স্বীয় রাসূলগণকে কর্তৃত্ব দান করে থাকেন। বস্তুত আল্লাহ সকল কিছুর উপরে ক্ষমতাশালী।’ (সূরা হাশর : ৬)। 

বনু নাজিরের পরিত্যক্ত সম্পত্তি গনিমত নয় বরং ‘ফাই’ হিসাবে গণ্য হয়। কেননা এখানে কোনো যুদ্ধের প্রয়োজন হয়নি। ফলে তা বণ্টিত হয়নি। সবটাই রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসাবে সংরক্ষিত হয়। যা রাসূল সা. পরবর্তী যুদ্ধ প্রস্তুতি ও অন্যান্য দান-সাদাকার কাজে ব্যয় করেন। অবশ্য সেখান থেকে কিছু অংশ তিনি ব্যয় করেন নিজস্ব অধিকারবলে প্রথম দিকে হিজরতকারী সাহাবিগণের মধ্যে। কিছু দেন অভাবগ্রস্ত আনসার সাহাবি আবু দুজানা ও সাহল বিন হুনায়েফকে এবং কিছু রাখেন নিজ স্ত্রীগণের সারা বছরের খোরাকির জন্য। রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া বাকি সব মালামাল নিয়ে পরিবার-পরিজনসহ চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে তারা নিজেদের হাতে গড়া ঘরবাড়ি নিজেরা ভেঙে দরজা-জানালা সহ ৬০০ উট বোঝাই করে নিয়ে চলে যায়। গোত্রনেতা হুয়াই বিন আখতাব, সাল্লাম বিন আবুল হুক্বাইক্ব সহ অধিকাংশ ইহুদি ৬০ মাইল দূরে খায়বারে চলে যায়। বাকি কিছু অংশ সিরিয়া চলে যায়। তবে তাদের মধ্যে ইয়ামিন বিন আমর ও আবু সা‘দ বিন ওয়াহাব নামক দু’জন ব্যক্তি ইসলাম কবুল করেন। ফলে তাদের মালামাল সবই অক্ষত থাকে।’ (সিরাহ সহিহাহ ২/৩১০)।


নাজিলের সময়কাল 

সূরাটি দ্বিতীয় হিজরি বদর যুদ্ধের পরে নাজিল হয়। সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী এ যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ উক্ত সূরাতে তুলে ধরা হয়েছে। এ সূরাটি অধ্যয়ন করলে বুঝা যায় এটি একটি মাত্র ভাষণে নাজিল হয়েছে।


আলোচ্য আয়াতের প্রেক্ষাপট 

মাক্কি জীবনের শেষের দিকে রাসূল সা. এবং তার সাহাবাদের উপর কাফেরদের অমানুষিক নির্যাতন শুরু হয়ে যায়। এই নির্যাতনের মাত্রা আরো প্রখর হয় যখন নবুয়তের দশম বছরের রজব মাসে তার চাচা আবু তালেব মৃত্যুবরণ করেন। আবু তালেবের ইন্তেকালের কয়েকদিন পরেই তার স্ত্রী হজরত খাদিজা রা. মৃত্যুবরণ করেন। ফলে কাফের-মুশরিকরা আরো বেশি সুযোগ পেয়ে যায়। তারা কারণে-অকারণে মুসলমানদের নির্যাতন করতে থাকে। এরপরও রাসূল সা. অত্যধিক ধৈর্য্য সহকারে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। মক্কার কাফেররা দাওয়াত কবুল না করে বরং দ্বীনের এই দাওয়াতকে তারা নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে। অবশেষে আল্লাহর রাসূল সা. নবুয়তের দশম বর্ষের শাওয়াল মাসে (৬১৯ হিজরির জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে) দাওয়াত দানের উদ্দেশ্যে তার পালক পুত্র হজরত যায়েদ রা.কে নিয়ে প্রায় ষাট মাইল দূরে অবস্থিত তায়েফে পায়ে হেঁটে যান। যাত্রা পথে যে গোত্রই সামনে পড়েছে তাদেরকেই তিনি দাওয়াত দেন। তায়েফে ১০ দিন অবস্থান করে তিনি সেখানকার সকল গোত্রের নেতাদের দাওয়াত দেন কিন্তু তারা রাসূল সা.-এর দাওয়াত কবুল করেনি। উপরন্তু তারা উচ্ছৃঙ্খল বালকদের রাসূলের পেছনে লেলিয়ে দেয়। তারা পাথরের আঘাতে রাসূল সা.কে ক্ষত বিক্ষত করে। এরপর আবার তিনি মক্কায় ফিরে আসেন কিন্তু দাওয়াতি কাজে তাকে কেউ দমিত করতে পারেনি। 

নবুয়তের একাদশ বছরে (৬২০ সালের জুলাই মাসে) হজের মৌসুমে ইয়াসরিবের ছয়জন যুবক ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাসূলের হাতে বাইয়াত নেন। তাদের ঘটনাটি হলো- মাক্কি যুগের শেষ দিকে রাসূল সা. তার দাওয়াতের স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করেন। তিনি রাতে বিভিন্ন গোত্রের কাছে দাওয়াত নিয়ে যেতেন যাতে মুশরিকরা বাধার সৃষ্টি করতে না পারে। প্রায় সময় তার সাথে আবু বকর এবং আলী রা. থাকতেন। একদিন রাতে রাসূল সা. মিনার পাহাড়ি এলাকা অতিক্রম করার সময় কয়েকজন লোককে তাদের মধ্যে আলাপ করতে শোনেন। তিনি তাদের কাছে চলে যান। তারা হলো খাজরাজ গোত্রের ছয় যুবক। রাসূল সা. তাদের কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে তারা তাদের গোত্রের পরিচয় দেয়। খাজরাজ গোত্র ছিলো ইয়াহুদিদের প্রতিপক্ষ। আর ইয়াসরিবের ইহুদিরা বলতো, এ যুগে একজন নবীর আমাদের গোত্রে আগমন ঘটবে। আর তাকে সাথে নিয়ে আমরা আমাদের প্রতিপক্ষদের হত্যা করবো। ফলে নবীর আগমনের ব্যাপারে খাজরাজ গোত্রের লোকদেরও অনেক আগ্রহ ছিলো। 

যাই হোক রাসূল সা. যুবকদের পরিচয় নেওয়ার পরে বললেন, তোমরা একটু বসো, আমি কিছু কথা বলি। তখন রাসূল সা. তাদেরকে দ্বীন ইসলামের ব্যাখ্যা করেন, কুরআন তিলাওয়াত করে শোনান এবং আল্লাহর পথে দাওয়াত দেন। এরপর তারা বলল এতো মনে হয় নবী। পরে সেই ভাগ্যবান যুবকেরা ইসলাম গ্রহণ করে এবং রাসূল সা.-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে এবং ওয়াদা করেছিলেন যে, তাদের কওমের কাছে গিয়ে দাওয়াতের কাজ করবে।

ফলে পরবর্তীতে নবুয়তের দ্বাদশ বছর জিলহজ মাসে (৬২১ খ্রিস্টাব্দে) ১৩ জন লোক রাসূল সা.-এর কাছে আসেন এদের মধ্যে ৫ জন আগের বছরও এসেছিলেন। এই ১৩ জনের মধ্যে দুইজন ছিলেন আউস এবং বাকি সবাই ছিলেন খাজরাজ গোত্রের লোক। তারা সবাই মিনার আকাবায় রাসূল সা.-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। যা ইতিহাসে আকাবার প্রথম শপথ নামে পরিচিত। 

তারা ইয়াসরিবে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াতি কাজ শুরু করেন। নবুয়তের ত্রয়োদশ বছরে (৬২২ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে) ৭০ জন মুসলমান হজ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় আসেন। হজরত কাব রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিস থেকে জানা যায় তাদের সংখ্যা ছিলো ৭৫ জন। এর মধ্যে ২ জন নারী এবং ৭৩ জন পুরুষ ছিলো (ইবনে হিশাম- প্রথম খ-)। তারা আইয়ামে তাশরিকের মাঝের দিন অর্থাৎ ১২ই জিলহজ তারিখে রাতের অন্ধকারে প্রথম জামরা জামরায়ে আকাবাতে রাসূল সা.-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। যা ইতিহাসে দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবা নামে পরিচিত। উক্ত বাইয়াতের খবর কুরাইশরা জানতে পারলে পরিস্থিতি খুবই নাজুক হতে শুরু করে। তারা বুঝে নেয় ইসলামের শক্তি মক্কা ছেড়ে অন্য ভূখ-েও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে তাকে যদি এখনই দমানো না যায় তবে তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে। রাসূল সা.ও তাদের পদক্ষেপের প্রতি গভীরভাবে নজর রাখছিলেন। 

যাইহোক, মুশরিকরা দ্বিতীয় বাইয়াতের আড়াই মাসের মাথায় নবুয়তের চতুর্দশ বছরের ২৬ শে সফর (৬২২ খ্রিস্টাব্দ, ১২ই সেপ্টেম্বর) প্রথম প্রহরে দারুন নদওয়ার জরুরি বৈঠকের অধিবেশন বসায়। উক্ত বৈঠকে শয়তান নজদের এক বৃদ্ধের আকৃতিতে এসে উপস্থিত হয় এবং বৈঠকে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে। সবাই উপস্থিত হলে বৈঠকের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। 


রাসূল সা.কে হত্যার ব্যাপারে ঐকমত্য

উক্ত সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করা, যাতে অতিসত্বর ইসলামী দাওয়াতের নিশানবরদারকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে ইসলামের আলো চিরতরে নিভিয়ে দেওয়া যায়। বৈঠকে বিভিন্ন প্রস্তাব এবং সমাধানের ব্যাপারে আলোচনা হতে থাকে। প্রথমে আবুল আসওয়াদ প্রস্তাব করলো, আমরা তাকে আমাদের মধ্য থেকে বের করে দেবো। সে কোথায় যায় আর কোথায় অবস্থান করে তার কোন খবরও রাখবো না। এতেই আমাদের সব ব্যাপার ঠিক হয়ে যাবে আর আমাদের মধ্যে ঐক্য সংহতি পূর্বের মতো ঠিক থাকবে।

নজদি বৃদ্ধরূপী শয়তান বলল, এটা কোন সমীচীন বুদ্ধি নয়। তোমরা কি লক্ষ্য করোনি, তার কথা কত উত্তম। সে অল্পতেই মানুষের মন জয় করে নিতে পারে। আল্লাহর কসম তোমরা যদি এমন কিছু করো তবে সে অন্য কোন গোত্রে গিয়ে তাদেরকে নিজের অনুসারী বানিয়ে তোমাদের উপর হামলা করবে। কাজেই তোমরা অন্য প্রস্তাব চিন্তা করো। 

আবুল বাকতারি বললো, তাকে লোহার শেকলে বেঁধে আটক করে বাহিরে থেকে দরজা বন্ধ করে রাখো এবং মৃত্যুর পরিণতির জন্য অপেক্ষা করো। বৃদ্ধরূপী শয়তান বলল, এটাও সমীচীন নয়। কারণ তার অনুসারীরা খবর পেলে একত্রে তোমাদের উপর হামলা করে তাকে নিয়ে যাবে। সুতরাং এই প্রস্তাবও বাতিল। এভাবে একের পর এক প্রস্তাব বাতিল হতে থাকে। অবশেষে তারা তৃতীয় একটি প্রস্তাবে সকলেই ঐকমত্য হয়ে যায়। এই প্রস্তাব উত্থাপক ইসলামের চরম শত্রু আবু জাহল। সে বলল, প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে শক্তিশালী অভিজাত বংশের যুবককে বাছাই করে তাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে ধারালো অস্ত্র তুলে দিবো। এরপর তারা একযোগে গিয়ে তরবারি মেরে তাকে হত্যা করবে। তারা এমনভাবে হামলা করবে যেন একজনই হত্যা করেছে। ফলে আমরা তার হাত থেকে রেহাই পাবো আর হত্যার দায় কোনো নির্দিষ্ট গোত্রের উপর না পড়ে বরং সকলের উপরই বর্তাবে। ফলে বনু আবদে মানাফ মক্কার সকল গোত্রের সাথে যুদ্ধ করারও সাহস করবে না। শয়তান এ প্রস্তাব কুনে বলল, এ যুবক যা বলেছে তাই সঠিক। ফলে এই সিদ্ধান্তে তারা ঐকমত্য হলো। 

এই খবর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ফেরেস্তার মাধ্যমে রাসূল সা.-এর কাছে পৌঁছালে তিনি হিজরতের প্রস্তুতি নেন এবং রাতের অন্ধকারে তার সবচেয়ে প্রিয় সাথী হজরত আবু বকর রা.কে সাথে নিয়ে ইয়াসরিবের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। এই হিজরতের মাধ্যমেই রচিত হয় ইসলামের নতুন এক অধ্যায়ের। মুসলমানরা ধীরে ধীরে পরিণত হয় এক পরাশক্তিতে। আর ঈমানের বলে বলিষ্ঠ একদল দৃঢ়চেতা মর্দে মুজাহিদদের নিয়ে আল্লাহর সাহায্যে তিনি একের পর এক যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেন। সূরা আনফালের ৩০ নম্বর আয়াত মূলত এই প্রেক্ষাপটকে স্মরণ করিয়ে দিয়েই অবতীর্ণ হয়।

যাকে তারা হত্যা করতে চেয়েছিলো বা দেশ থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলো সেই ব্যক্তিই কিনা মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে বিশাল সমারোহে বিনা বাধায় মক্কা বিজয় করেছিলেন। এটা ছিলো ঈমানদারদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ধৈর্য আর ঈমানের পথে অবিচল থাকার পুরস্কার। 


আলোচ্য বিষয় 

সূরা আনফালে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ আলোচিত হয়েছে-

- গনিমতের মাল বণ্টন নীতি

- বদর যুদ্ধ পরবর্তী পর্যালোচনা

- যুদ্ধবন্দীদের সাথে আচরণ

- জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহের মর্যাদা

- হিজরতের মর্যাদা


প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যা 

হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করো- یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تَتَّقُوا اللّٰهَ   

এখানে ঈমানদার বলে বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সাহাবাদের বুঝানো হয়েছে। যারা শুধু আল্লাহর খুশির জন্য এই অসম যুদ্ধে রাসূল সা.-এর আহবানে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই অংশ নিয়েছিলো। নিশ্চিত মৃত্যুর ঝুঁকি জেনেও দৃঢ় ঈমানের চেতনায় বলীয়ান হয়ে তারা সেদিন এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। আর আমভাবে সকল মুত্তাকিকেই এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সম্বোধন করেছেন। উক্ত আয়াতে اِنۡ শব্দটি حُرُوْفُ الشَّرْطِ। আর حُرُوْفُ الشَّرْطِ এর হরফসমূহ তিনটি। যা সাধারণত বাক্যের শুরুতে বসে

اِنْ – لَوْ- اَمَّا

এগুলো দু’টি বাক্যের উপর দাখিল হয় (Conditional Sentence)।

১. اِنْ- ভবিষ্যৎ কালের জন্য আসে ماضى এর উপর দাখিল হয়।

২. لَوْ- ماضى  এর জন্য আসে। مضارع এর উপর দাখিল হয়। যেমন :

لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا

অর্থ: যদি আসমান ও জমিনে আল্লাহ ছাড়া বহু ইলাহ থাকত তবে উভয়ই ধ্বংস হয়ে যেত।

৩. اَمَّا- ঐ বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যার জন্য আসে যা পূর্বে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে।

যেমন: فَأَمَّا مَنْ أُوتِيَ كِتَابَهُ بِيَمِينِهِ . فَسَوْفَ يُحَاسَبُ حِسَاباً يَسِيراً

অর্থ: অতঃপর যাকে তার আমলনামা তার ডান হাতে দেওয়া হবে; অত্যন্ত সহজভাবেই তার হিসাব-নিকাশ করা হবে। (সূরা ইনশিকাক : ৮-৯)

তাকওয়া শব্দটি মূলত وقى মূলধাতু থেকে নির্গত। কুরআনে ২৮৫ বার وقى শব্দটি এসেছে। যেমন :

(১) সূরা আলে ইমরান : ১০২

يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ ٱتَّقُوا۟ ٱللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ

অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যেমন তাকে ভয় করা উচিত।

(২) সূরা তাগাবুন : ১৬

فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ

অর্থ: অতএব তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় কর

(৩) সূরা আহযাব : ৭০

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلاً سَدِيداً

অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল।

(৪) সূরা তালাক : ২-৩ 

وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا

অর্থ: যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরি করে দেন।


তাকওয়া এর সংজ্ঞা

তাকওয়া অর্থ নিরাপদ থাকা/বেঁচে থাকা। কেউ তাকওয়া এর গুণ অর্জন করলে গুনাহ থেকে তেমনি বেঁচে থাকতে পারবে যেমনি অবচেতন মনেও আগুনের কাছে হাত গেলে মানুষ সতর্কবার্তার সাথে নিজেকে দূরে রাখে। আবার তাকওয়া অর্থ বাঁচা, আত্মরক্ষা করা, নিষ্কৃতি লাভ করা, ভয় করা। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের আশায় অপরাধ, অন্যায় ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কথা ও কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নাম তাকওয়া। একবার হজরত উবাই ইবনে কাব রা.-কে হজরত ওমর রা. তাকওয়ার স্বরূপ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তিনি বলেছেন, ‘হে ওমর, পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন, মাঝখানে সরুপথ। এমতাবস্থায় কিভাবে চলতে হবে?’ হজরত ওমর রা. জবাব দিলেন, ‘গায়ে যেন কাঁটা না লাগে, সাবধানে পথ চলতে হবে।’ হজরত কাব রা. বললেন, ‘এটাই তাকওয়া।’

হজরত ওমর রা.-এর জীবনের আরো একটি ঘটনা থেকে তাকওয়ার মর্ম উপলব্ধি করা যায়। খলিফা থাকা অবস্থায় তিনি লোকজনের খোঁজখবর নেওয়ার জন্য রাতের বেলা অলিগলিতে বের হতেন। এক রাতে তাহাজ্জুদের পর তিনি হাঁটছেন। হঠাৎ দেখলেন, একটি ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাধারণত কারো ব্যক্তিগত কথা আড়ি পেতে শোনা বৈধ নয়, কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তির জন্য প্রয়োজনে তা বৈধ। কথাবার্তার ধরন দেখে ওমর রা.-এর কৌতূহল জন্মে। তিনি ঘরের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন। তিনি শুনতে পেলেন, এক বৃদ্ধা তার মেয়েকে বলছে, ‘বেটি! আজ তো উটের দুধ কম হয়েছে। এত অল্প দুধ বিক্রি করে দিন গুজরান করা কষ্টকর হবে। তাই দুধের সঙ্গে একটু পানি মিশিয়ে দাও।’ মেয়ে জবাব দিলো, ‘মা! আমিরুল মুমিনিন তো দুধের সঙ্গে পানি মেশাতে নিষেধ করেছেন?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘আমিরুল মুমিনিন কি আমাদের দেখছেন? তিনি হয়তো নিজ ঘরে ঘুমিয়ে আছেন। তুমি নিশ্চিন্তে পানি মেশাতে পারো।’ এ কথার জবাবে মেয়ে বলল, ‘মা, আমিরুল মুমিনিন এখানে নেই এবং তাঁর কোনো লোকও নেই। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তো আছেন! তিনি তো দেখছেন! তাঁঁর কাছে আমরা কী জবাব দেব?’ ওমর রা. দেয়ালের ওপাশ থেকে সব কথা শুনতে পাচ্ছিলেন। এতটুকু শুনেই তিনি চলে এলেন। পরদিন লোক পাঠিয়ে সে ঘরের খোঁজখবর নিলেন। তারপর বৃদ্ধার কাছে পয়গাম পাঠালেন, ‘আপনি সম্মত হলে আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাই।’

এভাবে তাকওয়ার বদৌলতে মেয়েটি আমিরুল মুমিনিনের পুত্রবধূ হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে। এই বরকতময় ঘরের তৃতীয় পুরুষে জন্মগ্রহণ করেন খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজ (রহ), যাঁকে পঞ্চম খলিফায়ে রাশেদ বলা হয়। আসলে মানুষের অন্তরে সর্বক্ষণ এই ধ্যান জাগ্রত থাকা যে ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’ এর নামই তাকওয়া।

মাআরেফুল কুরআনে এসেছে, যে লোক বিবেককে স্বভাবের উপর প্রবল রেখে এই পরীক্ষায় দৃঢ়তা অবলম্বন করবে এবং আল্লাহর আনুগত্য ও মহব্বতকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থাপন করবে তাকে কুরআন ও শরিয়তের ভাষায় তাকওয়া বলা হয়। হজরত আতিয়া আস সাদী রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল সা. বলেছেন,

لَا يَبْلُغُ الْعَبْدُ أَنْ يَكُونَ مِنَ المتَّقينَ حَتَّى يدَعَ مَا لَا بَأْسَ بِهِ حَذَرًا لِمَا بِهِ بأسٌ

কোনো বান্দাহ ততক্ষণ পর্যন্ত মুত্তাকি হতে পারবে না যতক্ষণ না সে গুনাহর আশঙ্কায় গুনাহ নেই এমন কাজও ছেড়ে দেবে। (তিরমিজি-ইফা ২৪৫৪)


- তাকওয়ার তিনটি পুরস্কার -

یَجۡعَلۡ لَّکُمۡ فُرۡقَانًا وَّ یُکَفِّرۡ عَنۡکُمۡ سَیِّاٰتِکُمۡ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ

১. তাকওয়া বান ব্যক্তি ফুরকান লাভ করবে (তাফহীমুল কুরআনে যার অনুবাদ করা হয়েছে কষ্ঠি পাথর)

২. গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে

৩. কিয়ামতের দিন মাগফেরাত বা পরিত্রাণ দান করা হবে


فُرْقَانٌ এর ব্যাখ্যা

فُرْقَان ও فَرْقٌ দুটি ধাতুর সমার্থক। ফুরকান বলতে এমন সব বস্তু বা বিষয়কে বলা হয় যা দু’টি বস্তুর মাঝে প্রকৃত পার্থক্য বা দূরত্ব সূচিত করে দেয়।

এছাড়া আল্লাহর সাহায্যকে  فُرْقَان বলা হয়। কারণ এর দ্বারা সত্যপন্থীদের বিজয় এবং তাদের প্রতিপক্ষের পরাজয় সূচিত হওয়ার মাধ্যমে সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সৃষ্টি হয়। এ জন্য কুরআনে গাযওয়ায়ে বদরকে يوم الفرقان বলা হয়েছে।

এ আয়াতকে তাকওয়া অবলম্বনকারীদের “ফুরকান” দান করার মমার্থ হলো- অধিকাংশ মুফাসসিরিনের মতে, তাদের প্রতি আল্লাহ সাহায্য করেন। কোনো শত্রু তাদের ক্ষতি সাধন করতে পারে না। যাবতীয় উদ্দেশ্য তারা সাফল্য লাভে সমর্থ হন। 

কারো মতে, ফুরকান বলতে কোনো জ্ঞান বুদ্ধিকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ মুত্তাকি হলে আল্লাহ ব্যক্তিকে কুরআনের এলেমের প্রখরতা দান করেন।

হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন, আল্লাহ তায়ালার ভয় করবে তুমি যখন যেভাবেই থাকো না কেন। আর মন্দ কাজ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নেক কাজ করবে। কারণ নেক কাজ মন্দ কাজকে মুছে ফেলে। আর মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। মুমিনের জন্য আল্লাহভীতি ওয়াজিব।


- আল্লাহ ভীতি অর্জনের জন্য করণীয় 

১. ফরজ, ওয়াজিব এবং ছোট ছোট সুন্নতের প্রতি যত্নবান হওয়া

২. বেশি বেশি বুঝে বুঝে কুরআন তিলাওয়াত করা।

৩. কারো ব্যাপারে কোনো গিবতের চর্চা না করা।

৪. হালাল রুজি ভক্ষণ করা।

৫. অভাবী ও মিসকিনকে খাবার খাওয়ানো (সচ্ছল বা অসচ্ছল উভয় অবস্থায়)

৬. নিজের আয় থেকে দান করা।

৭. ইসলামের কোনো হুকুমকে ছেড়ে না দেওয়া।

৮. হতাশা গ্রাস না করা। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল বাড়ানো।

৯. ব্যস্ততা কাটিয়ে এলেম অর্জনে মনোনিবেশ করা। 


- কুরআনের আলোকে তাকওয়ার ১০টি পুরস্কার রয়েছে-

১. জীবনকে সহজ করে দেয়। (সূরা তালাক : ৪)

وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰهَ یَجۡعَلۡ لَّهٗ 

২. মর্যাদা বৃদ্ধি করে। (সূরা হুজুরাত : ১৩)

اِنَّ اَکۡرَمَکُمۡ عِنۡدَ اللّٰهِ اَتۡقٰکُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ

৩. পরকালে উত্তম পরিণতি। (সূরা কাসাস : ৮৩)

تِلۡکَ الدَّارُ الۡاٰخِرَۃُ نَجۡعَلُهَا لِلَّذِیۡنَ لَا یُرِیۡدُوۡنَ عُلُوًّا فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا فَسَادًا ؕ وَ الۡعَاقِبَۃُ لِلۡمُتَّقِیۡنَ

৪. আল্লাহ ভীরুদের জন্য ২টি জান্নাত। (সূরা রহমান : ৪৬)

وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهٖ جَنَّتٰنِۚ  

৫. তাকওয়া পাপ মোচন করে। (সূরা তালাক : ৫)

وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰهَ یُکَفِّرۡ عَنۡهُ سَیِّاٰتِهٖ وَ یُعۡظِمۡ لَهٗۤ اَجۡرًا

৬. জাগতিক জীবনেও সুসংবাদ। (সূরা ইউনুস : ৬৩)

الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ کَانُوۡا یَتَّقُوۡنَ

৭. আল্লাহ ভীরুরাই সফল। (সূরা নুর : ৫২)

وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ یَخۡشَ اللّٰهَ وَ یَتَّقۡهِ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الۡفَآئِزُوۡنَ

৮. কিয়ামতে পরিত্রাণের মাধ্যম। (সূরা তালাক : ২)

وَ مَنۡ یَّتَّقِ اللّٰهَ یَجۡعَلۡ لَّهٗ مَخۡرَجًا ۙ

৯. তাকওয়া রিজিকের দরজা খুলে দেয়। (সূরা তালাক : ৩)

وَّ یَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَیۡثُ لَا یَحۡتَسِبُ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَکَّلۡ عَلَی اللّٰهِ فَهُوَ حَسۡبُهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بَالِغُ اَمۡرِهٖ ؕ قَدۡ جَعَلَ اللّٰهُ لِکُلِّ شَیۡءٍ قَدۡرًا

১০. আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্তি। (সূরা হুদ : ১১৩)

وَ لَا تَرۡکَنُوۡۤا اِلَی الَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا فَتَمَسَّکُمُ النَّارُ ۙ وَ مَا لَکُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ مِنۡ اَوۡلِیَآءَ ثُمَّ لَا تُنۡصَرُوۡنَ

ইমাম শাফেয়ি বলেন, আমি ৩টি বিষয় পছন্দ করি-

১. অভাবের সময় দান করা,

২. নির্জনে আল্লাহকে ভয় করা,

৩. যার কাছে আশা করা হয় বা যাকে ভয় করা হয় তার সামনে উচিত কথা বলা।


আয়াত নং ৩০

وَ اِذۡ یَمۡکُرُ بِکَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا لِیُثۡبِتُوۡکَ اَوۡ یَقۡتُلُوۡکَ اَوۡ یُخۡرِجُوۡکَ ؕ وَ یَمۡکُرُوۡنَ وَ یَمۡکُرُ اللّٰهُ ؕ وَ اللّٰهُ خَیۡرُ الۡمٰکِرِیۡنَ

উক্ত আয়াতটি রাসূলে কারিম সা.-এর মক্কা থেকে হিজরতের পূর্বের ঘটনা তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলো রাসূলকে হত্যা করার কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিলো ভিন্ন।

দ্বিতীয় বাইয়াতে আকাবার আড়াই মাস পরে নবুয়তের চতুর্দশ বছরের ২৬শে সফর, ১২ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রি. (বৃহস্পতিবার) দারুন নদওয়ার বৈঠক। নজদের এক বৃদ্ধ রূপে শয়তান সে বৈঠকে উপস্থিত হয়।

হিজরত পূর্বকালে রাসূলুল্লাহ সা. যখন কাফের পরিবেষ্টিত ছিলেন এবং তারা তাকে হত্যা কিংবা বন্দী করার ব্যাপারে সলা-পরামর্শ করছিল, তখন আল্লাহ রাববুল আলামিন তাদের এ অপবিত্র হীন চক্রান্তকে ধূলিসাৎ করে দেন এবং রাসূলুল্লাহ সা.কে নিরাপদে মদিনায় পৌঁছে দেন। ঘটনা এই যে, মদিনা থেকে আগত আনসারদের মুসলিম হওয়ার বিষয়টি যখন মক্কায় জানাজানি হয়ে যায়, তখন মক্কার কুরাইশরা চিন্তিত হয়ে পড়ে যে, এ পর্যন্ত তো তার ব্যাপারটি মক্কার ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে সর্বপ্রকার ক্ষমতাই ছিল আমাদের হাতে। কিন্তু এখন যখন মদিনাতেও ইসলাম বিস্তার লাভ করছে এবং বহু সাহাবি হিজরত করে মদিনায় চলে গেছেন, তখন এদের একটি কেন্দ্র মদিনাতেও স্থাপিত হয়েছে। এমতাবস্থায় এরা যেকোনো রকম শক্তি আমাদের বিরুদ্ধে সংগ্রহ করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের উপর আক্রমণও করে বসতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে তারা এ কথাও উপলব্ধি করতে পারে যে, এ পর্যন্ত সামান্য কিছু সাহাবিই হিজরত করে মদিনায় গিয়েছেন, কিন্তু এখন প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যে, স্বয়ং মুহাম্মাদ সা.ও সেখানে চলে যেতে পারেন। সে কারণেই মক্কার নেতৃবর্গ এ বিষয়ে সলা-পরামর্শ করার উদ্দেশ্যে মসজিদুল হারাম সংলগ্ন ‘দারুন-নদওয়াতে’ এক বিশেষ বৈঠকের আয়োজন করে যাতে আবু জাহল, নযর ইবন হারেস, উমাইয়া ইবন খালফ, আবু সুফিয়ান প্রমুখসহ বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্ব অংশগ্রহণ করেন এবং রাসূল সা. ও ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির মোকাবেলার উপায় ও ব্যবস্থা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করা হয়। এখানে বসেই রাসূলুল্লাহ সা.কে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। (বিস্তারিত দেখুন: মুসনাদে আহমাদ ১/৩৪৮)

পরামর্শ অনুযায়ী কাফেররা সন্ধ্যা থেকেই রাসূলুল্লাহ সা.-এর বাড়িটি অবরোধ করে ফেলে। আল্লাহর নির্দেশক্রমে রাসূলুল্লাহ সা. একমুঠো মাটি হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন এবং তিনি তা সবার দিকে লক্ষ্য করে ছিটিয়ে দিয়ে তাদের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে আসেন। কুরাইশ সর্দারদের পরামর্শে রাসূলুল্লাহ সা.-এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক যে তিনটি মত উপস্থাপিত হয়েছিল সে সবকটিই কুরআনের এ আয়াতে উল্লেখ করে বলা হয়েছে “সে সময়টি স্মরণ করুন, যখন কাফেররা আপনার বিরুদ্ধে নানা রকম ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয় চিন্তা-ভাবনা করছিল যে, আপনাকে বন্দী করে রাখবে না হত্যা করবে, নাকি দেশ থেকে বের করে দেবে। কিন্তু আল্লাহ তাদের সমস্ত পরিকল্পনা ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। সুতরাং আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে وَاللهُ خَيْرُ الْمٰكِرِيْنَ  অর্থাৎ আল্লাহ্ তায়ালা সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থাপক, যা যাবতীয় ব্যবস্থা ও পরিকল্পনাকে ছাপিয়ে যায়। যেমনটি এ ঘটনার সাথে পরিলক্ষিত হয়েছে।


শিক্ষা 

১. মুত্তাকি হবার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এবং রিয়া যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা।

২. আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা কারণ আল্লাহর পরিকল্পনাই চূড়ান্ত ও শ্রেষ্ঠ।

৩. বাতিলের সকল চক্রান্ত যেন আমাদের হতাশ না করে।

৪. হিজরতের উদ্দেশ্য হবে কেবল আল্লাহকে পাওয়া।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, ছাত্রসংবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুন

Hafez Nazrul

- 2 months ago

ছাত্র সংবাদ অসাধারণ একটি লাইব্রেরী আমাদের জন্য, আলহামদুলিল্লাহ

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির